আঠারো ভাটির বারো রকম

সুন্দরবন
সুন্দরবন

জয়মনির সুন্দর বাবু ইংরেজি জানেন। যেকোনো কথার ভেতর অবলীলায় গুজে দিতে পারেন ইয়েস, নো ও ফায়ার শব্দ। 'ফায়ার' উচ্চারণের সময় মুখটা হাসিহাসি হয়ে ওঠে। এই বিশাল জ্ঞানভান্ডারে 'থ্যাঙ্ক ইউ' শব্দ যুক্ত হয়নি। কেউ কখনো তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেনি বলেই ধারণা করি। মুখের তামাটে হয়ে যাওয়া চামড়ার তলায় চাপা ধবল রং, ঝুলে থাকা কটা চুলের নিচে বাদামি চোখের মণি।

একহারা গড়নের ছিপছিপে মানুষটার দিকে তাকালেই মনে হবে, বংশপরিচয়ে কোথাও না কোথাও পারস্যের সংযোগ আছে। বাদাবনে পর্তুগিজ থেকে মগ, নিম্নবর্গ থেকে পাঠান বহু রকম মানুষেরই আবাসের ইতিহাস। অসম্ভব নয় কোথাও এ সম্পর্কের সংযোগ। পেশায় চোর হলেও যেনতেন জিনিস চুরি করেন না সুন্দর বাবু। বিদেশি জাহাজের তেল অথবা গোলপাতা। গোলপাতা চুরি শুনে পাঠকের নাট সিঁটকে উঠতে পারে, তবে আদতে ব্যাপারটা গাছ থেকে দুটো পাতা কেটে নিয়ে হেঁটে চলে আসা নয়। এর বিশাল বড় নেটওয়ার্ক আছে। বলা হয় গোলপাতার কূপ। কূপের ভাগবাটোয়ারার হিসাব হয় বিভাগীয় শহর থেকে। সুন্দর বাবু যে চুরির কাজেই যান, তার যাত্রাপথ একটি, পশুর নদে সাঁতার।

বৈদ্যমারি বাজারে পশুর নদের উঠে আসা হাওয়ায় দুলছে বটের লাল ফল। পাখি বসছে, পাখি উড়ছে। দুপুরের জোয়ার শুরু হয়েছে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, বসতভিটার উঠোনে বাড়ছে নোনা জল। সরসর শব্দ করে আবার নামছে নামায়। এদিকের মানুষের মুখে নিচু জায়গা 'নামা'। নদীর ওপার দেখা যায় না বলে সমুদ্রের মতো মনে হয়। এ নদী আরও খানিকটা গিয়ে বঙ্গোপসাগরেই মিশেছে। বাজারের দূরে অ্যালুমিনিয়ামের পাতিলের মুখে কাপড় বা নীল জাল বাঁধা। ভেতরে বাগদার পোনা অথই। নিজের চোর পরিচয় জানান দিয়ে সুন্দর বাবু আলাপে রাজি হওয়াতে আমি বিস্মিত। আদব করে সামনে বসে বিড়ি ধরাতে পারছেন না টের পেয়ে কড়া জর্দার পান আনালাম। সুন্দরবনের 'চোর' সুন্দর বাবু আর আমি পানের মিতালি করে পশুরের হাওয়া খেতে খেতে চুরির গল্প পর্ব শুরু হলো। সে প্রাণ খোলতাই হাসি দিয়ে আঙুল তুলে দেখাল, এই পশুর, শিবশা হয়ে বঙ্গোপসাগর আর তারপরই সুন্দরবনই তার দিনরাত।


মরা পশুরের নামায়, বাইনতলার খালে ১৯৯৭ সালে দুই দল জলদস্যুর মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। এরপর হত্যা, বন মামলাসহ নানা রকম মামলায় প্রায় এক দশক কারাগারে ছিলেন সুন্দর বাবু। বের হয়ে পেটের দায়ে চুরি করেন। চুরি করতে যাওয়ার আগে পরনের লুঙ্গি মাথায় গামছার মতো বেঁধে একটা ধারালো দা ধরেন মুখে। প্রায় ১০ কিলোমিটার নদীপথ সেভাবেই সাঁতরে গেলে পেয়ে যান নদীর বাঁক। সেখানে চীন ও ভিয়েতনামের জাহাজ চলাচল পথ, আসে ইন্ডিয়ান চোরাই জিনিসপত্র। সেই জাহাজের তেল ও লোহার জিনিসপত্র চুরি করেন। লোহার শেকলগুলোর অনেক দাম, স্থানীয় ভাষায় এর নাম 'কাছি'। এই চুরির বদৌলতেই শিখেছেন কয়েকটি ইংরেজি শব্দ। যখন জাহাজের টহলদারি বেড়ে যায়, তখন গোলপাতা কাটেন। অনেক পাতা একসঙ্গে কেটে ভেলার মতো বানিয়ে ভাটার সময় ছেড়ে দেন নদীতে। সেই জোয়ার-ভাটার জন্য অপেক্ষা করতে হয় গাছের ওপর উঠে বসে। জানতে চাইলাম, এক দিনে কতখানি সাঁতার কাটতে পারেন? পানের চিপি ফেলে বললেন, প্রাণ সংশয় হলে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত সাঁতরে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও আছে। প্রাণ সংশয় মানে, কোস্টগার্ড বা বন কর্মকর্তাদের টহলদারি অথবা জলের কুমির-কামট। আর জীবনভর এই সব অভিযানের ভেতরই তিনি একদিন আবিষ্কার করেছেন, জঙ্গলে ঢাকা আশ্চর্য এক মন্দির। কালীর খালের খাঁড়ির সে মন্দির কালী না মনসার, তা সুন্দর বাবুর ঠিক জানা নেই। এই মন্দিরের কথাই আমাকে বলেছেন চাঁদপাই রেঞ্জের বন কর্মকর্তা শাহিন কবির। মাঝেমধ্যে তিনি ইঞ্জিনচালিত বোট নিয়ে একা বেরিয়ে পড়েন। কোনো কোনো দিন নদীর নেশা পেয়ে বসলে ফেরার সময়জ্ঞান থাকে না। এভাবেই একদিন তিনিও আবিষ্কার করেছেন মন্দিরটি। জিপিএসে মন্দিরের অস্তিত্ব নেই অথচ সুন্দরবনের ভেতর একটা খালের পাশে আছে এর পরিত্যক্ত অনেকখানি ভগ্নাংশ। শাহিন কবিরের মতে মন্দিরের বয়স অন্তত হাজার দুই বছর আগের হবে। কী দেখে এমন ধারণা হলো জানতে চাইলে বলেছিলেন, মন্দিরের গঠন ও ইটের ব্যবহার।


কদিন আগে পাওয়া গেল যশোরের কেশবপুরে অখণ্ডিত বৌদ্ধ বিহার। ডালিঝাড়া গ্রামে আমবাগানের নিচে আবিস্কৃত বারো শ বছর আগের এই বৌদ্ধ বিহারের সন্ধান পাওয়ায় আমরা বিস্মিত। বৌদ্ধ স্থাপনাটি শুধু বাংলাদেশের জন্য এক অনন্য আবিষ্কার নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় এলাকাতেও এত বিস্তৃত ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের বৌদ্ধ স্থাপনা দেখা যায়নি। বছরখানেক আগে সুন্দরবনের আড়পাঙ্গাশিয়া, খোলপেটুয়া নদীর কাছে ১ হাজার ২০০ বছর আগের জনবসতির স্থাপনা পাওয়া গিয়েছে। ইসমে আজম নামে এক স্থপতি খুঁজে পেয়ে জানালেন, নিত্য জোয়ার-ভাটার এ অঞ্চলে এককালে ছিল সমৃদ্ধ মানববসতি। জলের তলায় খুঁজে পাওয়া সেসব স্থাপনার ইটগুলো বলছে, এসব পাল আমলের চিহ্ন। বনের গভীরে পাওয়া গিয়েছে বসতির নিদর্শন। এই তথ্য আমাদের অবাক করেছিল সন্দেহ নেই। বিভিন্ন গণমাধ্যম ছুটে গিয়েছে সুন্দরবনে জলের তলায় আবিষ্কার হওয়া প্রাচীন নগরীর স্মারক দেখতে। যতই পৃথিবীর সভ্যতার গল্প বরাবর এমনই হোক, নিজের চোখে দেখা ও রকম উত্তাল সমুদ্রের ভেতর একটা সমৃদ্ধ নগরী-জনবসতি কল্পনা করা সহজ নয়।


আমাদের মতো সাধারণ মানুষ এই প্রাপ্তিতেই আনন্দিত। আর দূরদৃষ্টিসম্পন্নরা এই বিস্ময়ের সূত্র ধরে মানুষের সামনে নিয়ে আসেন আরও বড় বিস্ময়ের ইতিহাস। তাঁরা খুঁজে পাওয়া ছোট্ট একটি নিদর্শনের উদাহরণ থেকে আবিষ্কার করেন একটি সভ্যতার গল্প। তাদের যাপনের চালচিত্র ও সে সময়ের ভূ-রাজনীতি। বারো শ বছর আগের বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কারের ফলে মোগল আমলে স্থানীয় রাজার সুন্দরবন ইজারা নেওয়ার গল্প আরও অনেকটা নিকটের হয়ে ওঠে। আঠারো ভাটির এই দেশে শত বছর আগে এক প্রতাপশালী ইতিহাসবিদ জন্মেছিলেন, যিনি আমাদের জানিয়ে গিয়েছেন সুন্দরবনের হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের কথা। হারানো বাঙালি সংস্কৃতির এক বিশাল অধ্যায় উদ্ধার করেছেন তিনি। ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতেই বলতে চেয়েছেন, এই বাদাড়ে দুই হাজার বছর আগেও মানুষ এসেছে, হারিয়ে গিয়েছে জনবসতি। তিনি নিজেই উনিশ শতকের শেষ দিকে কাজ শুরুর আগে সংগ্রহ করতেন সুন্দরবন অঞ্চলের প্রাচীন প্রত্নতত্ত্ব।


সতীশচন্দ্র মিত্র বলছেন, এখানে সভ্যতার গল্প অষ্টম শতকের পাল বংশীয় নয়, মৌর্য ও গুপ্ত যুগের। মহাভারতীয় যুগের নারাচী পুত্র কপিলমুনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বাসুদেবের চক্রান্তে বিতাড়িত হয়ে সুদূর উপবঙ্গের খুলনা জেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সুন্দরবনের ভেতর তৈরি করেছিলেন আশ্রম। আদি হিন্দুযুগের ধেনুকর্ণের পুত্র কল্কহার পেয়েছিলেন বঙ্গভূষণ উপাধি। এই বঙ্গভূষণ বর্তমান যশোরের উত্তর অংশ। এখন যে জায়গার নাম ভূষণা। রাজা লক্ষ্মণ সেনের সময়ও ছিল ধেনুকর্ণের মন্দির। এর পরপরই ডুবে যায় এ অঞ্চল।

বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তিতে যেসব তথ্য সহজে সংগ্রহ সম্ভব, তা শত বছর আগে অকল্পনীয় ছিল। সতীশচন্দ্র মিত্র সুন্দরবন অঞ্চলের যেসব তথ্য নিদর্শন সংগ্রহ করেছেন, তা এখনো ইতিহাসবিদদের কাছে বিস্ময়ের। 'যশোহর খুলনার ইতিহাস' গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের প্রকাশ ১০৬ বছর আগে। দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম প্রকাশ শত বছরের। তাঁর মতে আঠারো ভাটির এই বাদাবন অঞ্চলের সংস্কৃতির মূলস্রোত হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মীয় ভাবধারাতেই পুষ্ট। সামনে বসে থাকা বনজীবী বনাম চোর সুন্দর বাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, বনবিবির গল্প জানেন? মুসলমানদের বনবিবি হলেও সুন্দর বাবু দোতাটানায় পড়লেন প্রশ্নে। আরও কিছুক্ষণ পানের জাবর কেটে বললেন, 'সেই সব বাওয়াল-মৌয়ালদের ব্যাপার আপা। অবস্থা বেগতিক দেখলে আমি আল্লাহ-রাসুলের নাম নিই। তবে যত রকম মানুষ, তত রকম বিশ্বাস। খালের ভেতর যে কালীমন্দির, একবার সেইখানেও আশ্রয় নিতে হইছিল বিপদে।' ধর্ম প্রসঙ্গে উদাস হলেন তিনি।


সুন্দরবনের প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতিতে এ অঞ্চলের মানুষ মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারায় কিন্তু বাঁচার স্বপ্ন হারায় না। বেঁচে থাকার তাগিদে আঁকড়ে ধরে কল্পিত দেব-দেবী, যাকে আমরা বলি লোকদেবতা। সেই দেবতাদের পূজা, সংস্কার পালনের মধ্য দিয়ে শোক সান্ত্বনা খোঁজে। প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে নিতে তারা লোকদেবতার মাহাত্ম্যকেন্দ্রিক পালাগান বানায় ও সে গানের আসর বসায়। এই আয়োজন তাদের মানসিক শক্তি দেয়। সে কারণে এ অঞ্চলের লোকদেবতাসমূহের ওপর আঞ্চলিক পরিবেশগত প্রভাব খুব স্পষ্ট। আমার সঙ্গে এতক্ষণ শান্ত হয়ে বসে থাকা বাগেরহাটের প্রতিনিধি এবার সরব হলেন, 'আপা, লোকদেবতা, পালাগান এই সব বিষয় এখানের না, লাউডোব চলেন কালকে।'


লাউডোবে সাধু বাওয়ালের বাড়ির উঠোনে বনবিবির থান। দক্ষিণ খাজুরা দিয়ে এখানে আসার পথে বনের ভেতর দেখেছি এমন আরও বেশ কয়েকটি। কোনোটি কমিউনিটির, কোনোটি বনের অধিকারে। স্থানীয় বাসিন্দারা এই থান বানিয়ে একে যত্নআত্তি করে মন্দিরের মতো রক্ষণাবেক্ষণ করেন। এক মুসলমান নারী এমন এক মন্দিরের দরজার ছোট তালা খুলে দিয়ে বললেন, 'ভেতরে গিয়ে দেখুন। ওই যে বনবিবির সামনে ছোট ছেলে, ও দুখে, আর এপাশের জন দক্ষিণ রায়। দক্ষিণ রায় হলো বনবিবির শত্রু, বুঝলেন আপা?' আমিও বুঝলাম, একস্থানের দেবতা অন্যত্র আসতে আসতে কেমন অসুর হয়ে যান। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার দিকে এখনো দক্ষিণ রায়কে রক্ষাকর্তা হিসেবে পূজা করা হয়। আমাদের অঞ্চলে দক্ষিণ রায়ের মা নারায়ণীকে কোথাও কোথাও রক্ষাকর্ত্রী হিসেবে মানলেও অধিকাংশ স্থানের মান্যে পুত্র দক্ষিণ রায় হিংস্র এক চরিত্র, যে কিনা বাঘের রূপ নিতে পারে। মুনশী খাতের প্রণীত 'বনবিবি জহুরা নামা'য় আছে এর পুরো কাহিনি। বনজীবীরা শুক্রবার বনে প্রবেশ করেন না। তাঁদের ধারণা, এই দিন বনবিবি ইবাদতে মশগুল থাকেন বলে সেদিন তিনি রক্ষা করতে আসেন না।


সাধু বাওয়ালকে জিজ্ঞেস করলাম, হিন্দু হয়ে বনবিবিকে...উত্তর দিলেন, 'তিনি বন রক্ষার দেবী। আমার বাবা বাঘ বশ করতি পারতেন। বাঘের মুখে গোলপাতা ফেইলি বইনে ঢুকি পড়তেন। কাঠ কাইটে ফিরার পথে বশ তুলি নিলি বাঘ নাড়াচাড়া দে উটত। তিনিও মানতেন বনবিবিরে, আর আমি তো কুন ছাড়। আমি তো তিনারে দেখিছি। একবার মাথার কাছে আইসে সতর্ক করিছিলেন বিপদের।' সাধু বাওয়ালের গল্পের সঙ্গে হুবহু মিলে গেল বরেন গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা 'বনবিবি উপাখ্যান' উপন্যাসের একটি অংশের বর্ণনা। আদতে মানুষের বিশ্বাস ধর্ম শুধু তার জন্মগত নয়, পরিবেশগতভাবেও যে তৈরি হতে পারে এর সবচেয়ে শক্তিশালী উদাহরণ এই আঠারো ভাটির দেশ। এমন বৈচিত্রময় বিশ্বাস, আচার, মানুষের যাপন এবং সংস্কৃতির সমন্বয় শুধু বাংলাদেশের অন্য অঞ্চল কেন, আমার দেখা অন্য ভূখণ্ডেরও আর কোথাও পাইনি। সাধু বাওয়ালের যেমন বনবিবিকে মানতে বাধা নেই, তেমনি আরেক গল্প আছে সুন্দরবনের কিংবদন্তি বাঘশিকারি আর্জান সর্দারকে নিয়ে। সতীশচন্দ্র মিত্রের পুত্র শিবশঙ্কর মিত্র তাঁর সুন্দরবন সমগ্রতে লিখেছেন, আর্জান সর্দার তাঁর জীবনের এক আবিষ্কার। এক দশকের বেশি সময় তিনি সর্দারের সঙ্গে সঙ্গে থেকেছেন। জিম করবেটের চেয়েও বড় বাঘটি আর্জান সর্দারই মেরেছিলেন বলে জানা যায়। সেই আর্জান ছোটবেলায় দেখতেন, ঘরের পাশেই এক হেঁতাল গাছের তলায় রোজ সন্ধ্যায় তাঁর মা প্রদীপ জ্বেলে দেন। গৃহস্থ বাড়ির মুসলমান বিধবা নারীর তুলসিতলার মতো একটি গাছে নিত্যদিন সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালানোর ঘটনা অবাক করে। খুলনার সেই কালিকাপুরের এক বনজীবী পরিবারের গল্প উঠে এসেছে শিবশঙ্কর মিত্রের বর্ণনায়। আর্জান সর্দারের বাবাকে সুন্দরবনের বাঘ টেনে নিয়েছিল। মুখে করে ঝুলিয়ে নেওয়ার সময় দুহাতে যা পেয়েছেন, আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন প্রাণ রক্ষায়। সেসব ছোট ছোট গাছে লেগেছিল আর্জানের বাবার রক্তের দাগ। এমনই একটা গাছ ছিল ছোট্ট ওই হেঁতাল। বনে হারানো মানুষটিকে খুঁজতে গিয়ে গাছের গায়ে রক্তের দাগ দেখে বোঝা গিয়েছিল, তাঁকে বাঘে নিয়েছে। ওরই একটা গাছ আর্জানদের বাড়িতে আনা হয়েছিল। আর্জানের মা বলেছিলেন, রোজ এই গাছে সন্ধ্যাবাতি না দিলে গুনাহ হয়। তাই একদিন সন্ধ্যায় বাতাস দেখে বাতি নিভে যাওয়ার ভয়ে কেঁপে উঠেছিল কিশোর আর্জান।


সুন্দরবনের মানুষদের ধর্মবিশ্বাসে গুরুত্বপূর্ণ অংশ পরিবেশ-প্রতিবেশ। সেখানে জন্মগত হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান পরিচয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে লৌকিক দেবতাদের উপস্থিতি। দেশভাগ যদিও সুন্দরবনের লোকসংস্কৃতিতে আঘাত এনেছে, তবু এখনো খণ্ডিত এই বনের দুই অংশেরই প্রধান প্রধান লৌকিক দেবতারা মান্যতা পান পরিবেশের সঙ্গে গুরুত্ব রক্ষা করে। মূলত পাঁচটি ভাগে তাঁদের ভাগ করা যায়। জঙ্গল দেবতা, প্রতিকূল পরিবেশে রক্ষাকারী, রোগ প্রতিরোধকারী, বাস্তুদেবতা এবং অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর কবল থেকে রক্ষাকারী দেবতা। ব্যাঘ্রবাহনা বনবিবি আর সিংহবাহনা নারায়ণী দুজনই জঙ্গলদেবী। দুজনেরই থান সুন্দরবন অধ্যুষিত অঞ্চলে নদীতীরবর্তী বট-অশ্বত্থ, বেল, পাকুড়, শ্যাওড়া বৃক্ষের তলে দেখা যায়। দুজনই পরিবেশকেন্দ্রিক ও সংস্কৃতিজাত লোকদেবতা। নারায়ণীর হাতের তিরধনুক, ঢাল-তলোয়ার নিয়ে গবেষণায় পাওয়া যায়, নিম্নগাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গে অতীতে বাইরের শত্রুর আক্রমন ও হানাদারি থেকে নিজেদের বাঁচাতে এই অঞ্চলের মানুষ জাদুবিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে কোনো এক সময়ে দেবির হাতে তুলে দিয়েছে নানা রকম অস্ত্র। এ শক্তিরই আরেক রূপ। সুন্দরবন অধ্যুষিত লোকসমাজে ব্রহ্মাপূজার প্রচলন আছে। এই ব্রহ্মা ত্রিমূর্তির অন্যতম সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা নন, ইনি লোকদেবতা ব্রহ্মা। অগ্নিভয় নিবারণ করতে ব্রহ্মাপূজা হয়।


চণ্ডী ও বদরপির হলেন প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে রক্ষাকারী দেবতা। নদী-সমুদ্রপথে মাছ-কাঠ-মধু সংগ্রহকারীরা বিপদে স্মরণ করেন তাঁদের। সুন্দরবনে লোকদেবতা কল্পনার অন্তরালে তত্ত্বকথা যা-ই থাকুক, নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক করুণ কাহিনি আছে। গঙ্গা, পদ্মা, বিদ্যা, মাতলা, রূপনারায়ণ নদীর পরিণতি বঙ্গোপসাগরে। সুন্দরবন অধ্যুষিত বঙ্গোপসাগরের মোহনা দিয়ে এসব নদীপথে বাংলার ভেতরে আসা যায়। ফলে এ অঞ্চলে নদীপথে তাই বারবার এসেছে বণিক, শত্রু ও বাসিন্দা। একসময় অধিকাংশ ঘরবাড়ি ছিল নিচু। তাই এসব প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা পেতে এখানকার মানুষের কাছে সময়ের প্রয়োজনে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তৈরি হয়েছে নানা রকম লোক দেবতা। খুলনা শহরের একপাশে আছে তিন শ বছরের পুরোনো শীতলা মন্দির। গল্প শুনলাম, একসময় এ অঞ্চল বনেরই অংশ ছিল। তখন বসন্ত হলে বাওয়াল-মৌয়ালদের পরিবারের মানুষ নদীপথে এসে অসুস্থ মানুষকে এখানে রেখে যেত সুস্থ হওয়ার আশায়। তাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সব ধর্মের মানুষই ছিল, তা নিশ্চিত বলা যায়। বর্তমান বাদাবনের কোল ঘেষে গড়ে ওঠা হিন্দু-মুসলমান গরিব চাষি ও বনজীবী মানুষের বসতি দেখে সে কথা অবিশ্বাস্য মনে হলেও ইতিহাস বলছে, দুই হাজার বছর আগে এখানে বৌদ্ধ স্থাপনা ছিল, ইংরেজ আমলে দলে দলে মানুষকে খ্রিষ্টান করেছেন পাদরিরা। আঠারোটি জোয়ার-ভাটা অতিক্রম করে একে প্রদক্ষিণ করা যায় বলে সুন্দরবনের আরেক নাম আঠারো ভাটির দেশ।


অমিতাভ ঘোষের সবশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ 'গান আইল্যান্ড'-এ মূল গল্পের শুরুই হয়েছে বাদাবনে হাঁটু কাদা ঠেলে গিয়ে হাজার বছরের পুরোনো এক মনসা দেবীর মন্দির আবিষ্কারের বর্ণনা দিয়ে। অমিতাভ ঘোষ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব প্রমাণ করতে এ বইতে প্রথমেই শরণাপন্ন হয়েছেন সুন্দরবনের, যেখানে তিনি দেখালেন নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর ভেতরের হাজার বছরের পুরোনো স্থাপনা ও জনবসতি বদলে যাওয়ার দৃশ্য। 'গান আইল্যান্ড' উপন্যাসে তিনি বাদাবনকে সংযুক্ত করতে চেয়েছেন গোটা বিশ্বের সঙ্গে। গলাকাটা পাসপোর্ট বানাতে চাওয়া মানুষগুলোর কাছে দেশের কোনো সীমানা নেই। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে মনসার অভিশাপ থেকে বাঁচতে বাংলার বন্দুক সওদাগর বেরিয়েছিলেন বাণিজ্যে। এরপর ভারত মহাসাগরে পর্তুগিজ জলদস্যুদের হাতে পড়েন তিনি। তাঁকে শিকলে বেঁধে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হয় ইলিয়াস নামে এক বণিকের কাছে। তারপর 'কড়ির দ্বীপ', 'তালমিছরির দেশে' নানা জায়গায় বাণিজ্যে যায় তারা দুজন। যেখানেই যাচ্ছিলেন, সেখানে হয় মড়ক, নয়তো অন্য দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এভাবে একদিন বাংলার বাদাবনের বন্দুক সওদাগর পৌঁছে গেলেন ভেনিসে। ভেনিস শহরে গিয়ে পড়লেন মনসার চোখে। সেখান থেকে আতঙ্কিত হয়ে দেশে ফিরে অরণ্যের ভেতর তৈরি করলেন এই থান। অমিতাভ ঘোষের উপন্যাসে সে থান বা মন্দির পাহারা দিচ্ছে রাফি নামের এক মুসলমান কিশোর। পাঁচালি, মনসার পালা, সব মিলিয়ে এই উপন্যাস প্রায় মনসামঙ্গলের আধুনিক পুনর্লিখন। 'গান আইল্যান্ড' উপন্যাসে লেখক দেখিয়েছেন, সুন্দরবনের তালপট্টি, মিছরি শব্দগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আছে সুদূর মিশরের। আর বাদাবনের ভেতর লুকিয়ে থাকা হাজার বছরের পুরোনো মনসা মন্দিরকে তিনি দেখিয়েছেন ভেনিস পর্যন্ত সংযুক্ত করে।


জলবায়ুনির্ভর সুন্দরবনের লৌকিক দেবতা, মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির ভেতর তাই মিশে যায় বারো রকম গল্প। এ অঞ্চলে আছে বৈষ্ণব সংস্কৃতির প্রভাব, আছে বাগদি ও কাওরা সম্প্রদায়ের জীবন। আমাদের নাগরিক জীবনের প্রচলিত বিশ্বাসের কাছে যা অনেকাংশেই অবিশ্বাস্য মনে হয়। আর এই সব দীর্ঘ ইতিহাস, বিশ্বাস, সংস্কৃতি নিয়ে সুন্দরবন এখনো রহস্যময়। এই রহস্যের মধ্যে আছে সুন্দর বাবু আর সাধু বাওয়ালদের যাপনের বিশ্বাসের গল্প।