পাহাড়ে শান্তি কত দূর?

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তি সইয়ের পর তৎ​কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে অস্ত্র তুলে দেন জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমা। ফাইল ছবি
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তি সইয়ের পর তৎ​কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে অস্ত্র তুলে দেন জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমা। ফাইল ছবি

পার্বত্য চুক্তির ১৯ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে গতকাল বৃহস্পতিবার পার্বত্য জনসংহতি সমিতির নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ফের হতাশা প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে, চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে পাহাড়িরা বিকল্প পথ নিতে বাধ্য হবে। বিকল্প পথ কী পাহাড়ি নেতা তা পরিষ্কার করে না বললেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সেটি কারও জন্য সুখকর হবে না।
২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তির ১৯ বছর পূর্তি। প্রতিবছরই এদিনটিতে আমরা সরকার ও জনসংহতি সমিতির নেতাদের পরস্পর বক্তব্য শুনি। সরকারের দাবি, চুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। পাহাড়ি নেতাদের অভিযোগ, পাহাড়িদের মূল সমস্যা যে ভূমির অধিকার, তার সুরাহা হয়নি। বৃহস্পতিবারের সেমিনারেও সন্তু লারমা বলেছেন, স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের অসহযোগিতার কারণে অনেক সমস্যা ঝুলে আছে। এমনকি চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল ভারত থেকে প্রত্যাগত পাহাড়িদের পুনর্বাসন, সেটিও অনেকাংশে কার্যকর হয়নি। এখনো অনেকে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছে।
আমরা যখন পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন হওয়া না-হওয়া নিয়ে আলোচনা করছি, তখন এর পেছনের রক্তাক্ত ইতিহাস ভুলে যাচ্ছি না। সেখানে প্রায় দুই দশক ধরে চলা সংঘাত বহু পাহাড়ি ও বাঙালির জীবন কেড়ে নিয়েছে, বহু মানুষকে উন্মূল ও উদ্বাস্তু করেছে। তার চেয়েও বেদনাবহ হলো একই দেশের দুটি জাতিগোষ্ঠী একে অপরের মধ্যে হিংসা ও ঘৃণা পুষে রাখার ঘটনা। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তি সেই অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়েছে বলেই সরকার দাবি করে। আমরা এ-ও ভুলে যাচ্ছি না যে সে সময়ে বাঙালি ও পাহাড়িদের উগ্রপন্থী অংশ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চুক্তির বিরোধিতা করেছিল। উগ্রপন্থী বাঙালি, যারা পাহাড়ের বাইরে নিজেদের মুসলমান পরিচয়কে বড় করে দেখে, তারা প্রচার চালিয়েছিল যে এই চুক্তি হলে দেশের এক-দশমাংশ ভারতের অংশ হয়ে যাবে। আর পাহাড়িদের উগ্রপন্থী অংশ চুক্তির বিরোধিতা করেছিল স্বায়ত্তশাসনের দাবি অগ্রাহ্য হওয়ার কারণে।
১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করেছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। অন্যদিকে চুক্তির জোরালো সমর্থক ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরাম, ন্যাপ, জাসদসহ বিভিন্ন বাম ও মধ্যপন্থী দলগুলো। শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সদস্যদের নিরস্ত্র করে চুক্তি সই করতে বেগ পেতে হয়েছিল জনসংহতি সমিতির নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমাকেও। কিন্তু ১৯ বছর পর এসে যখন দেখা যায়, চুক্তির মূল ধারাগুলো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির মধ্যে অন্যতম বিভাজনরেখা ছিল পার্বত্য চুক্তি। সেই বিভাজনরেখাটি মুছে যাবে, না আরও স্পষ্ট হবে, সেটি নির্ভর করবে চুক্তি বাস্তবায়ন করা না-করার ওপর।
পার্বত্য চুক্তির দুটি পক্ষ। একটি সরকার ও অপরটি জনসংহতি সমিতি। জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমার বিরুদ্ধে সরকারের যতই অভিযোগ থাকুক না কেন, এ কথা কেউ বলছেন না যে তিনি চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছেন। এমনকি সেখানে পাহাড়িদের মধ্যে চুক্তিবিরোধী বলে পরিচিত ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান সরকারের চেয়েও কঠিন। জনসংহতি সমিতি মনে করে, সরকারই এই জনসমর্থনহীন সংগঠনটি টিকিয়ে রেখেছে। আবার ইউপিডিএফের অভিযোগ, সন্তু লারমা চুক্তি সইয়ের মাধ্যমে পাহাড়িদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছেন। পাহাড়ে এখন ইউপিডিএফের সঙ্গে সরকার বা সরকারি বাহিনীর যত সংঘাত হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি হয় জনসংহতি সমিতির সঙ্গে। তারা একে অপরকে সরকারের দালাল বলে আখ্যায়িত করে। আর এসব সংঘাতের মূলে রয়েছে চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়া। পাহাড়ি নেতারা এখন বিভক্ত; কেউ সরকারের পক্ষে, কেউ সন্তু লারমার। কখন কী হয় সে নিয়ে সাধারণ পাহাড়িরা উদ্বিগ্ন।
চুক্তি সইয়ের পর সেনা-সমর্থিত দুই বছর বাদ দিলে বাকি পাঁচ বছর বিএনপি এবং ১১ বছর আওয়ামী লীগ দেশ শাসন করেছে। সে ক্ষেত্রে চুক্তি বাস্তবায়িত হলে তার কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের পাওনা আর বাস্তবায়িত না হলে তার বদনামও তাদের নিতে হবে। যুক্তির খাতিরে আমরা ধরেই নিচ্ছি যে চুক্তিবিরোধী বিএনপি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা নেয়নি। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে সেই যুক্তি মোটেই খাটে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারই পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় মুঠোফোন চালু করে, যা তথাকথিত নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে পূর্ববর্তী সরকারগুলো বন্ধ রেখেছিল। চুক্তির বিরোধিতাকারী বিএনপি এখন সংসদেও নেই, রাজপথেও নেই বা নামতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল জাতীয় পার্টি নিজের সমস্যা নিয়ে এত ব্যস্ত যে পাহাড়িদের নিয়ে তাদের ভাবার সময় নেই। আর সরকারের দুই ছোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ বরাবর চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। অতএব, এ কথা বলার সুযোগ নেই বিরোধী দলের নাশকতার জন্য পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে সরকারের ভেতরেই এমন কোনো মহল আছে, যারা চায় না চুক্তিটি বাস্তবায়িত হোক; পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরে আসুক।
সরকার দাবি করছে, পার্বত্য চুক্তির বেশির ভাগই তারা বাস্তবায়িত করছে। তাহলে গত ১৯ বছরে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে নির্বাচনটি কেন হলো না? জেলা পরিষদ নির্বাচন না হলে আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচনও করা যাচ্ছে না। চুক্তি অনুযায়ী তিন আঞ্চলিক পরিষদের প্রতিনিধিরাই আঞ্চলিক পরিষদ নির্বাচন করবেন। চুক্তিতে বলা আছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘উপজাতীয়’ এবং বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা স্থায়ী বাসিন্দা, তাঁদের নিয়ে ভোটার তালিকা হতে হবে। কিন্তু কারা স্থায়ী বাসিন্দা ও কারা সেটেলার, সেটা এখনো মীমাংসা হয়নি। সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি যে গঠন করা হয়, তা কালেভদ্রে বসলেও ফলাফল দেশবাসী জানে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার মূলে ভূমির মালিকানা বিরোধ। সেখানকার বাসিন্দারা বংশপরম্পরায় যে ভূমি ব্যবহার করে আসছেন, সেই দখলিসূত্রেই তাঁরা তার মালিক। সমতলভূমির মতো তাঁদের কোনো দলিল বা কাগজপত্র নেই। তবে আশার কথা এই ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির জন্য গঠিত ভূমি কমিশন সম্প্রতি কার্যক্রম শুরু করেছে।
দেশের বাইরে ও ভেতরে ব্যাপকভাবে নন্দিত চুক্তির বাস্তবায়ন এভাবে ঝুলিয়ে রাখলে যেকোনো সময়ে শান্ত পাহাড় অশান্ত হয়ে উঠতে পারে, যা কারও কাম্য নয়।
[email protected]