নতুন আলোয় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের নতুন বই

প্রচ্ছদ: সব্যসাচী িমস্ত্রী
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী িমস্ত্রী
রক্তে আঁকা মার্চ
বাংলার মাটি যে দুর্জয় ঘাঁটি, সেটি রক্তে আঁকা এই মার্চেই বুঝে গিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। আর ১৯৭১ সালের এ মাস থেকেই ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি হয়ে উঠেছিল আমাদের। আমাদের স্বাধীন হওয়ার দিনকে সামনে রেখে এ সংখ্যার কেন্দ্রে থাকছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ।
প্রতিবছরই মুক্তিযুদ্ধের ওপর নানা ধরনের বই বেরোচ্ছে। এই আয়োজনে থাকছে সমসাময়িক কালে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নির্বাচিত পাঁচটি বইয়ের আলোচনা।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আশা ও আশাভঙ্গের দিনলিপি
সোহরাব হাসান

তিক্তমধুর বিজয়: একজন মুক্তিযোদ্ধার কাহিনি
এ কাইয়ূম খান
অনুবাদ: খোন্দকার মুনীরুজ্জামান
প্রচ্ছদ: রশিচৌধুরীচিত্র অবলম্বনে
প্রকাশক: বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ঢাকা
প্রকাশকাল: মে ২০১৮
২৭০ পৃষ্ঠা, দাম: ৬৫০ টাকা।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বয়স ৪৮ বছর। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন দেশি-বিদেশি অনেক পণ্ডিত-গবেষক-সাংবাদিক, লিখেছেন রণাঙ্গনে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধা ও সংগঠকেরা। তারপরও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা শেষ হয়নি, শেষ হবে না। এ কাইয়ূম খানের তিক্তমধুর বিজয়: একজন মুক্তিযোদ্ধার কাহিনি পড়ে মনে হলো মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে এখনো অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে। কেননা, এটি ছিল গণযুদ্ধ, কতিপয় রাজাকার–আলবদর ছাড়া দেশের সব নারী-পুরুষ কোনো না কোনোভাবে যুদ্ধে শরিক হয়েছেন। হুমায়ুন আজাদ যেমন বলেছিলেন, ‘তখন বেঁচে থাকাটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধ।’

 এ কাইয়ূম খানের তিক্তমধুর বিজয় তিনটি ভাগে বিভক্ত—মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব, রণাঙ্গনের স্মৃতি এবং যুদ্ধ–পরবর্তী আশাভঙ্গের কাহিনি। লেখকের ভাষায়, ‘এই বইয়ে আমি আমার দেখা ঘটনা ও অনুভূতির স্মৃতিচারণা করেছি। আমার প্রয়াস পাঠকের সামনে সেই সময়কার অনুভূতি ও বাস্তবতার একটি চিত্র তুলে ধরা।’

 ১৯৭১ সালের মার্চে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ২৭ মার্চ কাইয়ূম খান পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়লেও উর্দু জানার কারণে ছাড়া পান। এরপর আরও অনেকের সঙ্গে শুরু হয় তাঁর যুদ্ধজীবন। বাড়িতে শুধু একটি চিরকুট লিখলেন, ‘মাকে রক্ষা করার জন্য আমি চললাম।’

কাইয়ূমেরা প্রথমে যান আগরতলা, সেখান থেকে গুয়াহাটি হয়ে কলকাতা। অবশেষে প্রশিক্ষণ নেন মুরতি ক্যাম্পে। তাঁর পরবর্তী বর্ণনায় আসে যুদ্ধদিনের নানা অভিজ্ঞতা। তিনি লিখেছেন, কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র প্রশিক্ষণকালে পালিয়ে গেলেও গ্রামের দরিদ্র ও সাধারণ পরিবার থেকে আসা তরুণেরা প্রায় সবাই টিকে গেছেন, সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন।

৭ নম্বর সেক্টরে কমান্ডার মেজর (পরবর্তীকালে কর্নেল) নুরুজ্জামানের অধীনে কাইয়ূম যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধের বিবরণের পাশাপাশি সহযোদ্ধাদের প্রতি তাঁর সহমর্মিতার কথা অনেকবার উল্লেখ করেছেন মুক্তিযুদ্ধকালে কমিশন পাওয়া এই যোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও রসদ, আশ্রয় ও খাদ্যের সমস্যা ছিল, সেটি বড় সমস্যা ছিল না। বড় সমস্যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যকার বিরোধ। বিশেষ করে মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর বৈরিতার রেশ স্বাধীনতার পরও অনেক অঘটনের জন্ম দিয়েছে। এসব আমরা কাইয়ূমের বই থেকে জানতে পারি।

বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে কত রকমের প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে কারা কী ষড়যন্ত্র করেছিল, সেসবও উঠে এসেছে এ বইয়ে। স্মৃতিকথার আঙ্গিকে লেখা হলেও তিক্তমধুর বিজয় শুধু স্মৃতিকথায় আবৃত নয়, দেশি-বিদেশি লেখক, সাংবাদিক ও ভাষ্যকারদের নানা মন্তব্য ও বিশ্লেষণও আছে এতে।

বইয়ে কাইয়ূম সাহস করে যে কথাটি বলেছেন তা হলো, যে প্রত্যাশা নিয়ে তাঁরা যুদ্ধে করেছিলেন, স্বাধীনতার পরই তা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে থাকে একশ্রেণির রাজনীতিক ও মুক্তিযোদ্ধার সুবিধাবাদিতা এবং একদেশিকতার কারণে।

কাইয়ূম বইটি লিখেছেন ইংরেজিতে, বেশ কয়েক বছর আগে। সেটি ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিতও হয়েছিল। গেল বছর বেরিয়েছে বইটির বাংলা অনুবাদ। এটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন খোন্দকার মুনীরুজ্জামান। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর সম্পর্কে জানতে তিক্তমধুর বিজয়: একজন মুক্তিযোদ্ধার কাহিনি সহায়ক হবে। বিশেষ করে উত্তর প্রজন্মের জন্য।

 

মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধদিনের বয়ান
মুহাম্মদ লুৎফুল হক

মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধদিনের বয়ান
গেরিলা ১৯৭১
কর্নেল (অব.) তৌফিকুর রহমান
প্রচ্ছদ: শাহাবুদ্দিন আহমেদ
প্রকাশক: সময় প্রকাশন, ঢাকা প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০১৬
২৩১ পৃষ্ঠা, দাম: ৪৮০ টাকা।

গেরিলা ১৯৭১ বইয়ের লেখক কর্নেল (অব.) তৌফিকুর রহমান একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি এই বইয়ে তাঁর যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর থেকে অবরুদ্ধ ঢাকায় লেখকের কিশোর মনে যে পরিবর্তন এসেছিল, তার বর্ণনা আছে এখানে। পরে লেখক ও তাঁর বন্ধুরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। বইয়ের প্রথমাংশে আছে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময়ে লেখকের বিপৎসংকুল যাত্রার রোমাঞ্চকর বর্ণনা।

পরের অংশে তিনি উল্লেখ করেছেন মেলাঘরে তাঁর প্রশিক্ষণ গ্রহণের অভিজ্ঞতার কথা। গতানুগতিক সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাঁর বর্ণনায় প্রশিক্ষণ শিবিরের অনেক বাস্তব ও সরস বর্ণনা পাওয়া যায়। এখানে তিনি বলেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের আনন্দ-বেদনার কথা। ক্ষেত্রবিশেষে বলেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যকার হিংসা-দ্বেষের বিষয়েও। যেমন এক জায়গায় আছে, ‘প্লাটুনগুলোর মধ্যে সব সময় প্রতিযোগিতা লেগেই ছিল। অন্যান্য গ্রুপের ছেলেরা আমাদের ওপর বেশ ক্ষিপ্ত ছিল। কেননা, আমরা প্রশিক্ষণের পাঠ ও কলাকৌশল আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছিলাম ওদের তুলনায় অনেক তাড়াতাড়ি। ওই রাতে (প্রশিক্ষণের এক রাতে) ক্রুদ্ধ তরুণেরা (অন্য প্লাটুনের) আমাদের ব্যারাক ঘেরাও করে। তাঁরা বাঁশের লাঠি উঁচিয়ে আমাদের দিকে তেড়ে আসে। আর আমাদের ব্যারাকের চালে ওই বাঁশের লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকে। আমাদের হত্যার হুমকিও দেয়।’

আগস্ট মাসের শেষের দিকে যুদ্ধের উত্তাপ নেওয়ার জন্য লেখকের প্লাটুনকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দবাগ রেলস্টেশনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অংশ নেওয়ার জন্য। মন্দবাগ এলাকায় তিনি অদ্ভুত একটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন, এখানে তিনি দেখতে পান যে রাজাকারেরা মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচল ও অভিযানে আন্তরিকভাবে সাহায্য করছে। যুদ্ধের দীক্ষা গ্রহণ ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের পর চূড়ান্তভাবে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য তাঁরা আবারও মেলাঘরে ফিরে আসেন।

প্রশিক্ষণকালে মেলাঘরে লেখকের সহযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীতে পেশাগত কারণে বা অন্যকোনো কারণে বিখ্যাত হয়েছেন। সেই স্মৃতি উল্লেখ করে তৌফিক পপশিল্পী আজম খান সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমাদের মধ্যে ছিলেন আজম খান।...তিনি গাইতেন আমাদের নৈতিক মনোবল সবল রাখতে।...আজম খান আমাদের হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও মান্না দের মতো বিখ্যাত গায়কের গান গেয়ে শোনান। শোনান নিজের লেখা গানও।’

চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, ‘কোনো কোনো দিন সন্ধ্যায় আমরা শাহাবুদ্দিনের (বিখ্যাত চিত্রশিল্পী) পাশে বসে মুগ্ধ হয়ে তার ছবি আঁকা দেখতাম। সে তার নোটবুকে পেন্সিল দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে একের পর এক ছবি এঁকে চলত।...দারুণ পেন্সিল স্কেচ করত সে।’

বইটিতে লেখক যুদ্ধকালীন বেশ কিছু নথি ও ছবি সংযোজন করেছেন, যা এই গ্রন্থের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়েছে।

যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের পূর্ব অবস্থানে ফিরে গিয়েছেন, পরবর্তীতে সহযোদ্ধাদের অনেকের সঙ্গে আর কখনো সাক্ষাৎ হয়নি। বিষয়টি কর্নেল (অব.) তৌফিকুর রহমানকে বেশ পীড়া দেয়। তাই স্বাধীনতার পঁয়তাল্লিশ বছর পর তিনি তাঁর মেলাঘর ও ঢাকার সহযোদ্ধা এবং অপারেশন এলাকায় তাঁদের আশ্রয় ও অন্যান্য সহযোগিতা দিয়ে যাঁরা সাহায্য করেছিলেন, সেই সব মানুষকে খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেন। তাঁর পরিশ্রম অনেকাংশেই সফল হয়। এই বইয়ে তিনি তাঁর যুদ্ধকালীন সাথিদের অনেকের ছবি সংযোজন করেছেন।

গেরিলা ১৯৭১ নামে এই পুস্তক যেন এক মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধদিনের দিনলিপি, যা পড়লে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একাত্তরের দিনকাল।

 

অজানা একাত্তরের উজ্জ্বল উদ্ধার
পিয়াস মজিদ

’৭১-এর যুদ্ধশিশু: অবিদিত ইতিহাস
মুস্তফা চৌধুরী
প্রচ্ছদ: আবু হাসান
প্রকাশক: একাডেমিক প্রেস অ্যান্ড পাবলিশার্স লাইব্রেরি (এপিপিএল) ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৫
৪৯৮ পৃষ্ঠা, দাম: ৮০০ টাকা।

মুস্তফা চৌধুরীর ’৭১-এর যুদ্ধশিশু: অবিদিত ইতিহাস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার ক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্তস্থানীয় কাজ বললে অত্যুক্তি হবে না মোটেও। জাতীয় ইতিহাসের এক স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কলম ধরেছেন তিনি, মূলে গিয়ে অনুসন্ধান করেছেন, বাংলাদেশ ও বহির্বৈশ্বিক সূত্র ও সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন এবং পারিপার্শ্বিক-প্রাসঙ্গিক পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধশিশুর আদ্যোপান্ত তুলে ধরে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ইতিহাসের যথানির্মাণে গুরুত্ববহ একটি বইয়ের ঘাটতি পূরণ করেছেন। বইটি শুরুই হয়েছে যুদ্ধশিশুদের উদ্ধৃতি দিয়ে, যারা এই বইয়ের কেন্দ্র, যদিও বিরূপ বিশ্বে জীবনের বহু প্রান্তিকতা অতিক্রম করতে হয়েছে তাদের।

গবেষক যুদ্ধশিশুর সংজ্ঞা এবং এ–সংক্রান্ত তাত্ত্বিক বক্তব্য হাজিরপূর্বক ঢাকার ইসলামপুরে মাদার তেরেসার শিশুভবন থেকে যাত্রা করেন ১৯৭২ সালের ১৯ জুলাই ১৫ জন যুদ্ধশিশুর প্রথম দলটির কানাডার উদ্দেশে বাংলাদেশ ত্যাগের দিনে, যার নেপথ্যে ছিল ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেনের বাংলাদেশ প্রকল্প। এরপর এসব শিশুর নাম এবং কানাডীয় দত্তকগ্রাহী মা–বাবার নামঠিকানা প্রদানপূর্বক এ–সংক্রান্ত বাংলাদেশ ও কানাডার গণমাধ্যম-প্রতিক্রিয়া সংকলন করেছেন। দু–একটি কানাডীয় পত্রিকার শিরোনাম উদ্ধৃতির লোভ সংবরণ কঠিন। দ্য অটোয়া সিটিজেন-এর ২১ জুলাই ১৯৭২ সংখ্যায় লেখা হয় ‘প্রথম দর্শনে প্রেম: ১৫টি বাংলাদেশি অনাথের কানাডাতে হলো বাড়িঘর’, দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইল-এ শিরোনাম হয় ‘শুকনো ডায়াপার এবং ভালোবাসা অপার, নতুন মা-বাবা বাংলাদেশি শিশুদের অভ্যর্থনায়’।

এরপর একটি বিশদ অধ্যায়ে সেই সব শিশুর কানাডা গমন-পরবর্তী অবস্থা, তাদের বিকাশ-সমস্যা ইত্যাদির আনুপূর্ব বিবরণ দিয়েছেন গবেষক, যা গল্পকেও হার মানায়। একই সঙ্গে ডা. রবার্ট ও হেলকে ফেরির মতো মানব–মহান দম্পতির গল্প তুলে ধরেন মুস্তফা চৌধুরী, যাঁরা যুদ্ধশিশুর জীবন সুসহ করতে কানাডা থেকে ছুটে এসেছিলেন ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর দপ্তরে।

এই বইয়ের মহত্তম অংশ বোধ করি অজানা–অদেখা মা ও মাতৃভূমিকে নিবেদন করে লেখা যুদ্ধশিশুদের কবিতার সমাবেশ, যা প্রমাণ করে মা ও মাতৃভূমির প্রতি মানুষের আবেগের অতলতা। ১৯৭২ সালে ৩০ মার্চ ঢাকায় মাদার তেরেসার শিশুভবনে জন্ম নেওয়া রানী জয় মরাল তাঁর কবিতায় লেখেন:

ত্যাগ করেছিলে তুমি আমাকে

                          যখন আমি শিশু,

কেন তা জানি না আমি,

                          কখনো জানব না,

কিন্তু তুমি সারাক্ষণ থাকবে মা

                          আমার ভাবনায়,

ভালোবাসবই জেনো, যেমন

          এখনো ভালোবাসি।

...

 

জানি একদিন শেষে বদলে গেছে

                          আমার জীবন;

পেয়েছি প্রশান্তি মনে, আনন্দ অপার,

যেদিন দেখেছি লাল সূর্যের উদয়

আদিগন্ত বাংলার সবুজের ছড়ায় ছড়ায়।

(সেলিম সারোয়ার অনূদিত কবিতাটির শিরোনাম ‘নদীর সন্তান’)

আবার এরই সমান্তরালে যুদ্ধশিশুদের যেসব কানাডীয় দম্পতি দত্তক নিয়েছেন, তাঁদের গল্পও উঠে এসেছে এখানে। তাঁরা বর্ণনা করেছেন এই শিশুদের বেড়ে ওঠার আনন্দ–বেদনাময় সময় ও তাঁদের নিজস্ব লড়াই। যখন ডরোথি মরিস বাংলাদেশ থেকে আসা তাঁর দত্তকীয় শিশু ল্যারাকে (আগের নাম জরিনা) নিয়ে লেখেন এমন কবিতা, তখন ভাষা ও ভূগোলের সীমা ছিন্ন করে জ্বলজ্বল করে চিরকালীন মায়ের আবেগ:

আমার শরীরের সে অংশভাগ নয়,

আমার অস্থির সে অংশ স্থির নয়;

কিন্তু দৈব ঘটনাবলির প্রভাবে

সে আমাদের একান্ত আপনার

হে কন্যা আমাদের, ল্যারা

জন্মেছিলে উদরে নয়, হৃদয়ে আমার।

হৃদয়ের এমন অসামান্য গল্প জানতে হলে পাঠককে পড়তেই হবে মুস্তফা চৌধুরীর ’৭১-এর যুদ্ধশিশু: অবিদিত ইতিহাস;যে বই একাত্তর নামক হৃদয়নদীর বহু অজানা জলের সাক্ষাৎ দেবে আমাদের।

 

মায়ের চোখে শহীদ বদি
তানজিনা হোসেন

শহীদ বদি ও আমার একাত্তর
রওশন আরা বেগম
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯
১৪৪ পৃষ্ঠা, দাম: ৩০০ টাকা।

শহীদজননী জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলিতে শহীদ বদির কথা বেশ কয়েকবার এসেছে। ১৯৭১ সালে শহীদ রুমীর সঙ্গে তিনি ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। এত দিন হাবিবুল আলম বীরপ্রতীকের দ্য ব্রেভ হার্ট বা জাহানারা ইমামের একত্তরের দিনগুলি—এমন বইপত্তরের মধ্য দিয়েই শহীদ বদিউল আলম বীর বিক্রমকে দেখেছি আমরা। কিন্তু আলোচ্য শহীদ বদি ও আমার একাত্তর বইটির ভেতর দিয়ে আমাদের চোখে ধরা পড়ল অকুতোভয় এই যোদ্ধার আরও ঘনিষ্ঠ অবয়ব।

এটি বদির মা রওশন আরা খানমের স্মৃতিকথা। তবে বইটি কেবল একজন মায়ের ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা নয়,এটি যেন এই জাতির শ্রেষ্ঠতম সময়ের প্রতিচ্ছবি। কী নির্মোহ ভঙ্গিতেই না এক অসাধারণ মা তাঁর অসাধারণ বীর সন্তানের শৈশব থেকে মৃত্যু অবধি সব ঘটনার বর্ণনা দিয়ে চলেছেন। সেই বর্ণনার মধ্যে মিলেমিশে গেছে মার্চের উত্তাল নগরীর কথকতা, পরিবারের কিশোরগঞ্জের গ্রামে গ্রামে পালিয়ে বেড়ানোর ঘটনা, পাকুন্দিয়া আর অন্যান্য এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসরদের বীভৎস অত্যাচারের কাহিনি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এখানে বড় করে আছে এ দেশের অসম সাহসী বীর তরুণদের অবিশ্বাস্য সব প্রতিরোধের গল্প।

ছেলে ক্যাডেট কলেজে পড়তে গেলে বুক ভেঙে যাচ্ছিল যে মায়ের (ছেলেকে দূরে পাঠানো যে কী মানসিক যন্ত্রণা, সেদিন প্রথম টের পেলাম), ছেলে এয়ারফোর্সে পাইলট হতে চাওয়ায় কেঁদে আকুল হয়েছেন যিনি (করাচি থেকে ওর এয়ারফোর্সে যোগ দেওয়ার নিয়োগপত্র এল, বাসায় কান্নাকাটি, আমি কিছুতেই যেতে দেব না), সেই মা–ই অন্য রকম হয়ে গেলেন, ২৭ মার্চ ঢাকার বাসা ছেড়ে পাকুন্দিয়ায় পালানোর সময় তপন (বদির আরেক নাম) মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘সব মা-ই চায় ছেলেকে কাছে রাখতে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী যেভাবে আমাদের ওপর জুলুম করছে, যেভাবে নিরস্ত্র অসহায় মানুষকে হত্যা করছে। এ অন্যায়ের প্রতিরোধ তবে কারা করবে? কারা তাদের সমুচিত শাস্তি দেবে? রাস্তায় দেখে এলাম হলের মেয়েদের ট্রাকে করে ক্যান্টনমেন্টে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তুমি যদি দেখতে মেয়েদের সেই অসহায় করুণ অবস্থা, আতঙ্কে তাদের মুখগুলো কীভাবে শুকিয়ে গেছে, তাহলে আজ কিছুতেই আমাকে মানা করতে পারতে না, মা।’

অনার্স প্রথম বর্ষেই বদি ওরফে তপন দ্য ওয়ার্ল্ড ফ্রম ক্রেজি অ্যাঙ্গলস ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছিল, জিন্নাহ হলে তাঁর কক্ষে গিয়ে মা দেখেছেন মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলস, লেনিন, হ্যাক্সলি, সলোকভ, সমারসেট মম আর উইল ডুরান্টের বই, তপনের ইংরেজিতে লেখা ছোটগল্প তখন মাঝেমধ্যে রেডিওতে প্রচারিত হতো; সেই দারুণ মেধাবী আর স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়–পড়ুয়া ছেলে মাকে বলেছিল, দেখবে, ‘আমি রিডার্স ডাইজেস্ট-এ যখন লিখব, ২৫ হাজার টাকা করে প্রতি লেখাতে দেবে!’

সময়ের এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল একটি যুদ্ধ। আমূল পাল্টে দিয়েছিল একটি গোটা প্রজন্মকে। পাইলট নয়তো সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন দেখা তরুণ কোমরে আগ্নেয়াস্ত্র গুঁজে যোগ দিয়েছিল ক্র্যাক প্লাটুনে। জয় করেছিল সব ধরনের ভয় আর দুর্বলতা।

নানা খণ্ড খণ্ড স্মৃতিতে ভরপুর এই বইটি পড়লে মন যেমন আর্দ্র হয়, তেমনি শহীদ বদির জন্য শ্রদ্ধায় নত হয় মাথা।

 

মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আরও কিছু
জাকির তালুকদার

দাস পার্টির খোঁজে
হাসান মোরশেদ
প্রচ্ছদ: স্যাম
প্রকাশক: ঐতিহ্য, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮
১৯৮ পৃষ্ঠা, দাম: ৩৫০ টাকা।

কেন্দ্রবিন্দু জগতজ্যোতি দাস ও তাঁর সঙ্গীরা। কিন্তু এই বই থেকে যে সত্য উঠে এসেছে, তা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে পৌঁছানো এখনই যেকোনো গবেষক বা উৎসাহী সন্ধানীর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। কেননা সেই সময়কালের চিহ্নগুলো যেমন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে মানুষের মন থেকেও সেই আবেগকে মুছে ফেলার জন্য প্রয়াসের অন্ত নেই নানা মহলের।

দাস পার্টি এবং তাঁর প্রধান জগতজ্যোতি দাস বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের মানুষের চিন্তায় স্থান করে নিয়েছেন। এর প্রধান কারণ অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্ব ও আত্মদান। তবে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জগতজ্যোতি দাসকে সঠিকভাবে মূল্যায়িত বা সম্মানিত না করার অভিযোগটিও।

একাত্তরের ১৬ নভেম্বর জগতজ্যোতি দাস শহীদ হলে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদানের কথা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর জন্য বরাদ্দ করা হয় তৃতীয় পর্যায়ের খেতাব ‘বীর প্রতীক’। পরবর্তী সময়ে সরকারি গেজেটে সেটি ‘বীর উত্তম’ হয়। কিন্তু কেন তিনি ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত হলেন না, তা নিয়ে জনমনে অসন্তোষ বিরাজমান অদ্যাবধি। তাঁর এলাকার আরেক মুক্তিযোদ্ধা সিকন্দর আলী এই বইয়ের এক সাক্ষাৎকারে একেবারে উদোম করে দিয়েছেন এই বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকে, ‘যুদ্ধ শেষে ছাত্ররা চলে গেছে পড়ালেখা করতে, আমরা চলে আসছি হালচাষে আর আর্মির স্যারেরা সব পদক–টদক নিয়ে গেছেন নিজেরাই। আমাদের খবর কেউ রাখে নাই, কিন্তু যুদ্ধের সময় সব থেকে বিপদের কাজগুলো আমরাই করেছি।’ (পৃষ্ঠা ৩৬)

হাসান মোরশেদের লেখা এই বই একধরনের অ্যাডভেঞ্চারের বর্ণনা বলেও মনে হতে পারে। বইটি আসলেও অনেকটা সে রকমই। তবে এটি তিক্ত ও দুঃখবহ অ্যাডভেঞ্চার। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তীব্র আবেগ নিয়ে পথে নেমে লেখক ও তাঁর সঙ্গীরা যেসব নির্মম ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন বা শুনেছেন, সেগুলোর জন্য পাঠকও ঠিক প্রস্তুত থাকেন না। তবে যাঁরা ক্ষমতাকাঠামোর বিন্যাস সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তাঁরা জানেন যে স্বাধীনতার পর যে ধরনের পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিল, তা করা হয়নি। ফলে ক্ষমতা রয়ে গেছে স্বাধীনতাপূর্ব যুগের লোকদের বংশধরদের হাতেই। হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজের কারণে খালেকসহ রাজাকার বাহিনীকে শাস্তি দেওয়ার ‘অপরাধে’ পরবর্তীকালে এই স্বাধীন দেশে খুব খারাপ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা সুকুমার দাসকে। অপমানে-ক্ষোভে দেশত্যাগ করেছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। আর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরে সেই সময়কার বেঁচে যাওয়া রাজাকারেরা এলাকায় আনন্দমিছিল বের করে এবং মুক্তিযোদ্ধা নিরানন্দ দাসকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে।

ইতিহাসের মুখোমুখি হওয়া যে কত কঠিন, তা ফুটে ওঠে বইটির ১০৭ পৃষ্ঠায়। একজন বৃদ্ধা, ১৯৭১ সালে যিনি ছিলেন যুবতী, ক্যামেরার সামনে তিনি বলতে থাকেন তাঁর অভিজ্ঞতা: ‘ছেলের বয়স আট, তাকে মেরে ফেলল দায়ের কোপে। কোলে ছিল দুই বছরের মেয়ে, টান দিয়ে আছাড় মেরে শেষ করে দিল, স্বামীর বুকে গুলি—অনবরত রক্ত ঝরছে, সেই রক্তের ওপর দিয়ে তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে...’।

এই বর্ণনা কী শোনা যায়! এ প্রসঙ্গে লেখকের ভাষ্য,‘আমার শরীর থরথর কাঁপছে। তানিমের ক্যামেরা বন্ধ হয়ে আছে, নজরুল মাথা নিচু করে কাঁদছে। নাহ, আর নেওয়া যায় না।একবার মনে হয়, কেন এলাম এই সব ভয়ংকর সত্য জানার জন্য? এই সত্য জানার সাহস কি আছে আমাদের? ওই বয়স্ক লোক, যে তেরো বছরের কিশোর ছিল সেদিন, কিংবা এই বৃদ্ধার সামনে দাঁড়ানোর অধিকার আছে আমাদের?’

আসলেই কি অধিকার আছে আমাদের?