প্রবাসীদের রাষ্ট্রহীনতার ঝুঁকি

নাগরিকত্ব বিল খসড়া নিয়ে নানা মহলে প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক শুরু হয়েছে। নাগরিকত্ব ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে নতুন আইন করার লক্ষ্যে এই বিল সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা হয়। অনেকের অভিমত, এই প্রস্তাবিত আইনটি দেশের সংবিধান, জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও নারী-শিশু অধিকারের পরিপন্থী ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বিভিন্ন আলোচনা-বিতর্ক থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রবাসী ও দ্বৈত নাগরিকদের ক্ষেত্রে নাগরিক অধিকার সীমিত ও শর্তযুক্ত করা হয়েছে। নাগরিকত্ব পাওয়ার নানা সংজ্ঞা ও শর্তের জন্য নাগরিক বিভেদ তৈরি এবং প্রবাসে জন্ম নেওয়া শিশুর রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এ আইনের বহু ধারা-উপধারার অস্পষ্টতাজনিত অপব্যবহারের মাধ্যমে মানুষকে রাষ্ট্রহীন করা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। আইনের খসড়া প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় সাধারণ নাগরিক, বিশেষজ্ঞ মহল কিংবা প্রবাসী বাংলাদেশিদের মতামত গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা যায়নি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করেন। এ বিষয়ে তাঁদের মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নাগরিকত্ব আইন কেন করা হচ্ছে, সে বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষই জানে। নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তেমন কিছু প্রকাশিত হয়নি। ধরে নেওয়া যায় যে বিদ্যমান সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট ১৯৫১ এবং বাংলাদেশ সিটিজেনশিপ অর্ডার ১৯৭২-এর হালনাগাদ করা, রাষ্ট্রহীনতাসংক্রান্ত নতুন ইস্যু প্রতিরোধ, দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা ইস্যুর সমাধান এ আইনের লক্ষ্য হতে পারে। কিন্তু আইনের যে খসড়া মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেয়েছে, তা আগ্রহী মহলের নজরে আসার পরই বিপত্তি দেখা দিয়েছে। নাগরিকত্ব, দ্বৈত নাগরিকত্ব, প্রবাসে জন্ম নেওয়া শিশুর নাগরিকত্ব—এসব ইস্যু জটিল হয়ে ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনের ৬ নম্বর ধারায় প্রবাসীদের বাবা, মা, পিতামহ, মাতামহ বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণের আগে বাংলাদেশের নাগরিক হলে আবেদনসাপেক্ষে নাগরিকত্ব প্রদানের সুযোগ আছে। তবে দেশে বসবাসরত জন্মসূত্রে প্রাপ্ত নাগরিকদের তুলনায় বৈষম্যমূলক সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। প্রবাসী নাগরিকদের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, রাষ্ট্রপতি পদ, সংসদ সদস্য পদসহ যেকোনো স্থানীয় সরকার পদে নির্বাচন এবং বিচার বিভাগ ও সরকারি চাকরিতে নিয়োগের মতো নাগরিক অধিকারে বাধা আরোপ করা হয়েছে।

>খসড়া আইনে আরোপিত নাগরিকত্বের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রবাসী ও তাঁদের সন্তান-সন্ততিদের বাংলাদেশবিমুখ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে প্রবাসীদের বিপুল বিনিয়োগ, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং মেধা আমদানির সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর

আইনের খসড়ায় শিশুকে ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং তার অধিকার সুরক্ষার বিধান রাখা হয়নি। বাংলাদেশের বাইরে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে জন্মের দুই বছরের মধ্যে বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে নাম নিবন্ধন করা ও জন্ম নেওয়া দেশের জন্মসনদ লাভের শর্ত দেওয়া হয়েছে। এতে পিতা-মাতার অসচেতনতা, গাফিলতি কিংবা নাগরিক স্ট্যাটাসের ক্ষেত্রে অপেক্ষমাণ প্রবাসীর সদ্যোজাত সন্তান স্থানীয় জন্মসনদ লাভে ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়বে। এমনকি নাগরিক হওয়ার যোগ্যতার ক্ষেত্রে পিতার দোষ-ত্রুটির জন্য সন্তানের নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক শিশু সনদে প্রদত্ত শিশু অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
খসড়া আইনের ১১ ধারার মাধ্যমে বৈবাহিক সূত্রে বিদেশি নাগরিকদের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু ১৩ ধারায় জন্মসূত্রে নাগরিক ছাড়া বংশগত, দ্বৈত নাগরিকত্ব, সম্মানসূচক, দেশীয়করণ, বৈবাহিক ইত্যাদি সূত্রে প্রাপ্ত নাগরিকদের অধিকারের ক্ষেত্রে একই সীমাবদ্ধতা আরোপ করে নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ-বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন বাংলাদেশের সংবিধান সব নাগরিকের সমান অধিকার দিয়েছে এবং কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ না করার অঙ্গীকার করেছে। সংবিধানের ২৫, ২৬, ২৭, ২৮ ও ২৯ সমান নাগরিক অধিকার, রাজনীতি কিংবা সরকারি কর্মে নিয়োগে অধিকারের বিষয়গুলোর বিস্তারিত উল্লেখ আছে। জাতিসংঘ সনদ, সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ, নাগরিক ও রাজনৈতিক বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহেও সব মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা ও বৈষম্য নিরসনের অঙ্গীকার রয়েছে। এ অবস্থায় খসড়া আইনের ধারাসমূহ আন্তর্জাতিক চুক্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং আমাদের সংবিধানের পরিপন্থী।
বিদ্যমান অন্য আইন, দলিল, রায়, ডিক্রিতে যা-ই থাকুক, প্রস্তাবিত আইনকে সবকিছুর ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে খসড়ার ৩ ধারায়। নতুন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আগের ধারা ও আইনের ওপর প্রাধান্য দেওয়া স্বাভাবিক, তবে এতে আদালতের রায় ও ডিক্রির ওপরও প্রাধান্যের কথা বলা হয়েছে। এটা বিচার বিভাগের সংবিধানপ্রদত্ত ক্ষমতার ওপর একধরনের চ্যালেঞ্জের শামিল। সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হওয়ায় এর সঙ্গে সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন বাতিলযোগ্য বলে সংবিধানের ৭(২) ধারায় উল্লেখ রয়েছে। আইনের খসড়ায় নাগরিকত্বের অযোগ্যতা ও তা বাতিলের বিধানগুলোতে অস্পষ্টতা আছে। এর ফলে নাগরিকদের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশসহ প্রায় সব দেশে জনস্বার্থে আইন তৈরির ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ মহল ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ রাখা হয়। এ আইনের খসড়া তৈরির সময় এ ধরনের কিছুই করা হয়েছে বলে জানা যায়নি।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা শিক্ষা, অর্থনীতি, উন্নয়নের লক্ষ্যে বিদেশে পাড়ি জমালেও তাঁদের মন পড়ে থাকে স্বদেশে। তাঁদের শিকড় বাংলাদেশ। তাঁরা শিকড়কে ভালোবাসেন। শিকড়ের টানে দেশে ফিরে বিনিয়োগ করতে চান, প্রবাসের অর্জিত অভিজ্ঞতা দেশকে ফিরিয়ে দিতে চান, বসবাস ও নিয়মিত যাতায়াত করতে চান। খসড়া আইনে আরোপিত নাগরিকত্বের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রবাসী ও তাঁদের সন্তান-সন্ততিদের বাংলাদেশবিমুখ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে প্রবাসীদের বিপুল বিনিয়োগ, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং মেধা আমদানির সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর।
নাগরিকত্ব আইনটি প্রণয়নের শুভ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে স্বদেশি ও প্রবাসী সব বাংলাদেশির সমান স্বার্থে আইনটির খসড়া পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। সে জন্য এই খসড়া আইন বিল আকারে সংসদে উপস্থাপন করার আগে এটি সম্পর্কে প্রবাসী বাংলাদেশিসহ আগ্রহী সব নাগরিকের মতামত গ্রহণের ব্যবস্থা করা হোক।
কাজী এনায়েত উল্লাহ: প্রেসিডেন্ট, ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন। মহাসচিব, অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন।