সরকারের বাকি দুই বছর

.
.

রাজনীতির কুশীলবেরা যাঁর যাঁর সুবিধামতো ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করতে ভালোবাসেন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারটির বয়স আসলে কয় বছর হলো, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে একটি বিতর্ক তোলার চেষ্টা রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী সরকার মেয়াদের তিন বছর পার করেছে। কিন্তু বিএনপির কোনো কোনো নেতা বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকার নাকি সেনাসমর্থিত সরকারেরই ধারাবাহিকতা। তবে তাঁরা এ কথা বলেন না যে সেই ধারাবাহিকতার প্রধান কুশীলব ছিলেন তাঁদেরই নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। আবার আওয়ামী লীগের নেতাদের অভিযোগ, বাংলাদেশে সব সর্বনাশের মূলে জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসন। সেটাই যদি তাঁদের উপলব্ধি হবে, তাহলে সেই সর্বনাশের অর্ধেককে কেন তাঁরা কোলে তুলে নিলেন? বিএনপির নেতারাও সামরিক শাসনের দায় এড়াতে বলে থাকেন, জিয়াউর রহমান নন, আওয়ামী লীগ নেতা খোন্দকার মোশতাকই ১৯৭৫ সালে সামরিক শাসন জারি করেছিলেন। শাব্দিক অর্থে এটি সত্য হলেও রাজনৈতিকভাবে ভুল। বিএনপি নেতাদের কথা সত্য ধরে নিলে মানতে হয় যে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিএনপির সরকারের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার নিজের সরকারকে দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করে জেনারেল এরশাদের হাতে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা তুলে দিয়েছেন।
তাই মেয়াদ বা ধারাবাহিকতার কূটচালে না গিয়েও বলা যায়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার শেখ হাসিনা গঠন করেছিলেন, সেই সরকার ১২ জানুয়ারি তিন বছর পার করেছে এবং সেই উপলক্ষে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণও দিয়েছেন। তিনি এমন সময়ে এই ভাষণ দিলেন, যখন নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন এবং আগামী নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক তোড়জোড় চলছে। প্রধানমন্ত্রী ওই ভাষণে মেয়াদান্তে নির্বাচন হবে বলে সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এটি খুব জরুরি ছিল না এ কারণে যে গত নির্বাচন বর্জনকারী দল বিএনপি কিংবা তাদের সহযোগীরাও এখন আর মনে করে না, সরকার আগাম নির্বাচন দেবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রতিপক্ষের সবকিছু খারাপ এবং নিজের সবকিছু ভালো যে ধারা আছে, জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ও তার প্রতিক্রিয়ায় তারই প্রতিফলন লক্ষ করি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে সরকারের আমলের অর্জন-অগ্রগতির কথা বলবেন, উন্নয়নের ফিরিস্তি দেবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তবে তিনি এর চেয়েও যেই গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলেছেন, তা হলো তিনি সাফল্য-ব্যর্থতা বিচারের ভার জনগণের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। আর সেই বিচারের জন্য জনগণের হাতে যে অস্ত্রটি আছে তা হলো ভোট বা নির্বাচন।
গত তিন বছরে সরকারি দলের ভাষায় সরকার ‘আশাতীত সাফল্য’ কিংবা বিরোধী দলের ভাষায় ‘সম্পূর্ণ অসফল’ যা-ই হোক না কেন, অতীতকে আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব না। তাই তাকাতে হবে ভবিষ্যতের দিকেই। মনে রাখা দরকার যে ক্ষমতাসীনেরা একটি বিষয়ে খুবই সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। অতীতে সরকারের মেয়াদ যত ঘনিয়ে আসত, রাজনীতি ততই ঝঞ্ঝাপূর্ণ ও সংঘাতমুখর হয়ে উঠত। যত সমস্যা-বিরোধ থাকুক না কেন, দুই পক্ষই রাজপথে ফয়সালা করতে চাইত। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার সেই আবহ থেকে অনেকটা মুক্ত। বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ মোটামুটি স্বস্তিদায়ক ও শান্তিপূর্ণ। এখন এই পরিবেশ আগামী নির্বাচন পর্যন্ত বজায় থাকবে কি না, সেটি নির্ভর করছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের সদিচ্ছার ওপর।
বর্তমানে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির আলোচনা সফল হওয়া তথা সবার কাছে আস্থাভাজন একটি ইসি গঠন করতে পারলে পরবর্তী দুই বছর রাজনীতি শান্ত ও সুস্থ থাকার সম্ভাবনাই বেশি, যদি না রাজনীতিসৃষ্ট মহা অঘটন না ঘটে। রাষ্ট্রপতি আলোচনার মাধ্যমে যে ইসি গঠন করবেন, তার প্রতি সব দল আস্থা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি কী করেন, আমরা তার অপেক্ষায় আছি।’
কেবল বিএনপি নয়, দেশের সব মানুষই রাষ্ট্রপতির দিকে তাকিয়ে আছে। তবে এ-ও সত্য যে রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবে কিছু করতে পারবেন কি না। সংবিধানে আইনসাপেক্ষ ইসি গঠন করার কথা আছে। এর অর্থ এই নয় যে আইন না করে এত দিন যেসব কমিশন গঠন করা হয়েছে, সেটি বেআইনি ছিল। কিংবা দ্রুত একটি আইন করে ইসি গঠন করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সমস্যাটি যতটা না আইনগত, তার বেশি রাজনৈতিক।
আমরা আইন ছাড়াই কিন্তু নব্বইয়ে এরশাদের পদত্যাগের পর তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সরকার গঠন করেছিলাম। দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো, সবার আস্থাভাজন একটি ইসি গঠন করলেই আলাদিনের চেরাগের মতো সব সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারবে না। তারপরও সবাই ইসির ওপর জোর দিয়েছেন এ কারণে যে এর মাধ্যমে সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলেছে, ইসির বিষয়ে রাষ্ট্রপতি যে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই তারা মেনে নেবে। সমঝোতা হোক বা না হোক, রাষ্ট্রপতিকে আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে নতুন ইসি গঠন করতে হবে। সেই ইসি যত শক্তিশালী ও যোগ্যই হোক না কেন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, দল ও সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সক্রিয় সহযোগিতা না পেলে তারা কোনো ভালো নির্বাচন করতে পারবে না। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাই সহযোগিতা করেছে বলেই বিদায়ী ইসি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে পেরেছে। আর সহযোগিতা না করায় উপজেলা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনগুলো কারচুপিমূলক ও সহিংস হয়েছে। বিরোধী দল বর্জন করলে দেশবাসী একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন থেকে বঞ্চিত হয়; আর সরকার অসহযোগিতা করলে নির্বাচনটিই প্রহসনে পরিণত হয়।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযাায়ী মেয়াদান্তে যে নির্বাচন হবে, তার এখনো দুই বছর বাকি। গত তিন বছর সরকার যেভাবে দেশ চালাচ্ছে, আগামী দুই বছরও কি সেভাবে চালাবে? অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের অনেক সাফল্য আছে, পদ্মা সেতুসহ অনেক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, বাজেটের আকার ও প্রবৃদ্ধি বেড়ে চলেছে। কিন্তু ব্যর্থতাও কম নয়। বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। গত কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতে যে বিশৃঙ্খলা ও লুটপাট চলেছে, তা এখনই বন্ধ করলে অর্থনীতি ফের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। তবে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে জঙ্গিবাদের উত্থান, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। কোন সরকার কত দিন ক্ষমতায় থাকল, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, সেই সরকারটি জাতি–বর্ণনির্বিশেষে সবার আস্থা কতটা অর্জন করতে পারল।
সরকারের দাবি অনুযায়ী, গত দিনের চ্যালেঞ্জগুলো খুব সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। যেমন যুদ্ধাপরাধের বিচার, জঙ্গিবাদ মোকাবিলা, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে পুরোপুরি সাফল্য এসেছে, এমনটি বলা যাবে না। সরকারের জিরো টলারেন্স সত্ত্বেও থেমে থেমেই জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা চলছে। আগে তারা গুপ্তহত্যার মধ্যে তৎপরতা সীমিত রাখলেও এখন প্রকাশ্যে হানা দিচ্ছে এবং তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হচ্ছে। এই অপশক্তিকে মোকাবিলা করতে সামরিক অভিযানের পাশাপাশি যে রাজনৈতিক, সামাজিক জাগরণ প্রয়োজন, সেটি গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে। এই বিভাজন রহিত করার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, বিএনপি ও তাদের সহযোগীরা অতীতে জঙ্গিবাদকে মদদ দিয়েছে। কিন্তু এখন তো তারা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার কথা বলছে। সরকারের উদ্দেশ্য যদি হয় জঙ্গিবাদ দমন, তাহলে যেই দলই তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে, তাদের সহযোগিতা নেওয়া উচিত। আর অতীতের ভূমিকার কারণে যদি বিএনপি পরিত্যাজ্য হয়, হুসেইন মুহম্মদের জাতীয় পার্টি কেন আদরণীয় হবে?
আগামী দুই বছর সরকারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। অন্যথায় উন্নয়নের মহাসড়ক বন্ধুর হতে বাধ্য। বিএনপি আমলের কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়। বিএনপি অতীতের ভুল বুঝতে পেরে যদি সুস্থ রাজনীতির ধারায় এসে থাকে, সরকারের উচিত হবে না সেখানে বাধা সৃষ্টি করা। আগামী নির্বাচনী পরিবেশ তো বটেই সরকারের উন্নয়ন প্রয়াস অব্যাহত রাখার স্বার্থেই বিরোধী দলকে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করতে দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বিএনপি-জামায়াত জোটের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, যারা সন্ত্রাস-নৈরাজ্য করেছে, তাদের গণ-আদালতে বিচার হবে। আমরা তাঁর এই বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে বলতে চাই, আগামী নির্বাচনই হতে পারে সেই গণ-আদালতের প্রধান হাতিয়ার।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেকোনো সরকারের জন্য শেষের সময়টি খুবই চ্যালেঞ্জপূর্ণ হয়। এই চ্যালেঞ্জ আসে দুই দিক থেকে—দলের একশ্রেণির নেতা-কর্মীর মধ্যে খাই খাই ভাবটি বেড়ে যায়। ওবায়দুল কাদের যাঁদের নাম দিয়েছেন পরগাছা ও হাইব্রিড নেতা। তাঁরা ভাবেন, ‘নগদ যা পাও, হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য থাক।’ সরকারকে শক্ত হাতেই এই পরগাছা ও হাইব্রিড নেতা-কর্মীদের মোকাবিলা করতে হবে। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি আসে বিরোধী দলের কাছ থেকে। বিএনপিকে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করতে দিলে আপাতত সেই আশঙ্কা নেই। কিন্তু তারা গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ না পেলে শেষতক রাজনীতি কোন দিকে গড়াবে, বলা কঠিন। ২০১৩-১৪ সালে নির্বাচন বানচালকারী বিএনপিকে যে পন্থায় মোকাবিলা করা গেছে, নির্বাচনে যেতে ইচ্ছুক বিএনপিকে সেটি করা না-ও যেতে পারে।
এখন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকেই ঠিক করতে হবে আগামী দুই বছর তাঁরা দেশের রাজনীতিকে কীভাবে দেখতে চান।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]