আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসে নৃত্যভাবনা

শরীর, ছন্দ, আত্মা, মন, সংগীত—এসব নিয়ে নান্দনিক ছন্দিত শরীরী প্রতিমাই হলো নৃত্য। কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পী মার্থা গ্রাহাম বলেছেন, নৃত্য হলো লুকিয়ে থাকা আত্মার ভাষা। পণ্ডিত বিরজু মহারাজ বলেছেন, নৃত্য হলো প্রকৃতি। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শুনলেই বোঝা যায়, সে তার নিজস্ব ছন্দে নাচছে। শাস্ত্রীয় নৃত্য ও সংগীত মিলে মন ও আত্মার মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করে। নৃত্য খুব সহজেই সবার কাছে পৌঁছায় ও গ্রহণযোগ্যতা পায়। নৃত্যের মাধ্যমে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়, মানুষে মানুষে বিনিময় ঘটে, কথা হয়। নৃত্য এমনই একটা মাধ্যম, যা আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে একটা আকৃতি দেয়, যা প্রত্যেকের ব্যক্তিক-অভিব্যক্তির জন্যও প্রয়োজনীয়। দুঃসময়ে-দুর্দিনে নৃত্য ও অন্যান্য উপস্থাপন-কলা মানুষের মধ্যে আনন্দ বিতরণ করে, যা আমাদের সত্তার ও সময়ের পরিচয় ঘটায়।
এ বছর আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের ‘বাণী’ রচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী নৃত্যশিল্পী, কোরিওগ্রাফার ও নির্দেশক ট্রিশা ব্রাউন। দুঃখের বিষয় এই যে এই প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী, কোরিওগ্রাফার ও নৃত্যশিল্পী তাত্ত্বিক ট্রিশা ব্রাউন দীর্ঘ রোগভোগের পর এ বছর মার্চের ১৮ তারিখে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। এ সময়ের একজন অত্যন্ত সম্মানিত, স্বীকৃত, প্রভাবশালী নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার ট্রিশা ব্রাউনের নৃত্যকর্মে সৃজনশীল শিল্পের গতিধারায় এক নতুন পথের সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁর চলে যাওয়া, নৃত্যশিল্পের ও উপস্থাপনকলার ক্ষেত্রে এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁকে নৃত্যপ্রেমী ও উপস্থাপন-কলাপ্রেমীরা কখনো ভুলতে পারবে না। বিশ্ব নৃত্যাঙ্গনের এবং আইটিআইয়ের সবাই এই অসাধারণ নৃত্যশিল্পীর মৃত্যুতে ব্যথিত ও শোকস্তব্ধ।
আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস ২০১৭-তে ট্রিশা ব্রাউনের বাণীটির মর্মার্থ এমনই, উড়বার ইচ্ছা থেকেই আমার নৃত্যশিল্পী হওয়া। ভরের সীমাকে অতিক্রম করে যাওয়ার ব্যাপারটি আমাকে সব সময়ই তাড়িত করত। আমার নৃত্যের গোপন অর্থ নেই। এই নৃত্য হলো শরীরী ভঙ্গিতে আধ্যাত্মিকতার চর্চা। নৃত্য চিরন্তন যোগাযোগের ভাষাকে আরও গতিময় করে ও তার বিস্তৃতি ঘটায়। তার মধ্যে যোগ করে আনন্দোচ্ছ্বাস। তৈরি করে নান্দনিক সৌন্দর্য এবং তা মানবিক জ্ঞানকে এগিয়ে নেয়। নৃত্য হচ্ছে সৃজন—কী চিন্তায়, কী নির্মাণে, রচনায়, কর্মে ও উপস্থাপনায়। আমাদের শরীর অভিব্যক্তি প্রকাশের যন্ত্র, কিন্তু প্রতিনিধিত্ব করার মাধ্যম নয়। এই ধারণা থেকেই নতুন সৃষ্টির জন্ম। নতুন শিল্পনির্মাণের এগুলোই প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও উপকরণ।
বয়সের সঙ্গে একজন শিল্পীর জীবন শেষ হয়ে যায় না। যদিও কোনো কোনো সমালোচক সেটাই বিশ্বাস করেন। নৃত্য তৈরি হয়েছে মানুষের দ্বারা, মানুষ ও তার ভাবনার দ্বারা। একজন দর্শক হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার এই সৃজনশীল শক্তিকে আপনি সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন এবং তাকে আপনার নিত্যদিনের কাজে লাগাতে পারেন।
আমাদের দেশে প্রচলিত একটা ধারণা আছে যে বয়স বাড়লে শিল্পীর জীবনও শেষ হয়ে গেল। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সময়, চর্চা, অভিজ্ঞতা, বোধ-উপলব্ধি যত ঋদ্ধ হবে, নৃত্যের অভিব্যক্তিও তত সুন্দর হবে। আমাদের দেশের দর্শক, ভোক্তা, সরকার, রাজনীতিবিদ—সবাইকেই এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই নৃত্যশিল্পের উন্নতি ঘটবে এবং নৃত্যশিল্পীও সম্মান ও মর্যাদা ফিরে পাবে।
আইটিআই ও ইন্টারন্যাশনাল ড্যান্স কমিটি ১৯৮২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস পালন শুরু করে। বাংলাদেশেও প্রতিবছর আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস পালন করে থাকে বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা ও অন্যান্য নৃত্য সংগঠন। এই দিবসটি পালন করা হয় ২৯ এপ্রিল ক্ষণজন্মা নৃত্যশিল্পী জাঁ-জর্জ-নভেরার (১৭২৭-১৮১০) জন্মদিনকে মনে রেখে।
সারা পৃথিবীতে নানান অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই দিনটি পালিত হয়। নৃত্য মানুষের সম্মিলন ঘটায় তার পরিচিত ভাষা দিয়ে। নৃত্যের আনন্দ বিনিময় ঘটে দর্শকদের মধ্যে, তার বোধ-উপলব্ধিকে সচেতন করার জন্য। এই শিল্পের উন্নয়নে পৃথিবীর সর্বত্র নৃত্যের বিভিন্ন ভঙ্গি ও আঙ্গিক দিয়ে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস পালিত হচ্ছে। আজকের এই দিনে এই প্রাচীন কলাটির চিরায়ত ঐতিহ্য স্মরণ করি, সবাইকে কাছে টানার এবং একত্রকরণের অসম্ভব শক্তিকে সাদরে বরণ করে নিই। আজকের এই দিনে যাঁরা নৃত্যের সৌন্দর্য ও এর অন্তর্নিহিত শক্তিকে বুঝতে পেরেছেন, ভালোবেসেছেন, তাঁদের সবার জন্য আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের শুভেচ্ছা রইল।
শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়: নৃত্যশিল্পী, নৃত্যনন্দনের পরিচালক।