করোনাক্রান্ত ডায়েরি

বিচ্ছিন্নতার কালে মনে পড়ে রফিক আজাদকে, দিলারা হাফিজ ও দুই ছেলে
বিচ্ছিন্নতার কালে মনে পড়ে রফিক আজাদকে, দিলারা হাফিজ ও দুই ছেলে

১.

আত্মঘাতী কোভিড-১৯-এর সাঁড়াশি আক্রমণে পৃথিবী যখন মৃত্যুভারাতুর বিজনতায় আচ্ছন্ন, সেই অভূতপূর্ব পৃথিবীর অভিনব এই জীবাণুযুদ্ধ দেখে হতবিহ্বল আমিসহ সমগ্র মানবকূল।
শান্তি ও আশ্রয়ের প্রতীক যে গৃহ, সেখানেই থেমে আছে আমাদের সকল অন্বেষণ, কলকাকলি, কোলাহলে মাতানো দিন-রাত্রির আরদ্ধ স্বপ্নযাত্রা। প্রার্থনার বোধিমূলেও ভয়ার্ত বিস্ময়, শঙ্কা, আতঙ্কের রাম-রাজত্ব।
সব মানুষের মতো আমিও বিপন্ন, বিষাদাক্রান্ত, অদেখা, অদৃশ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করোনাজীবাণুর ভয়ে, ভীতিতে।
প্রতিকারের কোনো ওষুধ নেই, কেবলই হাত ধোয়া পথ্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার আদেশ-নির্দেশ, মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস, সামাজিক দূরত্ব, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশনসহ কতগুলো শব্দের ভীতিকর আনাগোনা।
কিসের ভয়? কিসের ভীতি?
মৃত্যুর ভয়? না।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে অবশ্যই মনের মধ্যে অচ্ছুত এক মৃত্যুর ভয় বাস করে। যে মৃত্যুতে ভালোবাসা নেই, প্রেম নেই, সন্তান-স্বজন-প্রিয়জনের হাতের স্পর্শ নেই, সর্বশেষ বিদায়ের অশ্রুজল নেই, দৃষ্টি ফেটে রক্ত ঝরার গল্প নেই, নেই কোনো হারানোর বিজন-শূন্যতা। কেবলি আতঙ্ক আর আতঙ্ক।
মৃত্যুর সেই আতঙ্কের সুতোয় বোনা পোশাক সর্বাঙ্গে জড়িয়ে যেন বসে আছি সর্বক্ষণ। আমি কবি এক।
নিষ্ক্রমণের কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না।
মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনপুত্র অভিমুন্য রচিত চক্রব্যূহে যেন আমরাও আটকে পড়ে আছি। কিশোর বীর অভিমুন্য ও তার সহযোদ্ধার জীবনের বিনিময়ে কুরুক্ষেত্রের সে যুদ্ধ তো শেষ হয়েছিল ত্রয়োদশ দিবসে। কিন্তু কোভিড-১৯ যুদ্ধ তো চলছেই লাগাতার। ছয় মাস পার হতে চলেছে। শুরুতে চীনের উহান, এখন পৃথিবীর সর্বত্র। এ লেখা যখন লিখছি (১১ মে ২০২০),
বিশ্বজুড়ে ইতিমধ্যে ২ লাখ ৮৫ হাজার জীবনপ্রদীপ নিভে গেছে। আক্রান্তের সংখ্যাও ৪১ লাখ ৭০ হাজার। যদিও সুস্থ হয়েছে ১৪ লাখ ৭০ হাজার।
আর কত?
জন্মালে মরতে হবে, সেসব তো সবাই জানে। তবু সারাক্ষণ মনের মধ্যে, বনের বাঘ বসত করছে। কী করে তাড়াই তাকে? কোনো সুতো খুঁজে পাই না, উল্টো সুতোছেঁড়া ঘুড়ির আকুতি নিয়ে গৃহান্তরীণে ঘুরপাক খাচ্ছি কেবলই। ভাবি, কী করে বাঁচব সন্তান, পরিবার, পরিজন, প্রিয়জনদের নিয়ে।
বাঁচব তো এই প্যান্ডেমিক বা অতিমারি, মহামারির ঝাঁকিজালের জটিল গ্রন্থি থেকে? লালনের গানের একটা চরণ প্রায়ই মনের মধ্যে ঘুরে-ফিরে আসে, কখনো সুরে কখনো বেসুরো—'আমি অপার হয়ে বসে আছি, ওহে দয়াময়, পারে ল'য়ে যাও আমায়। '

(২)
যে মানুষটি পাশে থেকে দুর্মর সাহস জোগাতেন, তিনি তো কবেই ছেড়ে গেছেন। তবু তার কবিতা আমাকে ভীষণভাবে সঙ্গ দিচ্ছে এই করোনাক্রান্ত আত্মঘাতী সময়েও। নতুনভাবে পাঠ করছি তাঁকে।
জীবদ্দশায় কবি রফিক আজাদ আমাকে তাঁর কাব্য থেকে দূরে থাকতে বলতেন সব সময়, কেননা, তাঁর কবিতার কোনো ধরনের প্রভাব যেন আমার কবিতায় না বর্তায়। এক ঘরে দুই কবির বসবাস হলে এমনিতেই নানা কথা রটায় রটনাকারীরা। নিকট অতীতে দেখা গেছে, বুদ্ধদেব বসু ও প্রতিভা বসুকে নিয়েও দুর্মুখেরা নানা কথা বলেছে। আমাদের মেয়েদের জন্যে খুব দুর্ভাগ্য যে বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যুর পর প্রতিভা বসুকে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে তাঁর লেখা তিনি নিজেই লেখেন, বুদ্ধদেব বসু লিখে দেননি এত দিন।
অতীতের এই সব করুণ রসের গল্পের কারণেই মূলত আমার সযত্ন প্রয়াস ছিল কবির কবিতা পাঠ থেকে যত দূর সম্ভব দূরে থাকা। যদিও কবির সদ্য প্রসূত প্রতিটি কবিতার প্রথম পাঠক ছিলাম আমি। তবে ওই পর্যন্ত। সাহিত্যের পাতায় ছাপার অক্ষরে একবার দেখেছি হয়তো, কিন্তু তাঁর কাব্যগ্রন্থের মনোযোগী পাঠক ছিলাম না কখনো।
ইদানীং খুব গভীর মনোনিবেশে পাঠ করছি কবি রফিক আজাদের 'ক্ষমা করো বহমান হে উদার অমেয় বাতাস' কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতাটি।
বারবার পড়ছি আর ভাবছি, কী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দ্রষ্টা কবি ছিলেন তিনি! আমরা যেন তাঁকে সঠিক চিনতেও পারিনি, তাঁর ব্যাপক বিপুল ক্যানভাসের কবিতাসমূহের যথাযথ মূল্যায়নও করতে ব্যর্থ হলাম তাঁর জীবদ্দশায়। এ নিয়ে তাঁর নিজের খেদও ছিল অনেক। নিরাসক্ত, নির্মোহ এই কবিকেও মাঝেমধ্যেই অপাঙ্‌ক্তেয়বোধে কাতর হতে দেখেছি। কাব্যজলে তাঁকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু প্রবোধ মানেননি তিনি মনে-প্রাণে।
প্রকৃত কবির ভাগ্য বোধ করি এমনই হয়। তাঁর 'ভাত দে হারামজাদা' কবিতাটি নিয়ে এত বেশি হইচই, টানাটানি চলছে যে মনে হয়, রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে বিভিন্ন দল, গোষ্ঠী যে যার সুবিধামতো কবিতাটির অপব্যবহার করছে। এই সময়েও সুবিধাবাদী গোষ্ঠী বসে নেই, শুধু বাংলা নয়, হিন্দি, নেপালিসহ বিভিন্ন ভাষায় কবিতাটির নিত্যনতুন ভিডিও দেখে বিস্মিত হয়েছি। এতে মনে হয় কবি রফিক আজাদের যেন আর কোনো ভালো শিল্পোত্তীর্ণ কবিতাই নেই। অথচ জীবন ও সমাজসংলগ্ন যেসব কবিতা তাঁর রয়েছে, সেসবের অনুসন্ধানে কারও যেন কোনো আগ্রহই নেই।
তবে আশার কথা হলো, রফিক আজাদের প্রয়াণের পর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে কবির 'চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া' কাব্যগ্রন্থটি পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যায়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের এক শিক্ষক ও ছাত্রী দুজনই রফিক আজাদের কবিতার ওপর গবেষণা করছে। তথ্য উপাত্তের জন্যে তারা দুজনই আমার সঙ্গে যোগাযোগও করেছে।
এসব বিষয় নিয়ে ভাবছি এই সময়ে। তবে কবি শুধু এটুকু দেখে গেছেন যে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আহমেদ মাওলা 'রফিক আজাদ: কবি ও কবিতা' শিরোনামে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এই আনন্দটুকু পেয়ে গেছেন তিনি তাঁর জীবদ্দশায়।
তো, তাঁর কাব্যযাত্রার শুরু থেকেই পৃথিবী তথা প্রকৃতির পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। এ জন্য যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির স্বপক্ষে 'চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া'র মতো একটি অনন্য, অসাধারণ কবিতা লিখে তিনি বাংলা কাব্যজগতে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন।
কবি আমাদের এই গ্রহ থেকে চলে গেছেন বটে, কিন্তু আমাদের অত্যাচারে প্রকৃতির নিদারুণ বিপর্যয় যে ধেয়ে আসছে অচিরেই, সেই আগাম বার্তা তিনি তাঁর কবিতায় চিত্রিত করে গেছেন এক অনন্যসাধারণ দ্রষ্টা কবির অভিজ্ঞানে।
প্রকৃতি দূষণের সকল দায়ভাগ আপন স্কন্ধে তুলে নিয়ে মানব সহোদরদের পক্ষে তিনি বার বার ক্ষমা চেয়েছেন প্রকৃতি মাতার কাছে। বলা ভালো, আত্মঘাতী এই করোনা থেকে রক্ষা পেতে প্রার্থনার মতো করে প্রতিদিনই কবিতাটি আমি একবার পাঠ করে প্রকৃতি মাতার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করছি।
পাঠকদের জন্যে কবিতাটির অংশ বিশেষ উল্লেখ করছি:

ক্ষমা করো বহমান হে উদার অমেয় বাতাস

দুঃখিত ও অনুতপ্ত আমি করজোড়ে ক্ষমা চাই:
ক্ষমা করো বহমান হে উদার অমেয় বাতাস;
ক্ষমা চাই—লতাগুল্মময় বনভূমি, ক্ষমা করো—
দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ দূষিত করেছি আমি,
এই গ্রহ ব্যেপে আছে আমারই তো সহোদর সব
মানব সন্তান—আমি নিজে নিধন করেছি বৃক্ষ,
উজাড় করেছি বন; পৃথিবীর প্রিয় ফুসফুস!
সুপেয় জলের নদী বারবার করেছি দূষিত,
আহ্লাদে আমারও হাতে উঠে ঐ আসেনি কুঠার?
জলে নেমে তছনছ করিনি কি জলের সংসার?
ছিঁড়িনি দুহাতে আমি লতাগুল্ম, কচি গাছপালা?
অরণ্যের রূপ-লাবণ্য না-দেখে আমি তুচ্ছ লোভে
ভাঙিনি পাখির বাসা, হরিণ শিশুর ঘুম? আর
সচকিত করিনি কি অরণ্যের গাঢ় নীরবতা?
বিবেকের এই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অকপটে
অপরাধ স্বীকার করছি আমি সম্পূর্ণ সজ্ঞানে।
ক্ষমা চাই—আমার নিজের জন্যে, বিশ্বব্যাপী
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আমার অসংখ্য সহোদর—
দূষণে জড়িত যারা তাদের সবার হ'য়ে আজ
আমি ক্ষমা চাই, আমার নিজেরও জন্যে ক্ষমা চাই॥

দিলারা হাফিজ
দিলারা হাফিজ

২.
আমাদের দুজন সন্তানই টরন্টোপ্রবাসী। আমি বাংলাদেশ আর টরন্টো মিলিয়ে দুই দেশেই বাস করি ইদানীং।
পয়লা ফাল্গুন রফিক আজাদের জন্মদিনের উৎসব পালনের দায়িত্ববোধ থেকে এই সময়টা নিয়মিত বাংলাদেশেই থাকি। কবি পিতার এই জন্মোৎসবে উপস্থিত থাকতে প্রতিবছর অভিন্নও বাংলাদেশে উপস্থিত থাকে। 'রফিক আজাদ স্মৃতি পর্ষদ'-এর আয়োজনে পিতার জন্মোৎসবের সমূহ দায়িত্ব সে-ই কাঁধে নিয়েছে স্বেচ্ছায়। এ বছর সে কবি পিতার কবিতার অনূদিত একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে 'POEMS ON LOVE ENVIRONMENT AND OTHER DIFFICULTIES' শিরোনামে।
কবির জন্মোৎসবের দায়িত্ব, ১-২ তারিখ কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠান, ফেব্রুয়ারির বইমেলা, নিজের গ্রন্থ প্রকাশের তাড়নাবোধ—সব মিলিয়ে আমার শৈল্পিক অস্তিত্ব যে বাংলাদেশে, সেখানেই আমি বসবাস করি এই সময়টাতে, পরম আনন্দে।
এ দেশের বরফ শীতের প্রকোপে টিকতে পারি না, এ জন্য সামারটায় সন্তানদের কাছে থাকি কিছুদিন করে। একলা জীবন নানাভাবে ভাগবাটোয়ারার টোপে পড়ে কাটে। ফেব্রুয়ারি থেকেই বাংলাদেশে করোনার দামামা ঢিমেতালে শোনা যাচ্ছিল, ৮ মার্চ নারী দিবসের দিনে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হল। আমি ২৮ ফেব্রুয়ারি ১০টায় টরন্টোর পিয়ার্সন এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছাই।
এরপর ডাউন টাউনের ৭৫০ স্কয়ার ফিটের কন্ডোতে পৌঁছে মা-সন্তানের শুরু হয়ে যায় ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন। এয়ারপোর্ট থেকে নানা জেরা করে করোনা-সম্পর্কিত দুটো লিফলেট ধরিয়ে দিয়েছে। কাজেই বুঝতে পারছিলাম, এ দেশে নিয়ম-কানুনে টালবাহানা চলবে না। কানাডা আসলে প্রকৃত অর্থেই একটি মানবিক রাষ্ট্র। জাস্টিন ট্রুডো যার যোগ্য প্রধানমন্ত্রী এবং পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্যে অনুসরণীয় দৃষ্টান্তই বটে। দূর অতীতে দেখা গেছে, পৃথিবীর বহু রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের কাজে সামরিক সেনাবাহিনীকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে, কিন্তু এই প্রথম এ দেশে দেখলাম একটা হোমে একদিনে ৪৯ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মৃত্যুর কারণ অন্বেষণ এবং ওল্ডহোমে ততোধিক যত্ন ও সুরক্ষার জন্যে সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল।
দিন গুনে গুনে অবশেষে করোনার বহুবঙ্কিম ভয়-ভীতি, আতঙ্কের চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ১৪ দিনের সে অপার-কাল। কাল তো নয়, যেন কালনাগিনী বেষ্টিত অন্ধকূপে পতিত অপরাধী আমি এক। কোয়ারেন্টিন শেষ হলো বটে, কিন্তু সারাক্ষণ মৃত্যুভয়, সংশয়, সন্দেহ তো মন থেকে যাচ্ছে না দূরে। যখনই অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শুনি, ভেতরটা গুলিয়ে ওঠে।
মনে হয় মৃত্যুসখা বোধ হয় এবার ঘাড়ের কাছে শ্বাস ফেলছে। এই বোধ হয় রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হবে, 'মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান।'
আমাদের দুই সন্তান টরন্টোর ডাউন টাউনে পাশাপাশিই বাস করছে বেশ কিছুদিন। আমার ইচ্ছাতেই অভিন্ন ও অব্যয়—দুই ভাই কাছাকাছি আছে, মা হিসেবে ইচ্ছা করলেই যেন দুজনের যে কারও বাড়িতে আমি পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতে পারি।
এ জন্য অব্যয়ের কন্ডো খুব বেশি দূরে নয়। অভিন্নের সঙ্গে বেশির ভাগ সময় আছি আমি। আগে অহমকে দেখতে যেতাম সপ্তাহে ২-৩ দিন। তিনি ডেকেয়ারে যেতে শুরু করলে উইক এন্ডে যেতাম শুধু। এখন করোনা এসে সেটুকু নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে।
সেই মার্চ মাস থেকে 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম'-এ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এ দেশের কর্মকর্তা, কর্মচারীরা। প্যান্ডেমিকের কারণে অন্যদের যেখানে অফিশিয়াল কাজের চাপ কমে গেছে, সেই তুলনায় অভিন্নের কাজের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। অভিন্ন যেহেতু একটা বড় কোম্পানির পুরো কানাডার প্ল্যানিংয়ের দায়িত্ব পালন করে, সে জন্য প্যান্ডেমিকের স্থায়িত্বকাল কত দিন বা কত মাস হতে পারে, সেই অনুমান নির্ভর ২-৩ রকমের প্ল্যান করতে হচ্ছে তাকে।
প্রায়ই ১৮ ঘণ্টা কাজ করে সে। সারা দিন টেলিফোনে কথা আর কাজ, ভার্চ্যুয়াল মিটিং দিনে ৪-৫ বার। ফলে আমাকে দিনের বেশির ভাগ সময় নিঃশব্দে চুপচাপ শুয়ে-বসে, নয়তো ফেসবুকে কবিতা, ছোটখাটো দৈনন্দিনের কড়চা লিখে সময় কাটাতে হয়।
সন্তানের সঙ্গে কথা হয় খুব কম।
ঘরটাকে সারাক্ষণই অফিস অফিস মনে হয়। সন্তানও করপোরেট মেজাজে উস্কখুস্ক থাকে প্রায়শ। যেদিন রাত আটটার মধ্যে কাজ শেষ হয়, সামান্য নির্ভার থাকে, সেদিন মা-বেটায় মিলে একটা মুভি দেখি। ফিল্ম জগতের সুপার হিরো ইরফান খানের মৃত্যুর পর তার 'বিল্লু' ছবিটি দেখলাম। আমি সিনেমা জগতের ভক্ত নই, সংগীতজগৎ যত টানে সেভাবে। তবু করোনার টেনশন থেকে বাঁচতে এইসব মুভিতেও মনোযোগী হতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। টানা কোনো বই পড়ে শেষ করতে পারি না। টেলিভিশনের খবরে বেশিক্ষণ চোখ রাখতে পারি না।
কেমন এক বিপন্ন বিস্ময় তাড়িয়ে ফেরে শুধু। জীবনের কোনো উৎসব নেই, রং নেই। এ যেন এক ফেরারী জীবন যাপন করছি প্রতিদিন। কাচের জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখে কত আর সাধ মেটে?
ইতিমধ্যে কানাডায় সর্বমোট মৃত্যবরণ করেছে ৪ হাজার ৭৩০ জন। আক্রান্তের সংখ্যা ৬৭ হাজার ৯৪৬, মোট সুস্থ হয়েছে ৩০ হাজার ২২৬ জন রোগী। সর্বমোট ১০টি প্রদেশ ও ৩টি অঞ্চল নিয়ে আটলান্টিক থেকে প্যাসিফিক পর্যন্ত বিস্তৃত কানাডার ভূখণ্ড। কুইবেকের পরই দ্বিতীয় বৃহত্তম অন্টারিও প্রদেশের টরন্টো শহরে আছি আমি আপাতত সন্তানদের কাছে।
কুইবেকের পরই অন্টারিও প্রদেশ মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যানুপাতে রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। ইতিমধ্যে দুজন বাঙালিসহ মৃত্যুবরণ করেছে ১ হাজার ৫৪০জন, আক্রান্ত আছে ২০ হাজার ৭৫ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে ফিরে গেছে ১৩ হাজার ৩৯০জন রোগী। অন্যান্য দেশের তুলনায় কানাডায় মৃত্যুর হার অনেক কম এই সরকারের সংরক্ষণ নীতিমালার জন্যে। এখানে জনগণও সচেতন, সেটিও অন্যতম একটি কারণ।

গ্লাভস পরে নাতি অহমও লড়ে যাচ্ছে করোনার বিরুদ্ধে
গ্লাভস পরে নাতি অহমও লড়ে যাচ্ছে করোনার বিরুদ্ধে

৪.
ইদানীং ভার্চ্যুয়াল আড্ডার একটি জায়গা হয়েছে। প্রথমে টরন্টো থেকে মৌ মধুবন্তী ও নিউইয়র্ক থেকে কাজী জহিরুল ইসলাম মিলে এক ঘণ্টার একটি আড্ডার সূত্রপাত করেছিল। এখন সেখানে আবদুল্লাহ জাহিদ যুক্ত হয়ে 'কফি ও কবিতা' নামের আড্ডাটির ব্যপ্তি আরও বাড়িয়েছে। যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলা ভাষার কবি এবং বাংলাদেশ থেকেও অনেকে কবিতা পড়ছেন। সেখানে আমিও কবিতা পাঠে, বিভিন্ন আলোচনায় আমার মতামত রেখে নিজেকে সুস্থ, স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করছি।
এ ছাড়া কবিতার বিভিন্ন বিষয়, যেমন ছন্দ, অলংকার নিয়েও যেমন আলোচনা করছি, তেমনি কবির দায়বদ্ধতা নিয়েও তরুণ কবিদের সঙ্গে সরস আলোচনায় অংশ নিচ্ছি।
দুই সপ্তাহ আগে 'রফিক আজাদ: কবি ও কবিতা' শিরোনামে একটা আলোচনা হলো। এরপর শামসুর রাহমানকে নিয়েও অনুরূপ আলোচনা হয়েছে। এগুলো এখন ইউটিউবেও দেখা এবং শোনা যাবে 'কফি ও কবিতা' শিরোনামে। এই এক ঘণ্টা সময় যেন জীবনের দখিনা জানালা। শিল্পীজীবনের শিল্পিত বেঁচে থাকার উদ্‌যাপন যেন। ভার্চ্যুয়াল জানালা দিয়ে এখন এই পৃথিবী দেখতে হয়, পৃথিবীর মানুষ এমনকি প্রকৃতিও দেখবে হয়তো এভাবেই।
এ ছাড়া পারিবারিক যোগাযোগ তো নিয়মিত হচ্ছে। বাংলাদেশে আমার মা, ভাই-বোন সবাই রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে টরন্টোর সময় ১০ ঘণ্টার ব্যবধানে চলমান থাকে। কাজেই টরন্টোর সকাল সাড়ে ১০টা-১১টার মধ্যে মাকে প্রথম কল করি। তার সুস্থতার সংবাদ পেয়ে সুস্থির হয়ে তখন আর আর ভাই-বোন, বোনঝি, ভাগনে এবং আমার দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবীর সঙ্গে নিয়মিত কথা বলি। এ ছাড়া আনোয়ারা সৈয়দ হক, কবি রুবী রহমান, শিক্ষাবিদ মাহফুজা বেগম, ডাক্তার রওশন আরা বেগম, কবি পিয়াস মজিদের সঙ্গে কথা হয় মেসেঞ্জারে। বিভিন্ন পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে মেসেঞ্জারে লিখিত উপায়ে কথা বলি। বলা যায়, ১২টা-১টা পর্যন্ত আমি টরন্টোকে বাংলাদেশে পরিণত করি অথবা নিজেই বাংলাদেশে থাকি যেন। বিচারপতি ভাগনে আশফাকুল ইসলাম কবিতা লিখছে, নতুন কবিতা লিখেই আমাকে পাঠায়, আমিও তাকে পাঠাই। পরস্পর কমেন্ট করি কবিতা নিয়ে, বাংলাদেশের ভালোমন্দ নিয়ে। বিচারপতির মা কবি জাহানারা আরজু সম্পর্কে আমার খালাতো বোন। গুলশানের বাসায় আমার মায়ের মতোই তিনি একাকী আছেন সহায়ক কর্মীদের ছত্রছায়ায়। কল দিয়ে তারও খোঁজখবর রাখি। বয়োজ্যেষ্ঠদের নিয়েই বেশি চিন্তা হয় এখন।
এরপরও যখন পৃথিবীর বদ্ধ বাতাসে অক্সিজেন কমে আসে, দিগন্তপ্রসারী মনখারাপে হাবুডুবু খেতে থাকি, তখনো এরে-ওরে কল দিয়ে নিজের বেঁচে থাকা উদ্‌যাপন করি।
সুইজারল্যাণ্ড থেকে ছোট ভাই হাবীব সপ্তাহে এক দিন অন্তত মেসেঞ্জারের ভিডিও কল দিয়ে সবাইকে এক ফ্রেমে নিয়ে আসে। স্বদেশ-বিদেশ এক কাতারে দাঁড়িয়ে যায় তখন।

৫.
ছোট ছেলে অব্যয়ের কন্ডো সিএন টাওয়ারের খুব কাছে। নেভি ওয়ার্ফ রোডে। ওদের কন্ডোর খোলা জানালায় সিএন টাওয়ার সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে বিশ্বস্ত পাহারাদারের মতো। অহমকে জিজ্ঞেস করলে ছোট্ট তর্জনী তুলে ১৪৮ তলা সিএন টাওয়ারের উন্নত মস্তক দেখিয়ে দেয় পাকা ট্যুর গাইডের মতো। যখন তার বছরখানেক বয়স, তখন থেকে।
আমার আইসবোট রোড ধরে হাঁটাপথে মাত্র সাত মিনিটের দূরত্বের পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় অহম সন্দর্শনে। প্রায় দুই মাস হতে চলল আমি টরন্টোতে আছি, তবু ছোট অহমের বাসায় যাইনি সামাজিক দূরত্ব রক্ষার মহান সংকল্প থেকে। অব্যয়-তুলি চেয়েছে, কোয়ারেন্টিন শেষ হলেই যেন আমি ওদের বাসায় যাই, অহমের সঙ্গে খেলাধুলা করে মন ভালো রাখি। ওরা চেয়েছে খুব করে কিন্তু আমিই সাহস করিনি। অহমসোনার মতো শিশুকে নিয়ে অব্যয়-তুলির বসবাস, পাছে আমার স্পর্শে কোনো অসুখবিসুখ যেন না বাঁধে—সে দৃঢ়তা থেকে দূরে থাকি, ওদের ছুঁতেও ভয় পাই। বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার পেরিয়ে এসেছি, শত মানুষের কাছাকাছি থেকে, পাশাপাশি বসে তবেই না পাড়ি দিয়ে এসেছি এতটা পথ। কাজেই মরমে মরে থাকি, যার অন্য নাম সাবধানতা।
আমার জন্যে সন্তানেরা যেন কোনোভাবে বিপদগ্রস্ত না হয়। সর্বক্ষণ এই একই ধ্যান-জ্ঞানে বাঙালি মায়ের কৃচ্ছ্রতা সাধন করি।
এমনিতে বাইরের বাজার সরকারের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে আমার ছোট পুত্র অব্যয়। নিজের বাসার, ভাইয়ের, শাশুড়ির বাজার এনে দেয় 'কসকো গ্রোসারি শপ' থেকে। গাড়ি নিয়ে নিজে একাই যায়, বাজারগুলো নিয়ে এসে কন্ডোর নিচ থেকে কল দিলে অভিন্ন গিয়ে সেসব নিয়ে আসে। তারপর একটা একটা করে প্রতিটি আইটেম লাইসল দিয়ে মুছে তারপর ঘরে তোলে।
অব্যয়, তুলি অহম ওরা তিনজন দেখা করতে এলে আমি আর অভিন্ন ৪৫ তলা থেকে দ্রুত নিচের ইমার্জেন্সি গাড়ি পার্কিংয়ে চলে যাই, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বড়জোর ৮-১০ মিনিটে দেখা, কথা বলা শেষ করে বিদায় দিয়ে দ্রুতই ওপরে উঠে আসি।
কন্ডোতে ফিরে এসে নিজের ও মায়ের পায়ের চটির তলাসহ লাইসল দিয়ে সব মুছে ফেলে অভিন্ন নিজেই। গায়ের পোশাকও পাল্টে ফেলি যত দূর সম্ভব।
মার্চ মাস থেকে চলছে টরন্টোর লকডাউন। সরকার পার্কে যাতায়াত নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। অহেতুক ঘোরাঘুরি করতে দেখলে ৭৫০ ডলার ফাইন নির্ধারণ করে দিয়েছে। কাজেই অহমের পার্কে যাওয়া বন্ধ। অব্যয় কখনো অহমকে নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে ৫-১০ মিনিটের জন্যে।

কানাডায় আবাসের নীরব অভ্যন্তর
কানাডায় আবাসের নীরব অভ্যন্তর

৬.
অভিন্নের ওয়ার্ক ফ্রম হোমের অফিসের সময়কাল একটু একটু করে বেড়ে চলেছে। সর্বশেষ ১৫ মে থেকে অফিসে যাবার কথা বলেছিল। গতদিন জানাল জুলাইয়ের ৬ তারিখের আগে নয়। ইতিমধ্যে কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হলে তবে সকলে অফিসে গিয়ে কাজ করবে, নয়তো ফিফটি পার্সেন্ট এমপ্লোই কর্মক্ষেত্রে গিয়ে কাজ করবে, বাকিরা বাসায় বসেই কাজ করবে। এই সিস্টেমে আপাতত এখানকার অফিসগুলো অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। আগামী দিনগুলোতে মনে হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শিক্ষাদানের অনেক সিস্টেমই পাল্টে যাবে।
শুনেছি, ইংরেজি মিডিয়ামের স্কুলগুলো ইতিমধ্যেই অনলাইন এডুকেশনের পথে হাঁটছে। খুবই আশার কথা। প্রযুক্তির পথে হাঁটছি আমরা। ফেসবুক ব্যবহারে বাংলাদেশের ঢাকা দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। প্রায় আড়াই কোটি মানুষ ফেসবুকের আওতায় বাস করছে এখন। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে চলছে একই চর্চা।
করোনার আগমনে ইতিমধ্যে আমাদের জীবনযাত্রার অনেকটাই পাল্টে গেছে। এবার হয়তো জীবনের প্রত্যেক অলি-গলিও হোঁচট খাবে।
ইদানীং পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, বন্ধুবান্ধব এমনকি শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের কবি-লেখকেরা মনের বদ্ধ দুয়ার খুলে দিতে ভার্চ্যুয়াল আড্ডায় মেতে উঠেছে। এ ছাড়া উপায় নেই কোনো। শরীরের ইমিউনিটি বৃদ্ধির সঙ্গে মনের স্বাস্থ্যও তো মনের মতো রাখতে হবে।
অহমসোনার সঙ্গে প্রতিদিন একবার ভিডিওতে কথা বলি, ভিডিও স্ক্রিনে তার দি-ম-মার ছবি ভেসে উঠলেই হাই বলে হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানিয়েই দৌড়ে ছুটে গিয়ে তার খেলনাসামগ্রী, বইপত্র তুলে ধরে ধরে দেখায় আমাকে, ওইটুকুন স্ক্রিনে। কত সামগ্রী তার জমেছে, সব দেখানো চাই। আবার কখনো পিয়ানো বাজিয়ে শোনায়। এপাশ থেকে অভিন্ন তার জেঠু হাততালি দিয়ে প্রেরণা যোগায়, এই তো আমাদের জীবনযাপনের নতুন কাঠামো।

ভালো থেকো, ও আমার সোনার বাংলাদেশ।
ভালো রেখো তোমার ১৭ কোটি সন্তানকে।
১১/৫/২০২০

আইসবোট টেরেস, টরন্টো