ভারতীয় গণতন্ত্র ও নির্বাচনী ব্যবস্থা

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ও নির্বাচন প্রশাসন নিয়ে গবেষণার জন্য উপমহাদেশের আর তিনটি দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা ও পক্ষান্তরে নির্বাচনী প্রশাসন সম্পর্কে জানার জন্য মাত্র কয়েক দিন আগে দিল্লি সফর করে ফিরলাম। দিল্লি যাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতের নির্বাচন কমিশনের ওপর দেশটির নাগরিক সমাজ এবং বিজ্ঞজনের মতামত নেওয়া। ভারতীয় নির্বাচন কমিশন এখন যে অবস্থায় রয়েছে, তার পেছনের শক্তিগুলোর ভেতরে নাগরিক সমাজ এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা যথেষ্ট সহযোগী ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ভারতের রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদেরা। গবেষণার কাজে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক সময় কাটাতে হয়েছিল। দিল্লিতে আমাদের সাবেক রাষ্ট্রদূত তারেক করিমের উদ্যোগে স্বামী বিবেকানন্দ ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনে একটি সেমিনার ছিল এবং সেখানে আমিই ছিলাম প্রধান বক্তা। সেমিনারের বিষয় ছিল বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা। ওই আলোচনায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার সাবেক প্রধানেরা ছিলেন। আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় ভারতীয় মিশনের কয়েকজন সাবেক কর্মকর্তা এবং হাইকমিশনার পিনাক চক্রবর্তী। অনেক প্রশ্নের মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল বর্তমানের নির্বাচন কমিশন নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক।
তবে শুধু গবেষণার কাজে অনেকের সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্যই নয়, এবারের দিল্লি সফর আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আরেকটি বিশেষ কারণে। সেটা হলো ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ। ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মতো সময়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে তাঁর দপ্তরে সৌজন্য কথোপকথনের সুযোগ পাওয়া যায়। কোনো দিন কল্পনাও করিনি ভারতের মতো বিশাল দেশের প্রথম একজন খাঁটি বাঙালি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বাংলায় কথোপকথনের সুযোগ হবে। আমার মতো অতি সাধারণ মানুষের সুযোগ হওয়ার কথা নয়। তবে অনেক কিছুই অভিনব ঘটার পেছনে প্রায় সময়ই কোনো না কোনো শুভানুধ্যায়ীর সহযোগিতা থাকে। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অবশ্য সেই শুভানুধ্যায়ীর কথায় পরে আসছি।
ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে আমার কোনো পূর্বপরিচয় ছিল না বা আগে কখনো সাক্ষাৎ হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। তবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের চড়াই-উতরাই মোটামুটিভাবে যাঁরা উপমহাদেশের রাজনীতির খোঁজখবর রাখেন তাঁদের জানা রয়েছে। তাঁর আত্মজীবনীর একখণ্ড, দ্য ড্রামাটিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস বইয়ের কিছু অংশ পড়ে অভিভূত হয়েছিলাম। বইটিতে তৎকালীন পাকিস্তানের কৃষ্টি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের জন্ম সবই রয়েছে। তিনি তাঁর বই লেখা সম্বন্ধে বললেন, রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হলে এ অভিজ্ঞতার কথাও লিখবেন। ভারতের ব্যস্ততম রাষ্ট্রপতি হওয়া সত্ত্বেও প্রচুর পড়াশোনা করেন। রাষ্ট্রপতির জন্য রয়েছে বিশাল
লাইব্রেরি। তারপরও বিভিন্নজনের দেওয়া বইও তিনি পড়েন। আমি তিনটি বই নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি তা গ্রহণ করে বললেন যে বইগুলো তিনি অবশ্যই পড়বেন।
প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ নিয়ে বেশ আবেগপ্রবণ। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। শুধু মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর অবদানের জন্যই নয় বা তাঁর শ্বশুরালয় নড়াইলে হওয়ার জন্যও নয়। বাঙালিদের একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনে তাঁর অবদানের জন্যই তিনি আবেগপ্রবণ, তা নিশ্চিত হলাম। যাহোক, অনেক কথার মাঝে তিনি আমার গবেষণার বিষয় ভারতের নির্বাচন কমিশনের ওপর যা বলেছেন তাতেই প্রতীয়মান হয় যে ওই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে প্রত্যেক রাজনীতিবিদ ও সরকার নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালীভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। ভারতীয় নির্বাচন কমিশন এতটাই শক্তিশালী যে নির্বাচনকালীন তা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভূমিকা পালন করে। প্রণব মুখার্জি বলেন যে ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উত্তরোত্তর শক্তিশালী করা হয়েছে এবং সব সরকারই এসব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে সমীহ করেছে বলেই আজ বিশ্বে ভারতের গণতন্ত্র একটি উদাহরণ।
তিনি অবশ্য ভারতের নির্বাচন কমিশনকে এ পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশনের অনবদ্য ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেন।
প্রণব মুখার্জির সঙ্গে এই সৌজন্য সাক্ষাৎকারটি ছিল আমার কাছে অসাধারণ। উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই অতি অমায়িক মানুষটি কথাবার্তায়, চলনে-বলনে একজন খাঁটি বাঙালি। আমার মতো অপরিচিত মানুষের সঙ্গে যে রকম আন্তরিকভাবে কথা বললেন, তা সত্যিই মনে রাখার মতো। তিনি, বিশেষ করে, ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস, একই সঙ্গে ভারতের গণতান্ত্রিক ভিত শক্ত করতে রাজনৈতিক সংগ্রাম আর রাজনৈতিক নেতাদের দূরদর্শিতার ইতিহাস নিয়ে কথা বলেন। নির্ধারিত সময়ের অনেক বেশি সময় ধরে আমি তাঁর বক্তব্য গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। হয়তো আমার জীবদ্দশায় আর কোনো বাঙালিকে একদা ব্রিটিশ রাজের ভাইসরয় প্রাসাদ বর্তমানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে অধিষ্ঠিত হতে দেখব না। ভারতের ইতিহাসে এর আগে দিল্লিতে কোনো বাঙালি এত উঁচু আসনে উপনীত হননি। প্রণব মুখার্জি এমন একজন অমায়িক মানুষ, যাঁকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না। অনেক কম মানুষই এত উঁচু আসনে বসে আমার মতো সাধারণ মানুষকে যেভাবে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন, তা ভুলবার মতো নয়। আমাকে তাঁর মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম।
পরদিন সকালে সৌভাগ্য হয়েছিল এই ৩৪০ রুমের বিশাল ভবনটির প্রধান অংশ দেখার এবং এর জন্য ধন্যবাদ জানাই রাষ্ট্রপতির অন্যতম সহচর বর্তমানে অতিরিক্ত ব্যক্তিগত সচিব ও কংগ্রেস নেতা প্রদ্যোত গুহকে। রাষ্ট্রপতি ভবন আগে পরিচিত ছিল ভাইসরয় হাউস হিসেবে। ১৯১১ সালে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়। ব্রিটিশ স্থপতি এডউইন ল্যান্ডসার লুটিয়েনসের করা নকশা অনুযায়ী ভাইসরয় হাউসের নির্মাণ শুরু হয় ১৯১২ সালে। শেষ হয় ১৯২৯ সালে এবং ভাইসরয় লর্ড আরউইন প্রথম এই প্রাসাদের বাসিন্দা হন। এরপর ভারতবর্ষে বেশি দিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য টেকেনি।
যাহোক, আমার গবেষণার একটি উপাদান হলো নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা। নির্বাচন কমিশনের ওপর রাজনৈতিক দল ও সাধারণ ভোটারদের আস্থার সংকট হলে নির্বাচনের ফলাফল জনসাধারণ মেনে নেয় না আর তখনই গণতন্ত্রের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে। নির্বাচন কমিশনের আস্থার সংকট শুরু হয়, বিশেষ করে, আমাদের দেশে নিয়োগের পর থেকেই। এ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অন্য সময়ের নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের কারণে কমিশন প্রথম থেকে আস্থার সংকটে পড়ে। তাই নিয়োগপদ্ধতি অত্যন্ত জরুরি বিষয়। আমাদের দেশের বর্তমান এই নিয়োগপদ্ধতি নিয়ে দেশে-বিদেশেও আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো যে আমাদের সংবিধানের ১১৮ ধারায় আইন প্রণয়নের কথা থাকলেও আজও সংবিধান মোতাবেক কোনো আইন তৈরি হয়নি। অনুরূপভাবে ভারতেও একই পদ্ধতিতে আইন প্রণয়নের কথা থাকলেও সেখানেও আইন তৈরি হয়নি এবং ক্ষমতাসীন সরকারের সুপারিশেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়ে থাকেন। তবে ওই দেশের রাজনৈতিক নেতাদের প্রজ্ঞা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত শক্ত থাকার কারণে নির্বাচন কমিশন আস্থার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তেমনটা আমাদের দেশে নয়।
ভারতের রাষ্ট্রপতির একটি উক্তিই ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের ওপর ভারতীয়দের আস্থার প্রকাশ পায়। তিনি বলেছেন, নির্বাচন কমিশনারের বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণেই ভারতের গণতন্ত্রের ভিত রচিত হয়েছে এবং প্রতিবারই তেমনটি হয়।
আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীনে নিয়োজিত নির্বাচন কমিশন কেন আস্থার সংকটে পড়ে, এ প্রশ্নের সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে যে বাছাই কমিটি তৈরি হবে, তাতে নির্বাচনের শরিক বলে আখ্যায়িত রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্তি থাকলে হয়তো এই আস্থার সংকটের অবসান হবে। বর্তমানে বাছাই কমিটির গঠন নিয়ে যে বিতর্কের অবতারণা হয়েছে, তা নিরসন করার দায়িত্বও সরকারের। সে ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের বিকল্প হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে একটি বাছাই কমিটি গঠন করতে হবে। তাতে হয়তো বিতর্কের অবসান যেমন হবে, তেমনি নির্বাচন কমিশনের ওপর সবার আস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিতর্ক কখনোই কাম্য নয়।
হয়তো আমাদের গণতন্ত্রের ভিত ভারতীয় গণতন্ত্রের মতো শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে পারেনি। তবে সবটাই নির্ভর করে রাজনৈতিক দল এবং তাদের গণতান্ত্রিক মানসিকতার ওপর। এমনটাই ভারতের রাষ্ট্রপতি তাঁর দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে গর্বের সঙ্গে বলেছেন।
পরিশেষে আমার গবেষণা এবং দিল্লিতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য যে ব্যক্তির কাছে আমি কৃতজ্ঞ, তিনি হলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। তাঁর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বহুদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণেই আমার মতো অত্যন্ত সাধারণ মানুষের পক্ষে এ সাক্ষাৎ সম্ভব হয়েছে। এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে আমার গবেষণাপত্রে ভারতের অধ্যায় পরিপূর্ণতা লাভ করবে বলে আশা রাখি। আরও আশা রাখি যে আমাদের নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড় করাতে সব মত ও দলের অকুণ্ঠ সহযোগিতা থাকবে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরাও আমাদের গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থাপনা নিয়ে গর্ববোধ করতে চাই।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
[email protected]