আলফা ও বাচ্চু ভাই

আলফা চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য আলফা চরিত্র রূপায়ণকারী আলমগীর কবির
আলফা চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য আলফা চরিত্র রূপায়ণকারী আলমগীর কবির

বেশ কিছুদিন আগে আমার সুযোগ হয় নাসির উদ্দীন ইউসুফ—আমরা যাঁকে বলি বাচ্চু ভাই—তাঁর পরিচালনায় আলফা ছবিটা দেখার। আলফা বাচ্চু ভাইয়ের তৃতীয় ছবি। তাঁর প্রথম ছবি ছিল একাত্তরের যীশু, দ্বিতীয় ছবি গেরিলা এবং তৃতীয় ছবি আলফা। তবে এই লেখা সেই অর্থে আলফা ছবিটির রিভিউ নয়, বরং বলা যেতে পারে এটা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ভাইয়ের ওপর রিভিউ। বাচ্চু ভাই আমাদের দেশে স্বাধীনতার পরে শিল্প–সংস্কৃতির অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের একজন। তাঁর সম্পর্কে আমরা প্রথমে জানি তাঁর থিয়েটার থেকে। বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের থিয়েটারের একটা নিজস্ব চেহারা, রূপ ও একে শিকড়মুখী করার ক্ষেত্রে নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও সেলিম আল দীনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাঁদের থিয়েটারচর্চা ও থিয়েটারের নিজস্ব আখ্যানরীতির ব্যবহার এবং থিয়েটারকে নিজস্ব একটা চেহারা দেওয়ার ইচ্ছা, এগুলোকে আমি স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মানুষের আত্মপরিচয় অনুসন্ধান এবং আত্মপরিচয় নির্মাণের তাগিদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাই। আর এই জায়গা থেকে দেখতে গেলে তাঁদের থিয়েটার বাংলাদেশের শিল্প–সংস্কৃতির অঙ্গনে একটা বড় প্রভাব রেখেছে এবং সেটার অনুপ্রেরণা যে শুধু থিয়েটারের কর্মীদেরকেই অনুপ্রাণিত করেছে তা নয়, আমি বিশ্বাস করি, শিল্পের অন্যান্য শাখার শিল্পকর্মী এবং শিল্পীরাও আত্মপরিচয় নির্মাণের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকতে পারেন। অন্যদের কথা জানি না, অন্তত আমি যে তাঁদের থিয়েটারের আত্মপরিচয় নির্মাণের প্রচেষ্টা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি, শিল্পচিন্তার ক্ষেত্রে এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নাই।

তো, বাচ্চু ভাই প্রথমে একাত্তরের যীশু বানালেন। আপনারা যদি একাত্তরের যীশু দেখে থাকেন, তাহলে একাত্তরের যীশুর সঙ্গে গেরিলার একটা বিস্তর পার্থক্য দেখতে পারবেন। আর গেরিলার সঙ্গে আলফার আরও বিস্তর পার্থক্য আছে।

এই যে একটা সিনেমা থেকে আরেকটা সিনেমায় যাওয়ার সময় নিজেকে বদলে ফেলার, নিজেকে নতুন করে সাজানোর চেষ্টা, এটাই কিন্তু একজন শিল্পীর কাজ। শিল্পী প্রতিটি কাজেই নিজেকে ভাঙতে চান, নিজেকে অতিক্রম করতে চান, নিজেকে দেখতে চান নতুনভাবে। এমনকি যে শিল্পী দশটি একই গল্পে বানানো একই রকম চরিত্র নিয়ে কাজ করছেন, সেখানেও দেখবেন একই গল্প এবং একই চরিত্র নিয়ে কাজ করার পরেও তিনি ভিন্ন ব্যাখ্যা তৈরি করার চেষ্টা করছেন।

কিন্তু নাসির উদ্দীন ইউসুফের ক্ষেত্রে যদি আমরা বলি, গেরিলা থেকে আলফা যেন উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুর অনিশ্চিত পথযাত্রা। গেরিলা একটা নির্দিষ্ট ন্যারেটিভ নিয়ে কাজ করে এবং অনেকটা উচ্চকিত ভঙ্গিতে কাজ করে, নিজের রাজনৈতিক বক্তব্য অনেক জোরালো এবং প্রকাণ্ডভাবে বলে। কিন্তু আলফাতে এসে নাসির উদ্দীন ইউসুফ সম্পূর্ণ উল্টোপথে হাঁটলেন। এখানে এসে তিনি যেন আর উচ্চকিত, জোরালো থাকতে চাইলেন না, হয়ে উঠলেন বিকেলের আলগা বাতাসে তিরতির করা নারকেলের পাতার মতো মৃদু। আলফার চরিত্রগুলোর বেদনাকে তিনি আঁকতে চাইলেন অনেকটা মৃদু কবিতার ভঙ্গিতে। এটা কারও ভালো লাগতে পারে, কারও আবার খারাপও লাগতে পারে। কেউ যদি একটি জমজমাট ন্যারেটিভ, জমজমাট গল্প দেখতে চান, তিনি হয়তো আশাহত হতে পারেন। তবে কেউ যদি নাসির উদ্দীন ইউসুফের নতুন ভঙ্গি, নতুন সাধনা ও নতুন নির্মাণ কী সেটা বোঝার চেষ্টা করেন, তাহলে হয়তো তিনি আনন্দ পেতে পারেন। কিন্তু একটা বিষয় চিন্তা করলে আপনি নাসির উদ্দীন ইউসুফের প্রশংসা না করে পারবেন না, সেটা হচ্ছে সাধারণত মানুষের যখন বয়স বাড়তে থাকে, তখন তার নতুন রাস্তায় হাঁটার, নতুন পথে চলার ইচ্ছা ও সাহস দুটোই কমতে থাকে। নতুন জিনিস আমরা সবচেয়ে বেশি শিখি যখন আমরা ছোট থাকি। এরপর ধীরে ধীরে আমরা বড় হতে থাকি, আমাদের অভিজ্ঞতা হতে থাকে, আমরা শিক্ষিত হতে থাকি এবং আমরা সীমিত হতে থাকি। কিন্তু শিল্পী তো নিজেকে সীমার মধ্যে বাঁধতে চাইবেন না। এই যে ষাটোর্ধ্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ভাই ষাটের অধিক বয়সে এসে পঁচিশ বছরের যুবকের মতো নতুন রাস্তায় হাঁটার চেষ্টা করলেন, নতুন ভঙ্গিতে যাওয়ার চেষ্টা করলেন, জমজমাট ন্যারেটিভের লোভ থেকে সরে গিয়ে একটা আলগা তিরতিরে ন্যারেটিভের বয়ান দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন, আমি এটার প্রশংসা না করে পারি না; এবং এটাই বাচ্চু ভাইয়ের শিল্পচিন্তা, শিল্পজীবন, শিল্পভ্রমণের উদাহরণ। তাই এই পুরোটার প্রেক্ষাপটে যদি আমি বিবেচনা করি, তাহলে দেখতে পাই যে বাচ্চু ভাই এখনো সদ্য মুক্তিযুদ্ধ করে আসা আনকোরা নতুন ছেলেটির মতোই তাঁর আশপাশকে আবিষ্কার করতে চান, এটাই তো শিল্পীর কাজ।

সব সময়ই আমি মানুষের এই নতুন পথে হাঁটার চেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। আমি মনে করি, এটাই শিল্পীর সবচেয়ে বড় কাজ। হয়তো পঁচিশটা রাস্তা, ত্রিশটা রাস্তা হাঁটা হবে, যেখান থেকে পাঁচটা রাস্তা বেরিয়ে আসবে এবং যা পরবর্তী সময়ে চমৎকার মহাসড়কে পরিণত হবে। কিন্তু আপনাকে মনে রাখতে হবে যে পঁচিশটা রাস্তা হাঁটা হয়েছে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে মহাসড়কে পরিণত হয়নি, সেই রাস্তাগুলোতে হাঁটা না হলে এই পাঁচটা রাস্তা মহাসড়কে পরিণত হতে পারত না।