এবার কি পারবেন বার্নি স্যান্ডার্স?

গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী বার্নি স্যান্ডার্স। ছবি: রয়টার্স
গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী বার্নি স্যান্ডার্স। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের এখনো অনেক দিন বাকি। কিন্তু এরই মধ্যে ২০২০ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন নিয়ে বেশ আলোচনা জমে উঠেছে দেশটির রাজনীতির মাঠে। এর কারণ অতি অবশ্যই ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমনিতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকাঠামোটি প্রেসিডেন্টকেন্দ্রিক হওয়ায় এ নিয়ে আলোচনাটা স্বাভাবিক। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প এই কেন্দ্রিকতাকে আরও বাড়িয়েছেন। তিনি এমন এক ব্যক্তি, যিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার আগেই তাঁর অভিশংসন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। আর ক্ষমতায় বসে তিনি এমন অনেক কিছু করেছেন ও করছেন, যার জন্য নির্বাচনের বহু আগেই নির্বাচনী দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে।

এই দৌড়ঝাঁপ সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে। এরই মধ্যে দলটির বিশজনের বেশি নেতা আগামী নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন। এ তালিকায় অবধারিতভাবেই রয়েছেন গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সবাইকে চমকে দেওয়া গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী বার্নি স্যান্ডার্স। ভারমন্টের এ সিনেটর আগেরবার হিলারি ক্লিনটনের কাছে প্রাথমিক নির্বাচনে হারলেও তরুণদের সমর্থন আদায় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। নতুন পন্থায় নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহেও সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন এ প্রচলিত প্রতিষ্ঠানবিরোধী নেতা। শেষ পর্যন্ত পারেননি। এবার আবার তিনি প্রার্থী হচ্ছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এবার তিনি পারবেন কি না।

প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে যে বার্নি স্যান্ডার্সের সামনে এবার চ্যালেঞ্জ কম থাকবে। কিন্তু আদতে উল্টো। বরং, এবারই তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জ বেশি। কারণ, এবার তাঁর সামনে শুধু ডেমোক্র্যাট পার্টির মূলধারার নেতৃত্বই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে থাকছে না, রয়েছেন স্যান্ডার্সপন্থী হিসেবে উত্থান ঘটা তাঁরই শিষ্যরা। এ দুই ক্ষেত্রে দুজন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হতে হবে তাঁকে। এঁদের একজন ডেমোক্র্যাট ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে পরিচিত জো বাইডেন, অন্যজন তাঁর অনুসারী এলিজাবেথ ওয়ারেন। এর বাইরে রয়েছেন আরও অনেকে। ফলে এ ক্ষেত্রে সমীকরণ একটু উল্টেপাল্টে গেলেই পা হড়কানোর শঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

বিবিসি জানাচ্ছে, চলতি মাসেই স্যান্ডার্সের প্রচারশিবির ক্যালিফোর্নিয়া ভ্রমণ করেছে, যা গত প্রাথমিক নির্বাচনে তাঁর শেষ যুদ্ধক্ষেত্র ছিল। এবারের এই প্রচার তাই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দেখা গেল, ক্যালিফোর্নিয়ায় কিছুই বদলায়নি। এ প্রচারশিবিরে রয়েছেন ২০১৬ সালের নির্বাচনের অভিজ্ঞতাপুষ্ট ব্যক্তিরা। প্রচারসভায় তরুণদের উপস্থিতি ছিল অনেক। বেশ আশাব্যঞ্জক। কিন্তু সংকট হচ্ছে স্যান্ডার্স এবার নতুন কোনো কথা বলতে পারেননি। তিনি তাঁর ৩৫ মিনিটের বক্তব্যে গোষ্ঠীবাদ, অভিজাত, বহুজাতিক করপোরেশন, ওয়াল স্ট্রিট, বৈষম্য, অতি ধনী ইত্যাদির বিরুদ্ধে পরিচিত ধ্বনিটিই তুলেছেন। সঙ্গে ছিল সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, বিনা বেতনে শিক্ষা, পরিবেশ সুরক্ষা ও জাতীয়ভাবে ন্যূনতম মজুরি অন্তত ১৫ ডলার নির্ধারণের মতো বিষয়গুলো। বলার অপেক্ষা রাখে না, এবারও তরুণেরা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। কারণ, তাঁরা পরিবর্তন চান।

কথা হচ্ছে, এবার তাঁর সামনে হিলারি ক্লিনটন না থাকলেও রয়েছেন জো বাইডেন। এবার জো বাইডেনই ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রচলিত পথটির প্রতিনিধিত্ব করবেন। প্রভাবশালী নেতারাও তাঁর পেছনেই থাকবেন। সঙ্গে অবধারিতভাবেই থাকবে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগও। তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও ব্যাপক। দীর্ঘদিন ধরে তিনি দলের মূলধারার সঙ্গে রয়েছেন। তরুণদের মধ্যেও তাঁর একটি অবস্থান রয়েছে। সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের হলেও এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা বলছেন, তাঁরা হয় বার্নি, নয়তো বাইডেনকে সমর্থন জানাবেন। শুনতে যেমনই লাগুক, এটাই বাস্তবতা।

আসন্ন নির্বাচনে পরিবেশ ইস্যুটি একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এর কারণও অবশ্য জলবায়ু পরিবর্তনকে ‘গুজব’ আখ্যা দেওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্পই। প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেওয়ার পর থেকেই তরুণদের একটি বড় অংশ এর বিরোধিতায় মাঠে নেমেছিল। আর বেশ কয়েকটি বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার পর বর্তমানে এই ইস্যুই সবার সামনে রয়েছে। ইউরোপের দেশগুলোয় ফ্রাইডে মার্চ কিন্তু এখনো সক্রিয়। এই সবকিছুর মধ্যে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থীকে এ ক্ষেত্রে বড় প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে পূর্ব অবস্থানের কারণেই বার্নি কিছুটা এগিয়ে থাকলেও তাঁর সামনে সমমনা এলিজাবেথ ওয়ারেন বাধা হয়ে উঠতে পারেন।

ক্যালিফোর্নিয়ায় স্যান্ডার্স তাঁর পরিচিত ঢঙেই বলেছেন, ‘সবাই মিলে আমরা একটি রাজনৈতিক বিপ্লব শুরু করেছিলাম, যার শক্তি ও ধারণাগুলো শুধু ডেমোক্রেটিক পার্টিতেই পরিবর্তন আনেনি, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতেও পরিবর্তন এনেছে। এখন আমরা এই বিপ্লবকে আরও এগিয়ে নেব।’

স্বাভাবিকভাবেই স্যান্ডার্স আশাবাদী। কিন্তু রাজনীতির ময়দান হলিউডি ফিল্মের পরিণতির চেয়েও ক্লাইম্যাক্সে ভরা থাকে। এক সিনেমার চিত্রনাট্য মেনে একই ধরনের আরেকটি সিনেমা কখনো আগায় না। অর্থাৎ একসময় যা বিরাট আলোড়ন তুলেছে, তা যে সব সময় আলোড়ন তুলবে এমন কোনো স্বতঃসিদ্ধ রীতি রাজনীতিতে নেই। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে নতুন কিছু অবশ্যই হাজির করতে হবে স্যান্ডার্সকে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের শাসনের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশ্বাসযোগ্য প্রস্তাব হাজির করতে হবে তাঁকে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন কর্মপন্থা দিতে হবে। কিছু কিছু হাজিরও করছেন তিনি। এর মধ্যে ফৌজদারি বিচার পদ্ধতির সংস্কারের প্রতিশ্রুতি উল্লেখযোগ্য। তিনি ‘কারা-শিল্প কমপ্লেক্স’ নামক একটি ধারণাকে সামনে এনেছেন। কিন্তু এটুকু যথেষ্ট নয়। অনেক বেশি হোমওয়ার্কের প্রয়োজন রয়েছে।

জো বাইডেন। ছবি: এএফপি
জো বাইডেন। ছবি: এএফপি

স্যান্ডার্স নিশ্চিতভাবেই ২০১৬ সালের সাফল্যসূত্রটিকে এগিয়ে নিতে এবং ভুলগুলোকে কমিয়ে আনতে চাইছেন। এ কারণে তহবিল সংগ্রহে এবার আগেভাগেই নেমেছেন। একই সঙ্গে প্রচারশিবিরে অভিজ্ঞ ও তারকা ভাবমূর্তির অধিকারীদের যুক্ত করতে চাইছেন। তিনি চাইছেন একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে তাঁর প্রচারটিকে পৌঁছে দিতে। এখানটাতেই ঘাটতি ছিল গত নির্বাচনে। এই ঘাটতিগুলো পূরণে স্যান্ডার্স এরই মধ্যে অনেকটা এগিয়েছেন। ২০১৬ সালের নির্বাচন তাঁকে জাতীয়ভাবে পরিচিত করে তুলেছে। ফলে তাঁর ওপর লগ্নিকারীর সংখ্যা এবার এমনিতেই বেশি হবে।

বিবিসি জানাচ্ছে, এরই মধ্যে স্যান্ডার্সের পক্ষে স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ফলে তৃণমূল থেকে গণচাঁদা তুলে আনাটা তাঁর জন্য এবার অনেক বেশি সহজ হবে। এ বছরের প্রথম তিন মাসেই তাঁর সংগৃহীত তহবিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৮২ লাখ ডলার।

এ পরিসংখ্যান নিঃসন্দেহে আশাবাদী করে। তবে মনে রাখা জরুরি, জো বাইডেন আছেন। বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান বাইডেনের পেছনেই দাঁড়াবে। একজন অস্বস্তিকর বার্নি স্যান্ডার্স তাদের কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। নির্বাচনের ক্ষণ যত এগিয়ে আসবে, এই তহবিল সংগ্রহে স্যান্ডার্স তত প্রতিযোগিতার মুখে পড়বেন বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, এলিজাবেথ ওয়ারেনের মতো অনেকেই রয়েছেন।

এবারের নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের নেতৃত্বে মার্কিন প্রশাসন কয়েকটি ফ্রন্টে যে যুদ্ধ আবহ তৈরি করেছে, তা–ও একটি বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে পারে স্যান্ডার্সের জন্য। কারণ, স্যান্ডার্স একজন যুদ্ধবিরোধী হিসেবে পরিচিত। ফলে ইরানের সঙ্গে চলমান উত্তেজনা আরও বাড়লে, তাঁর যুদ্ধবিরোধী অবস্থানকে অন্যভাবে চিত্রিত করা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে এমন পরিস্থিতিতে এ ধরনের অবস্থান দেশপ্রেম নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতার কারণে তাঁকে নিয়ে এ ধরনের প্রশ্ন আগেও তোলা হয়েছিল। এটা পরিষ্কার যে এমন একটি সুবিধা পেতেই ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ধরনের উত্তেজনা তৈরি করছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, স্যান্ডার্স এটি মোকাবিলা করতে পারবেন কি না।

এমন বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বার্নি স্যান্ডার্সকে। একজন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী হিসেবে তিনি নিজের যে পরিচয় তুলে ধরেন সরাসরি, তার একটি জাতীয় রূপ দিতে হবে তাঁকে। একই সঙ্গে এমন পরিচয় দেওয়া এলিজাবেথ ওয়ারেনের মতো প্রার্থীদের সঙ্গে যেন তাঁর ভোট ভাগ হয়ে না যায়, সে বিষয়টিও দেখতে হবে। সঙ্গে বাইডেনের মতো প্রার্থী ও প্রতিপক্ষ শিবির রিপাবলিকানদের প্রচারের তির সামলানোর বিষয়টি তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে ২০১৬ সালে ঝলক দেখানো স্যান্ডার্সকে এবার শুরু থেকেই শুরু করতে হবে, বরং আরও বেশি আটঘাট বেঁধে। শেষ পর্যন্ত তিনি পারবেন কি পারবেন না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও কর্টেজ বা এলিজাবেথ ওয়ারেনের মতো শক্ত শিষ্য রেখে যেতে পারবেন—এটা একরকম নিশ্চিত।