বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলনের আদ্যোপান্ত

রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারির আর বেশি বাকি নেই। ভাষা আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ২০০৮ সালে মহান একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ নামে প্রকাশিত হয়েছিল একটি বই। এখানে কেবল ভাষা আন্দোলন নয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ওপরও আলো ফেলা হয়েছিল নানা দিক থেকে। সেই বই প্রকাশের দশ বছর পূর্তির পর ভাষার এ মাসে জেনে নেওয়া যাক বইটি সম্পর্কে।

মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। অথচ ভাষাপ্রেমিক এই আমাদের মধ্যে কতজন জানেন, এই গাঙ্গেয় বঙ্গদেশেই আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগে বাংলা ভাষা নিয়ে এমন একটি প্রকাশনা তৈরি হয়েছিল, যার তুলনা এ দেশে তো বটেই, বিশ্বেও বিরল! ২০০২ সালে, একুশে ফেব্রুয়ারির সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলা ভাষাকে নিয়ে এক ভিন্ন ধরনের প্রকাশনা তৈরির পরিকল্পনা নেয় অ্যাডর্ন পাবলিকেশন।

ভাষা আন্দোলনের অর্ধশতাব্দী পূর্তিতে অ্যাডর্ন যে স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশের উদ্যোগ নেয়, এবং ২০০৮–এ মহান একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ নামে যে বইটি প্রকাশিত হয়, সেটি কেবল অ্যাডর্ন নয়, যেকোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের জন্যই এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশি একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এ কাজ রীতিমতো ‘নিধুয়া পাথার’ পার হওয়ার মতো। প্রায় ছয় বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় প্রকাশক সৈয়দ জাকির হোসাইন সে পাথার অতিক্রম করেছেন অনমনীয় সংকল্পে। এ কাজে সারথির দায়িত্ব পালন করেছেন উপদেষ্টা সম্পাদক প্রয়াত আবদুল মান্নান সৈয়দ। আর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মূল্যবান দিকনির্দেশনা দিয়েছেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

বাংলা ভাষারূপ হীরকখণ্ডের দ্যুতিময় সমস্ত দিককে পরম যত্নে উপস্থাপিত করার কাজে সম্পাদক মাহ্​বুব উল্লাহর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন উপদেষ্টা, যুগ্ম সম্পাদক, সহকারী সম্পাদকসহ শতাধিক লেখক, প্রদায়ক ও সম্পাদনা সহযোগী। সব মিলিয়ে ১৭৬০ পৃষ্ঠার যে বিপুলায়তন গ্রন্থটি নির্মিত হলো, সেটি কেবল ভাষা বিষয়েই নয়, এ দেশের প্রকাশনাশিল্পের ইতিহাসেরও একটি মাইলফলক।

বিশালাকার এই বই মোট ২৮টি পর্বে বিন্যস্ত। প্রথম পর্বে আছে বাংলা ভাষাকে উপজীব্য করে লেখা পদ্য ও গদ্য, যার পদ্য অংশে পঞ্চদশ শতকের কবি শাহ মুহম্মদ সগীর থেকে শুরু করে বিশ শতক পর্যন্ত কবিদের কবিতা আর গদ্য অংশে স্থান পেয়েছে। আর গদ্য অংশে রয়েছে বঙ্কিম-হরপ্রসাদ শাস্ত্রী-নজরুল থেকে শুরু করে আধুনিক চিন্তকদের বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রবন্ধসমূহ। এরপর পর্যায়ক্রমে বিন্যস্ত হয়েছে বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিবর্তন, ভাষা নিয়ে বিতর্ক, ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ-প্রত্যক্ষদর্শী ও ভাষাচিন্তকদের তথ্যবহুল নানা লেখা। বাংলা ভাষার উৎসসন্ধানী গবেষকদের জন্য ‘আ-মরি বাংলা ভাষা’ ও ‘বিবর্তন’ শীর্ষক দুটি পর্ব কেবল নতুন তথ্যেই নয়, নতুন ভাবনারও খোরাক জোগায়। ভাষা আন্দোলনের গোড়ার কথা ও সামগ্রিক প্রেক্ষাপট নিয়ে ‘ভাষা আন্দোলনের পটভূমি’ শিরোনামের পর্বটিও অত্যন্ত তথ্যবহুল। ‘সংবাদপত্রে ভাষা আন্দোলন’ নামের পর্বে ভাষা আন্দোলনে নানা সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা চিত্রিত হয়েছে, যা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও বিস্তৃত। ভাষাসৈনিকদের স্মৃতিচারণানির্ভর দশম পর্বটি এক শ পৃষ্ঠার বেশি বিস্তৃত, প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানিতে ভাষা আন্দোলনের দিনগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে লেখাগুলোতে—যেন বিদ্রোহ আর বারুদের গন্ধভরা বায়ান্নর একুশ তার সমস্ত বৈভব নিয়ে হাজির হয়েছে পাঠকের সামনে। ভাষা আন্দোলনে নারীদের অবদানের আলেখ্য, জেলায় জেলায় ভাষা আন্দোলনের ইতিবৃত্ত এবং দেশে দেশে ভাষা আন্দোলনের বিবরণ নিয়ে সাজানো হয়েছে তিনটি পৃথক পর্ব।

ভাষা আন্দোলনের অমর স্মারক শহীদ মিনারের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে নিয়ে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা স্থান পেয়েছে আরেকটি পর্বে। বাঙালির ভাষা আন্দোলন যে যুগবিচ্ছিন্ন কোনো আকস্মিকতা নয়, বরং শতাব্দীবিস্তৃত এক পরম্পরারই অংশ, সেটি স্পষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে ‘ভাষা আন্দোলনে রাজনীতি-সংস্কৃতি-অর্থনীতি’ পর্বটিতে। আবদুল হামিদ খান ভাসানী, খান সারওয়ার মুরশিদ, আনিসুজ্জামান প্রমুখের চিন্তাঋদ্ধ প্রবন্ধগুলো বস্তুত ভাষা আন্দোলনের আর্থরাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের গভীরতাসন্ধানী বিশ্লেষণ।

মহান একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ
উপদেষ্টা সম্পাদক:
আবদুল মান্নান সৈয়দ
সম্পাদক: মাহ্​বুব উল্লাহ
প্রচ্ছদ: সৈয়দ লুৎফুল হক, প্রকাশক: অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০০৮, ১৭৬০ পৃষ্ঠা, দাম: ৩০০০ টাকা।

‘উৎসৃজন’ পর্বটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতিদীর্ঘ তবে গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা সংকলিত হয়েছে, যেটি ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত ভাষা আন্দোলনের স্মরণ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বঙ্গবন্ধু-প্রদত্ত ভাষণের অংশবিশেষ।

বাংলা চর্চা ও ব্যবহার নিয়ে যে পর্বটি, তা এই সংকলনগ্রন্থের বৃহত্তম, যেখানে মোট পঁয়তাল্লিশটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। বাংলা ভাষাচর্চার নানা প্রায়োগিক বিষয়ের পাশাপাশি পরিভাষা, আঞ্চলিক ভাষা, আদিবাসীদের মাতৃভাষা, ভাষানীতি ইত্যাদি জরুরি প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে বিস্তৃত পরিসরে। ভাষাসৈনিক ও ভাষাচিন্তকদের সাক্ষাৎকার এবং বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ গতিপথ নিয়ে সাজানো হয়েছে দুটি পর্ব। মহান ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্রের অন্তর্ভুক্তি গ্রন্থটির রেফারেন্স-মূল্যকে সমৃদ্ধ করেছে। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণ, পূর্ববঙ্গ সরকারের গভর্নরের কাছে পেশকৃত বিচারপতি টি এস এলিসের রিপোর্টের (যাতে প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দিসহ একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনাপ্রবাহের বিষয়ে এলিস সাহেবের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ স্থান পেয়েছে) পাশাপাশি একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। পাকিস্তান সরকারনিয়ন্ত্রিত পত্রপত্রিকায় ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করে প্রকাশিত সম্পাদকীয় ও চিঠিপত্রও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এ পর্বে।

এ ছাড়া আছে ১৯৫১ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীর কাছে খ্যাতনামা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের স্মারকলিপি ও জাতীয় সংসদে বাংলা ভাষা প্রচলন বিলসহ ঐতিহাসিক নানা দলিলপত্র। বিস্তারিত লেখক পরিচিতি ও লেখকসূচি বইয়ের অন্তে যুক্ত হয়ে এর ব্যবহারোপযোগিতা বৃদ্ধি করেছে।

বাংলা নিয়ে ভাবেন, বাংলাকে ভালোবাসেন এবং নিরন্তর ভালোবাসতে চান এমন সবার জন্য এ বইয়ের পাঠ অপরিহার্য। এর ভূমিকাংশে উপদেষ্টা সম্পাদক আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন, ‘ভাষাকেন্দ্রী বাংলা ভাষায় রচিত গদ্য-পদ্যের শেষ নেই কোনো। তারই বিভিন্ন মাত্রিক একটি নির্বাচিত চয়নিকা তৈরি করে তোলা হয়েছে এই মহাগ্রন্থে। ভাষা-আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পূর্তিকে সামনে রেখে। কয়েক বছরের বিরামহীন দিবারাত্রির শ্রমে নির্মিত। তারপরও একে আমরা বলব না হর্ম্য, বলব মাটির কুঠির। অনেক মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে তৈরি।’

বাঙালির আত্মজাগরণের সংগ্রাম দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল। এ সংগ্রামের একক ও অভিন্ন কোনো উৎসবিন্দু নেই, আছে অসংখ্য চড়াই-উতরাই আর রক্তিম সব বাঁক। হাজার বছরের পথচলায় বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতেই বোধ হয় চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছার যে চলনবেগ, সেটি অর্জন করে এই জাতি। সে কারণেই এ প্রকাশনা উল্লেখযোগ্য, কারণ জাতি হিসেবে আমাদের আত্মনির্মাণের যে সংগ্রাম তারই এক স্মারক এ বই। বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ হয় না, আর বাংলা ভাষাকে তার সমস্ত মাহাত্ম্য দিয়ে উপলব্ধি করতে হলে বাংলা ও বাঙালির শিকড় থেকে শিখরকে জানতে হবে। এই জানায় বিশ্বস্ত সঙ্গীর ভূমিকা পালন করবে এ বই।