সাদা রং টি-শার্ট

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। সাদামাটা চেহারা, দুর্বল শরীর। লম্বায় সাড়ে পাঁচ ফুট হবে হয়তো। সেপিয়ান বা সাধারণ মানুষেরা এমনই হয়। কিন্তু আমি সাধারণ মানুষ নই। আমার উচ্চতা সাত ফুট তিন। আমার কাছে পুঁচকে লাগে তাকে।

এই সেপিয়ানটার সাংকেতিক নাম জে-সিক্সটি। এরা ছিল ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের মানুষ। ২০৪৮ সালে পুরো ডুবে গিয়েছিল জাভা। সমুদ্রের পানি বেড়ে তলিয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর আরও বহু এলাকা। আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষের কিছু স্যাম্পল এনেছিলাম। জাভা থেকেও কয়েকজনকে সংগ্রহ করেছিলাম, রেখেছি দুর্ভেদ্য কাচঘেরা বিশাল ঘরে। আমরা এটাকে বলি সয়েলিয়াম।

জে-সিক্সটি সেখানকার নৈশপ্রহরী। ভয়াবহ একটা ঘটনা ঘটেছে সেখানে কাল রাতে। সাতজন জাভা মানুষ লেজারগান দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। আমি সয়েলিয়ামটার দায়িত্বে। আমাকে এর কারণ বের করতে হবে। কিন্তু জে-সিক্সটি আমার কথার উত্তর দিচ্ছে না ঠিকমতো।

‘লেজারগান ঢুকল কীভাবে সয়েলিয়ামে?’

সে ফ্যাকাশে চোখে তাকায়। আবারও বলে, ‘জানি না।’

আসলে সে জানে এটা। তার মস্তিষ্কের বাঁ দিকের নিউরনগুলোতে ঢুকে বুঝতে পারি। ডান দিকের নিউরনগুলো তথ্য জমা রাখে। বাঁ দিকেরগুলো কী বলবে, সেই সিদ্ধান্ত নেয়। আমার জন্য দরকার ডান দিকের মস্তিষ্ক। সেখানে অদ্ভুত একটা তরঙ্গ। এর মানে জানি আমি।

তাকে অবশ্য এত কিছু বলি না। শুধু বলি, ‘এর শাস্তি কী, জানো?’

ভয় পায় সে। সেপিয়ানরা অনেক কিছু লুকাতে পারে, ভয় নয়। কিন্তু সে শুধু যে ভয় পাচ্ছে, তা–ও না।

আমি বলি, ‘তুমি আমাদের খুব ঘৃণা করো, তাই না?’

সে চমকে ওঠে। তাকে বলি, ‘কেন ঘৃণা করো, জানি আমি।’

জে-সিক্সটি কুঁকড়ে যায় আতঙ্কে। আমার ক্ষমতা জানে সে। আমি চাইলে তাকে ডিএস বা ডিগ্রেডেড সেপিয়ান ক্যাটাগরিতে নামিয়ে দিতে পারি। ডিএসদের মানব জিন বদলে জন্তুদের জিন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। অল্প দিনের মধ্যে চার হাত–পায়ে হাঁটতে শুরু করে তারা। কথা না বলে জন্তুজানোয়ারদের মতো শব্দ করে। মাটি থেকে খাবার তুলে খায়। ডিএসদের মধ্যে মজার হচ্ছে ডিএসটুরা। সাপ্তাহিক উৎসবের দিন সয়েলিয়ামের খাঁচায় ঢোকানো হয় এদের। বানরের মতো খাঁচা বেয়ে ওঠে এরা। বুকে চাপড় মেরে ঝগড়াঝাঁটি করে। খাঁচার ভেতরে গাছে এক হাতে ঝুলে থাকে। আমরা টিকিট কেটে দেখি এসব।

আমরা সুপারসেপিয়ান, সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক উন্নত। আমরা জিন এডিটেড জেনারেশন। আমাদের অসুখ হয় না। যৌবনের পর আমাদের আর বয়স বাড়ে না। আমরা নার্ভাস হই না, ভয় পাই না। আমরা সেপিয়ানদের মতো না। কিন্তু আনন্দ–অনুভূতি কিছুটা সেপিয়ানদের মতোই।

আমি ইগ্রেডের সুপারসেপিয়ান। ইগ্রেডের যারা, তাদের সব ধরনের দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ জিন মায়ের গর্ভেই বদলে দেওয়া হয়। আমার বুদ্ধিমত্তা উন্নত রোবট আর সাইবর্গদের চেয়ে অনেক বেশি। আমার কোনো ক্ষয় নেই, বিনাশ নেই। একমাত্র বড় ধরনের দুর্ঘটনা ছাড়া আমার মারা যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।

এ রকম দুর্ঘটনা ঘটবে বলে মনে হয় না। যদি ঘটে, সে–ও প্রায় এক শ বছর পর। সেপিয়ানরা ভাবত, সূর্য এক বিলিয়ন বছরে ১০ শতাংশ প্রসারিত হবে। পৃথিবী জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে তখন। কিন্তু সেপিয়ানদের ধারণা ভুল। আমার সব ধরনের সিমুলেশন করে দেখেছি, এ রকম ঘটনা ঘটবে মাত্র এক মিলিয়ন বছরের মধ্যে। এর মধ্যে অবশ্য মঙ্গল গ্রহে তাপমাত্রা বাড়বে, বায়ুমণ্ডল সৃষ্টি হবে। আমরা পুরোপুরি কলোনাইজ করে ফেলব সেটা। তার আগে সেখানে গিয়ে কিছু পরীক্ষামূলক কাজ করতে হবে। আগামী এক শ বছরের মধ্যে এটা শুরু করব আমরা সুপারসেপরা। এসব করতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনা হলে মরতে পারি আমি। কিন্তু আশঙ্কা কম।

অনন্তকাল বাঁচব। আমার নাকি একঘেয়ে লাগবে না কিছু। কিন্তু এটা আদতে ঠিক নয়। এখনই আমার একঘেয়ে লাগে মাঝেমধ্যে। কয়েক বছর আগে ২০৬৭ সালে আমার পঁচিশ বছর হয়েছে। এরপর আর কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন হওয়ার কথা না। কিন্তু একঘেয়ে ও বিষণ্ন লাগার অনুভূতিটা সৃষ্টি হয়েছে এর পরই। আমার ড. মুলারের কাছে যাওয়া দরকার। আমি যাই না।

জে-সিক্সটি এখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে চলে যেতে বলি। তার বিশ্বাস হয় না প্রথমে। সে চলে যাওয়ার পর আলট্রা হিলিয়াম বেডে ঢুকি। চারপাশে কোনো শব্দ নেই, আলো নেই। খুব ধীরে বাজে আমার প্রিয় পিয়ানোর সুর। হিমেল বাতাসে চোখ বন্ধ করি আমি। একটু চেষ্টা করতেই ছেলেটাকে দেখি। সাদা টি-শার্ট পরা দুঃখী চেহারার সেপিয়ান। অদ্ভুত একটা ঘোলাটে জায়গায় বসা। তার ঠিক সামনে অপূর্ব সুন্দর একটা মেয়ে। চোখে কৌতুক নিয়ে তাকিয়ে আছে সে। ছেলেটা হাত বাড়ায়। কিন্তু তার হাতটা সামান্য উঠে থেমে যায়। স্পর্শ করতে পারে না সে তাকে। আমি আগেও দেখেছি এদের। আমি বলি, ‘তুমি কে?’

আমার কথার উত্তর দেয় না সে। আমি তাকে আরও বিভিন্নভাবে দেখতে পারি কল্পনা করলে। কিন্তু প্রতিবার সে আটকে যায় কোনো একটা কিছু করতে গিয়ে। মেয়েটাও।

আমার জেনেটিক মা দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা ইমিগ্র্যান্ট। আইসল্যান্ডে তার বাবা গবেষকের কাজ করতেন। তিনি নিজেও তা–ই করতেন। জেনেটিক মায়ের একটা ডিজিটাল ইমেজ আছে আমার নিউরো মেমোরিতে। তার সঙ্গে এত অদ্ভুত মিল ছেলেটার!

মায়ের খোঁজ পেলে তাকে জিজ্ঞেস করে জানা যেত হয়তো। কিন্তু পোস্ট-এথনো এই পৃথিবীতে সুপারসেপিয়ানদের আলাদা থাকতে হয়। এটাই নিয়ম। এসব নিয়ম আমাকো কাউন্সিলের। আমি আমাকোর কাউকে চিনি না। তাদের কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার অধিকারও নেই। আমাকোর একজন অফিসার টেকনোপ্যাথিতে নির্দেশ পাঠায় আমার কাছে। তার নাম রোজো। সে–ও সুপারসেপিয়ান। কিন্তু আমার চেয়ে সিনিয়র।

আমার ঘুম ঘুম লাগে। কিন্তু ঘুমাতে পারি না। মাথার ভেতর একটা আলো জ্বলে ওঠে হঠাৎ। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে বের হই। ডিসিশন রুমে এসে দেখি রোজো বসে আছে।

বহু বছর পর এসেছে সে। দেখে অবাক হই। রোজো বলে, ‘কেমন আছ, আরাশ?’

‘ভালো।’

‘তুমি সয়েলিয়ামের রিংয়ে যাও না?’

‘রিং মানে খাঁচা। ডিএসদের চিড়িয়াখানা। আমার ভালো লাগে না সেখানে আর। কিছু না বলে চুপ থাকি।’

রোজো বলে, ‘এক্স–বিতেও যাও না।’ এক্স-বি হচ্ছে এক্সটেসি বার। সেখানে আকর্ষণীয় সুপারসেপ মেয়েরা আছে, আছে এ রকম ছেলেও। আমি রোজোকে বলি, ‘তুমি যাও?’

রোজো কঠোর চেহারার একটা মেয়ে। আমার প্রশ্ন শুনে আরও কঠোর হয় তার চেহারা। বলে, ‘আমার এসব প্রয়োজন নেই।’

‘আমারও নেই।’

‘আছে। তুমি বিষণ্ন থাকো। সেপিয়ানদের রোগ আছে তোমার।’

একটু চমকাই আমি। সে বলে, ‘তোমার থট প্রোফাইল ওভারলোডেড। তোমার রিংয়ে যাওয়া প্রয়োজন, এক্সবি-তেও।’

‘আমার তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।’

‘হচ্ছে। তুমি জে-সিক্সটিকে শাস্তি দাওনি। এটা হওয়ার কথা নয়।’

আমি চুপ করে থাকি। রোজো শান্ত গলায় বলে, ‘তাকে নিউরো ল্যাবে পাঠাতে হবে। ডিথ্রি পানিশমেন্ট দিতে হবে।’

ডিগ্রেডেড সেপিয়ান থ্রি সবচেয়ে ভয়াবহ শাস্তি। ডিথ্রি করা হলে খুব হিংস্র হয় এদের আচার–আচরণ। বড় বড় নখ আর দাঁত দিয়ে কামড়ে কামড়ে যুদ্ধ করে এরা। মরেও সেভাবে।

আমি কাউকে ডিথ্রি পানিশমেন্ট দিই না। আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু আমি রোজোকে বলি না সে কথা। বলার অবশ্য প্রয়োজন নেই। সে এমনিই সব বোঝে।

রোজো উঠে দাঁড়ায়। কোমরে দুহাত রেখে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার গায়ে তীব্র একটা পোড়া গন্ধ। আমার চোখে চোখ রেখে হাসে সে। হিমশীতল হাসি। সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথার ভেতর অদ্ভুত একটা হুইসেলের শব্দ হয় । সারা শরীর কেঁপে ওঠে। তীব্র যন্ত্রণায় এঁকেবেঁকে উঠি।

হতবাক হয়ে তাকাই তার দিকে। আমি সুপারসেপ। আমার এটা হওয়ার কথা নয়।

রোজো বলে, ‘তোমার জন্য ওয়ার্নিং এটা। আমাকোর ওয়ার্নিং।’

রোজো চলে গেলে ক্লাউড-ওয়েভে গোসল করি। মাথা ঠান্ডা করে বসি। তার কথা ভুল নয়। জে-সিক্সটি কঠোর শাস্তি পাওয়ার মতোই কাজ করেছে। কঠোর শাস্তি দেওয়ার জন্য রোজোদের যুক্তিও আছে। আমি জানি এটা।

সেপিয়ানরা একসময় জন্তুজানোয়ারদের এভাবে শাস্তি দিত। এর চেয়েও কঠোর। সে–ও বিনা দোষে। সেপিয়ান মেয়েরা গয়না পরত, ঘর সাজাত। শুধু এ জন্য জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে মেরে ফেলা হতো হাতি–হিপপো হরিণসহ বহু প্রাণী। সমুদ্রে শ্বাসরুদ্ধ করে মারা হতো পেঙ্গুইন ডলফিনদের। আমি একটা ট্রেলারে দেখেছিলাম জ্যান্ত বানরের মাথার খুলি খুলে খেত চায়নিজ কিছু সেপিয়ান।

সেপিয়ানরা ছিল আত্মবিনাশী ধরনেরও। এক দেশ খাবার ফেলে দিত, আবার অন্য বহু দেশে খাবারের অভাবে মরে যেত অনেকে। একদল অন্য দলকে বিনা কারণে বোমা ফেলে মেরে ফেলত। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, তারপরও নিজেদের সবচেয়ে সভ্য আর শ্রেষ্ঠ ভাবত তারা।

সেপিয়ানরা অবশ্য শাস্তি পেয়েছে। তাদের কর্মকাণ্ডে পৃথিবী উত্তপ্ত হয়েছে, দুই মেরু আর হিমালয়ের বরফ গলে গেছে, সাগর হয়েছে উত্তাল। বিলুপ্ত হয়েছে তাদের বড় একটা অংশ।

আমরা নিজেদের সেপিয়ান ভাবি না। কিন্তু আসলে আমরা তো সেপিয়ানই। জিন বদলে ফেলা সেপিয়ান। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে অনেক উন্নত বলে আমাদের আর কয়লা, গ্যাস পোড়াতে হয় না, জঙ্গল উজাড় করতে হয় না। কিন্তু সত্যি যেটা তা হলো, ইউরোপে আমাদের পূর্বপুরুষেরাই সবচেয়ে বেশি করেছিল এসব। এখান থেকে আমরা মুছে ফেলেছি এসব পাপের চিহ্ন। কিন্তু ইতিহাসটা তো আছে। মুশকিল হচ্ছে আমি জানি সেটা।

আমার ইউলুপে ছবি ভেসে ওঠে একটা। জে-সিক্সটিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একটু পরই ডিথ্রি হয়ে ফিরে আসবে সে। কয়েক দিনের মধ্যে তার নখ আর দাঁত বড় হতে থাকবে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সে পুরোপুরি একটা জানোয়ারে পরিণত হবে। আমার সয়েলিয়ামে প্রথম ডিথ্রি হবে সে। এরপর সাপ্তাহিক উৎসবের জন্য কারণে–অকারণে আরও কয়েকটা সেপিয়ানকে ডিথ্রি বানানো হবে। আমি বুঝতে পারি এসব।

ইউলুপ থেকে চোখ ফিরিয়ে নিই। কোনো দিন আমার মাথাব্যথা হয়নি। আজ হচ্ছে। দুর্ঘটনায় আঘাত পেলে ব্যাকটেরিম খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আমি দুটো ব্যাকটেরিম খাই। মাথাব্যথার জন্য এটা খাওয়ার নিয়ম নেই। তবু খাই।

গভীর তন্দ্রায় আমি সাদা রং টি-শার্ট পরা ছেলেটাকে দেখি। এবার অনেক স্পষ্ট, অনেক উজ্জ্বল। আমি তাকে বলি, ‘তুমি কে?’

আমাকে অবাক করে দিয়ে কথা বলে সে। বলে, ‘আমি তুমি!’

কেঁপে ওঠে আমার ভেতরটা।

বলি, ‘তুমি কই?’

‘আমি নাই। তুমি আমাকে নিয়ে নিয়েছ।’

‘আমি তোমাকে ফেরত দেব।’

‘সত্যি!’

‘হ্যাঁ, সত্যি!’

সে হাসে। অনিন্দ্যসুন্দর হাসি। হাত বাড়িয়ে এবার মেয়েটাকে স্পর্শ করে। চুমু খায়। তারপর জড়িয়ে ধরে গভীরভাবে।

উঠে দেখি আমার দুচোখ ভিজে গেছে। বুকের ভেতর অদ্ভুত শান্তি।

আমাদের টাইম ল্যাবটা চিনি আমি। এক শ বছর পর্যন্ত অতীতে ফিরে যাওয়ার টেকনোলজি আছে সেখানে। আমাকে ফিরতে হবে মাত্র আটাশ বছর পেছনে। তারপর আর আমি থাকব না, থাকবে সাদা টি-শার্ট। একদিন তার সঙ্গে দেখা হবে রূপবতী মেয়েটার। গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরবে তারা। এমন ভালোবাসা নেই সুপারসেপিয়ান জগতে।

আমি ঠিক জানি না কীভাবে করতে হবে কাজটা। কিন্তু সেটা জানতে হবে। সাদা টি-শার্টের ছেলেটাকে কথা দিয়েছি। আমরা সুপারসেপরা কথা রাখি।