'আগল ভেঙে আসবে পাগল...'

পটুয়াখালীতে নজরুল উৎসবে বক্তৃতা দিচ্ছেন বাংলা একাডেমি মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী
পটুয়াখালীতে নজরুল উৎসবে বক্তৃতা দিচ্ছেন বাংলা একাডেমি মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী

উপুড় হয়ে নামে, পিঠে পড়ে ভাঙা রোদ। পাথর-বালির দাপট এড়িয়ে যখন চলে, তখন তো ভরা মৌসুম। চিত হয়ে আকাশ দেখে, কাত ফিরে দেখে ডান-বাম দুই তীরের লীলা। গোস্বা হলে একলহমা কেঁদে নেয়—ও মা, মেঘে মেঘে চোখ যে ডুবে গেল! কর্ণফুলী সে,—কানফুল কবে উধাও—তবে দু কাঁধে বাঁশের বহর, পায়ে কাতলের ঘাই আর নম্র জলতান যে তাকে দক্ষিণে টানে, তা বোঝে গাঙচিল আর আর্দ্র সাম্পান।

বহরে বুঝিবা আমিও ছিলাম। চার দশক আগের কোমল সন্ধ্যার অনুরাগে শুধু যোগ হবার পালা। মাছধরা ট্রলার যোগ হচ্ছে, বরফকল স্মিতহাস্যে যোগ দিচ্ছে আগুন নেভানো হোজপাইপে। আর নদী বুঝি টানছে কূল—ও আলতাফের মা, বলক ওঠা ভাত সামলাও। আলতাফ নায়ের মাঝি, সংসারের কান্ডারি। বয়স ত্রিশ না পেরোলেও বাবরি দুলিয়ে মোচড় দেয় বইঠায়—কর্ণফুলি নাচে। বড় প্রিয় ছিল বর্ষা, মোহময় ছিল পতেঙ্গা। পাথর বিছিয়ে পাটাতন, আর পাটাতনে পা রেখে কেউ বুঝি মোমকণ্ঠে গেয়ে ওঠে—‘কেউ কোনো দিন আমারে তো কথা দিল না...’।

কথা তো কেউই কোনো দিন কাউকে দেয় না। নইলে কি আর জসীমউদ্‌দীন কুমারের বুকে বেদেনৌকার বহরে সাপের ঝাঁপি খুলতেন? ফুঁসে ওঠা গোখরার গায়ে হাত বুলিয়ে চুম্বন করতে চাইতেন ঠোঁটে? আহ্ কী সে দৃশ্য! মাঝি বাইয়া যাও রে...। মাঝি বেয়ে যাচ্ছে—পাল উড়ছে, পেশিবহুল হাত টানছে গুন। আর পেছন থেকে ফিসফিসিয়ে ওঠে, এইখানে তোর দাদির কবর...। এই যে কর্ণফুলি থেকে কুমার পর্যন্ত জলের হাওয়া—প্রাণমেশানো উতলা আকাশ, তা কবিতাকে দেয় মাটির পরশ। আর মাটি মানেই তো মানুষ এবং এই মানুষের মধ্য থেকেই তো একজন কানাইলাল শীলের দোতারায় বাধা হয়ে যায় হাজেরা খাতুনের কণ্ঠ।

আমি ‘তাহাদের’ নই; তবুও কি ‘আমাদের’ হই?

দুই.

বিষয়টি চট্টগ্রাম বইমেলার, আর তাকে উপলক্ষ করেই সাহিত্যপাঠের আয়োজন। মানে দাঁড়াল বই দেখা, বই কেনা; কবিতা-গল্প-প্রবন্ধপাঠ; সংগীতবিহার...ইত্যাদি ইত্যাদি।ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে ঢাকা থেকে যাত্রাসঙ্গী হিসেবে মিলল আবেদ খান ও ফাতেমাতুজ জোহরাকে। সকালের ঘন কুয়াশায় উড়োজাহাজ উড্ডয়নে যে ঘণ্টা দুয়েক বিলম্ব হলো, তা প্রীতিপূর্ণ আড্ডায় গেল কেটে। সংবাদপত্রের সাহিত্য কিংবা মঞ্চের সংগীত থেকে পুলিপিঠা, রাই-সরিষা, হাতব্যাগের ওজন—কিছুই কথোপকথনের বাইরে থাকল না।

বেশ গোছানো বড়-সড় বইমেলা, আর তারই এক প্রান্তে মঞ্চ তৈরি করে সাহিত্য-সংগীতের আয়োজন। পাশেই রয়েছে ঐতিহাসিক চিত্রমালায় বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এক প্রদর্শনী। একসময়ের, সেই আশির দশকের গোড়ার দিকের কিছু প্রিয় মুখ খুঁজলাম। স্পর্শ পেতে চাইলাম কর্ণফুলীর স্রোতের টান। না, সময় বোধ করি দরজা বন্ধ করে আড়ালে চলে গেছে। চিম্বুক রেস্টুরেন্ট, কারেন্ট বুক সেন্টার, চেম্বার প্রেস, কবিরাজ বিল্ডিং, নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি, ফিশ হারবার...চেতনাকে মুহূর্তের জন্য হলেও ঘেঁটে দিল! তারপরও বদলে যাওয়া চট্টগ্রামের হোটেল, আবাসন, বিপণিবিতান, বাতিঘর কম কিসের! এক জীবনের প্রেম অন্য জীবনে এসে হেম হয়; আর রাধা যখন বাঁধা পড়ে যায়, তখন তো সাহিত্যের রূপ অঙ্গে ধরে কেবল উচ্ছ্বাস-উৎসব। স্মৃতির লাভ লেন আনত নয়নে ওয়ার সিমেট্রির ছায়ায় দেয় ঝিম।

অন্য প্রান্তে তখন ফরিদপুর শহর। আম্বিকা ময়দানে কবিতা-ছড়াপাঠ থেকে সাহিত্যপাঠের ঝাঁজ নাকে এসে লাগে—নড়েচড়ে বসে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার। শব্দবাণীর মধ্য থেকে উঠে আসা অরোরা টকিজ হাত ধরে বলে, দেখো জীবনের কী বাহার! কুমারও কান পেতে থাকে, ঘাটে তার নানান আচার। কবরের ঘুমে আছেন জনক-জননী, আর প্রেম ধীরে-সুস্থে পার হয় আলীমুজ্জামান ব্রিজ।

একটি দিন তবে ভরে উঠুক নক্ষত্রের জাগরণে!

তিন.

বাকেরগঞ্জ রেঞ্জের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম ১৯৫৮ সালে। সেই থেকে বাকেরগঞ্জ শব্দটির ধ্বনিময়তা আজ অবধি বাজলেও—বরিশালও কিন্তু কম দ্যোতনার নয়। অহংকার তার আরও আছে—শস্যে, সংকল্পে, নিসর্গের শঙ্খময়তায়। জাদু জানে বরিশাল, তাই চোখ দিয়ে টান মারলেই চারপাশ ঝলমল করে ওঠে। বাদ দিই অন্য বাহু, কেবল পটুয়াখালীতে দম নিয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত গেলেই সূর্য জাগেন পুবে আর ঘুমান পশ্চিমে। দুই চোখ আর দুই দিক আলোর উৎস নিয়ে বঙ্গোপসাগরে দৌড়ঝাঁপ করে। এ যাত্রায় জীবনানন্দ না থাকলেও ছিলেন নজরুল। পটুয়াখালীতে নজরুল উৎসব।

নজরুলকে নিয়ে নানা বিবেচনা। পদ্যে নজরুল, গদ্যে নজরুল, সংগীতে নজরুল—যৌবনে নজরুল, দেশপ্রেমে নজরুল, কর্মে নজরুল, এমন কী ধর্মে নজরুল। সব হয়, কাঠি পড়ে ঢাকে। কিন্তু সেই ঢাক প্রকৃতপক্ষে কতটা বাজে, তা এখন শোনার বিষয়, দেখারও বিষয়। নানা ফাঁক-ফোকরে অঢেল মুদ্রা। পাল্লা দিয়ে ঢুকে পড়ছে বাঁশবাগানে, শামিয়ানার তলে কিংবা ওপেনটি বায়োস্কোপে। কিন্তু সেখানে চাঁদ ফোটে কি না, ঘুঙুর বাজে কি না, লাঙলের ফলায় মাটি হাসে কি না—তা দেখার বুঝি কেউ নেই!

বাঁশি দিলে হাসি ঝাঁপিয়ে পড়বে—‘আগল ভেঙে আসবে পাগল, ...’

অপেক্ষায় আছি।