অনেক শ্রদ্ধা, অনেক ভালোবাসা

আনিসুজ্জামান
আনিসুজ্জামান

ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান স্যারের জন্ম ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৭। তাঁর ৮০তম জন্মদিনে তাঁকে জানাই আন্তরিক ও অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। তাঁর সঙ্গে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া বহু ঘটনা স্মৃতিপটে বারবার দোল খায়। খুব সম্ভবত ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাধীনতা লাভের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাবর্তন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য ড. আজিজুর রহমান মালিক, সৈয়দ আলী আহসান, ড. শামসুল হকসহ অনেকেই। অনেকেই বক্তব্য দিয়েছেন। একসময় আনিসুজ্জামান স্যারের বক্তব্যের পালা। ছিমছাম পোশাক পরা (আজও স্পষ্ট মনে পড়ে, পরনে কালো প্যান্ট, গায়ে ধবধবে সাদা হাফহাতা টি-শার্ট) উজ্জ্বল চেহারার তরুণ ভদ্রলোকের বিনয়ী বাচনভঙ্গি, আকর্ষণীয় ও শ্রুতিমধুর বক্তব্য এতটাই ভালো লেগেছিল যে ক্যাম্পাসে স্যারের বক্তব্য থাকবে অমন অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থেকেছি বলে মনে পড়ে না। আমি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। এ এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র। আর এই হলের প্রভোস্ট আনিসুজ্জামান স্যার। প্রভোস্ট হিসেবে ছাত্রদের কল্যাণে তিনি ছিলেন সদা প্রস্তুত। ছাত্রদের খাওয়াদাওয়ার মান ঠিক আছে কি না, তারও তত্ত্ব-তালাশ করতেন। শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর ছিল অতুলনীয় স্নেহ।
আর্থিক সংকটের কারণে হল ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ছুটি শেষে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দিনে হাউস টিউটরের (বড়ুয়া স্যার) কাছে হলের পাওনা পরিশোধ করে মালামাল রিকশায় ওঠানো হচ্ছে। হৃদয়ের কোথায় যেন রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এ যে কত কষ্টের তা বলার নয়। এ এফ রহমান হল থেকে চলাচলের পাকা সড়কটি সোজাসুজি আলাওল হলের সামনে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ চওড়া সড়কে মিলিত হয়েছে। সেখানে পৌঁছানোর অল্প আগে বিপরীত দিক থেকে প্রভোস্টের গাড়ি সড়কপথে ঢুকে পড়ে। তাড়াতাড়ি রিকশাটি পাকা পথের পাশে নামিয়ে রাখা হয়। গাড়িটি ঠিক রিকশার পাশে এসে দাঁড়ায়। কাচ নামিয়ে স্যার জিজ্ঞেস করলেন, খোলার দিনে এত কিছু নিয়ে কোথায় যাচ্ছি।
উত্তরে জানালাম, ‘আমার পড়াশোনা চালানো সম্ভব হচ্ছে না, সে জন্য চলে যাচ্ছি স্যার।’ তিনি পুনরায় বললেন, ‘প্রভোস্টকে না বলে চলে যাচ্ছ?’ আমি বললাম, ‘হাউস টিউটরের কাছে পাওনা মিটিয়ে এসেছি।’
‘রিকশা ঘুরিয়ে প্রভোস্টের কক্ষে এসো’ বলেই স্যার হলের দিকে চলে গেলেন।
ঠাসাঠাসি মালামালসমেত রিকশা ঘুরিয়ে সেখানে হাজির হলাম। দেখি, স্যার টেলিফোনে ব্যস্ত। টেলিফোন রেখে আমাকে মালামাল কক্ষে রেখে এসে কথা শুনতে বললেন। ভাবলাম, প্রভোস্টের অনুমতি ছাড়া কক্ষ ছেড়ে হয়তো-বা নিয়ম ভেঙেছি। আগে নিয়ম রক্ষা করি, তারপর স্যারকে বুঝিয়ে বলব। মালামাল রেখে এসে স্যারের সামনে দাঁড়াই। তিনি জানতে চাইলেন, বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক শামসুল হকের সুপারিশে স্টাইপেন্ড পেয়েছি কি না। বিনয়ের সঙ্গে জানালাম, ওই স্টাইপেন্ডে কিছুতেই চলতে পারছি না। তিনি ড. এখলাসউদ্দীন স্যারের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ শেষে আমাকে বললেন, ‘একটি ব্যবস্থা হবে, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না, মন দিয়ে পড়াশোনা করো।’ এ কথা শুনে কী যে খুশি লেগেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ওই মুহূর্তে আমার আনন্দের অশ্রুবিন্দু দেখে হয়তো-বা স্যার কিছুটা অনুভব করেছিলেন।
মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করায় স্যারের কী যে আনন্দ! আজও তা মনে পড়ে। ১৯৮৩ সালের ‘অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান অনুষ্ঠানেও জানান দিই যে স্যারের কারণে আজ আমি কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে পদার্থবিদ্যার প্রভাষক। সেদিনও স্যার কোনো কৃতিত্ব দাবি করেননি। এটি তাঁর দায়িত্বের অংশ বলে উপদেশ দিলেন নিষ্ঠাবান ও নিবেদিত শিক্ষক হতে। তাহলেই নাকি স্যারের মনে হবে তিনি একটি সেরা কাজ করেছেন। স্যারের অনুপ্রেরণায় ৩৩ বছরের চাকরিজীবনে বহুমাত্রিক বিড়ম্বনা সত্ত্বেও স্বচ্ছতা, নৈতিকতা ও আদর্শের বোধশক্তি কখনো হারাইনি।
আজ অবসরে এসে বারবার মনে হচ্ছে, স্যার সত্যিই মহৎ কাজটিই করেছিলেন। পদোন্নতির প্রতিটি ধাপে, কোটবাড়ী উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পরিচালক হয়ে, লাকসামের নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনে মনে হয়েছে সব কৃতিত্ব স্যারের, যাঁকে অনুকরণ-অনুসরণ করেছি, যাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছি, তাঁকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। মনবসু বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষায় জাপানে যেতে প্রথম প্লেনে চড়ে মনে পড়ে ১৯৭২ সালের সেদিনের সেই দৈব ঘটনা। দু-চার মিনিট আগে-পিছে হলে দেখা হতো না। পরম করুণাময় আল্লাহর রহমতে প্রভোস্টের আচমকা সাক্ষাৎটি ছিল আমার জীবনের এক দুর্লভ মুহূর্ত। সে সময় জ্ঞানী ও ধীশক্তির ব্যক্তিরা নানা ছন্দে, নানা বর্ণে ও নানারূপে আদর্শ শিক্ষকের গুণ ও গৌরব দুটিই রক্ষা করতেন। তাঁরা কখনো কিছু চাননি, প্রত্যাশাও করেননি, কিন্তু দিয়েছেন হৃদয়-মন উজাড় করে।
দেশবরেণ্য অনন্য প্রতিভাবান, গুণে-মানে কীর্তিমান, প্রবন্ধকার, গবেষক, অনুবাদক, লেখক, সাহিত্যিক আনিসুজ্জামান স্যারকে প্রভোস্ট হিসেবে ও অভিভাবক হিসেবে পেয়ে আজ অবসরে তাঁকে নিয়ে গর্ববোধ করি। সেই সঙ্গে সব স্যারের স্মৃতি রোমন্থন করি।
জন্মদিনে স্যারকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই এবং সেই সঙ্গে মহান আল্লাহর কাছে তাঁর সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
মো. হারুনুর রশীদ: সাবেক অধ্যক্ষ, নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ এবং সাবেক পরিচালক, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, কোটবাড়ী, কুমিল্লা।