মূর্তি ও ভাস্কর্যবিষয়ক বিড়ম্বনা

সম্প্রতি রাষ্ট্র নামের বহুতল ভবনের সর্বোচ্চ তলায় ঘটে যাওয়া কিছু অত্যাশ্চর্য ঘটনায় আমাদের মতো মাঝতলার বাসিন্দাদের বিস্ময় ও মর্মপীড়ার ঘোর যখন কাটেনি, তখন এর মধ্যে ভাস্কর্যবিষয়ক কিছু গোলমেলে কথাবার্তা এতে আরও রসদ যোগ করেছে। হেফাজতের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সরকারের সম্পর্ক যখন আকস্মিক গলাগলিতে পরিণত হয়েছে, তখন হেফাজতের ১৩ দফা দাবিও, যার প্রতিটি দফা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর মূল্যবোধের সরাসরি পরিপন্থী, একদিন সঠিক বাংলাদেশের দিগ্‌দর্শন হিসেবে প্রশংসিত হবে না, এমন কথা আজ আর কেউ হলফ করে বলতে পারবেন না। রামপাল ও হেফাজত প্রশ্নে সরকারের আপসহীন দৃঢ়তা একদিন হয়তো উদাহরণ হিসেবে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে স্থায়ী আসন লাভ করবে।

তবে আমাদের বিবেচনা রামপাল বা হেফাজত নয়, সেসব আরও যোগ্য ব্যক্তিরা করবেন। হেফাজত-কওমি মাদ্রাসা নিয়ে উষ্ণতার পাশাপাশি কিছুটা নাতিশীতোষ্ণ বিতর্কও উঠেছে ভাস্কর্য বনাম মূর্তি আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে উন্মুক্ত স্থানে ভাস্কর্য রাখা না-রাখা নিয়ে। শিল্পকলার ছাত্র হিসেবে আর দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পের ইতিহাস পড়ানোর সুবাদে মনে হয় এ বিষয়ে কিছু কথা বলার অধিকার সঞ্চয় করেছি। শুরুতে ভাস্কর্য বনাম মূর্তি বিষয়ে কয়েকটি কথা। প্রথমত, এ দুটি বিষয়কে পরস্পরবিরোধী হিসেবে যেভাবে উপস্থাপন চলছে, তা সঠিক নয়। আজ থেকে প্রায় ৩৫ হাজার বছর আগে মানব-ইতিহাসের একেবারে সূচনাকাল থেকে, মানুষ যখন গুহাবাসী ও শিকারি, সে চিত্র ও ভাস্কর্যের চর্চা করে চলেছে। বলা হয়ে থাকে যে মানুষের সৃজনশীলতার প্রথম উন্মেষই হলো চিত্র-ভাস্কর্য আর নৃত্যকলায়। ওই সময় থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সিংহভাগ ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে মূলত ধর্মীয় কারণে, অথবা পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক বীরত্বগাথার রূপায়ণ হিসেবে। ধর্ম-পুরাণ-ইতিহাস এখানে মাখামাখি।

তবে এর ভেতরেই রূপায়িত হয়েছে মানব-ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম কিছু ভাস্কর্য। মিকেলেঞ্জেলোর পিয়েতার গায়ে ধর্মের বাতাস জড়ানো আছে বলে কি মৃত সন্তানের জন্য মায়ের সন্তাপের এই মর্মস্পর্শী শিল্পকর্মটি পরিত্যাজ্য? অজন্তা-ইলোরার চিত্র ও ভাস্কর্য প্রাচীন যুগের মানুষের হাতে সৃষ্ট শ্রেষ্ঠতম শিল্পকর্মের অন্যতম নিদর্শন। প্রায় দুই হাজার বছর আগে একদল বৌদ্ধ সন্ন্যাসী দুর্ভেদ্য অরণ্য-আচ্ছাদিত শ্বাপদসংকুল এই অন্ধকার গুহাগাত্রে বৌদ্ধ জাতকের কাহিনি আঁকতে গিয়ে মানবজীবনের আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ, প্রাণী-প্রকৃতির প্রতি অনুরাগের যে অপরূপ চিত্র-ভাস্কর্যের নিদর্শন রচনা করেছেন, তার সমতুল কিছু বিশ্বশিল্প ইতিহাসে নেই। দেবতা শিবের নৃত্যরত রূপ নটরাজ মূর্তি দেখে আধুনিক ভাস্কর্যের অন্যতম রূপকার আউগুস্ত রদ্যাঁ বলেছিলেন, এর চেয়ে শ্রেয়তর ভাস্কর্য এখনো পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়নি। ধর্মীয় মূর্তি বলে এগুলোর প্রতি আমার বিমুগ্ধ অনুভূতি মুছে ফেলতে হবে? আমার নিজের দেশে পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় বা ময়নামতিতে পাওয়া অনুপম বৌদ্ধমূর্তি অথবা কান্তজিউর হিন্দু মন্দিরগাত্রে খোদিত ফলকের কিংবা জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত পাল যুগের বিপুলসংখ্যক হিন্দু মূর্তির তুলনারহিত সৌন্দর্য আজ বিশ্বনন্দিত, এ গর্ব ধর্ম-নির্বিশেষে সব বাঙালির। এসবকে আমি ভাস্কর্য হিসেবে দেখে এর নান্দনিক সুষমায় অবগাহন করতে পারি, অন্য একজন যদি একে পূজনীয় মূর্তি ভেবে ভক্তি প্রদর্শন করেন, তাতেও বা ক্ষতি কোথায়? প্রত্যেকে নিজের মতো করে যদি একে মানব-ইতিহাসের মূল্যবান সামগ্রী মনে করি, তাহলে এটি মূর্তি না ভাস্কর্য, সে বিতর্ক অর্থহীন হয়ে যায়।

বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ন্যায়বিচারের প্রতীক ভাস্কর্যটি নিয়ে বিতর্ক ঘনিয়ে উঠেছে। এখানে মূর্তি বনাম ভাস্কর্য বিতর্ক ছাড়াও প্রশ্ন উঠেছে, যে দেশে মুসলিম জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে উন্মুক্ত স্থানে অবয়বধর্মী ভাস্কর্য স্থাপন গ্রহণযোগ্য কি না। বলে রাখি যে আমাদের জানামতে, হেফাজতের আপত্তি ও প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের আগে এটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। না পক্ষে, না বিপক্ষে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, অধিকাংশ মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে উন্মুক্ত স্থানে অবয়বধর্মী বা আধা-বিমূর্ত ভাস্কর্য রয়েছে। সবচেয়ে অধিক মুসলিম জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়ায় চৌরাস্তার মোড়ে মোড়ে বিশাল বিস্তারের ভাস্কর্য যে কারও চোখে পড়বে, সে মুসলিম-অধ্যুষিত জাকার্তাই হোক অথবা হিন্দু-অধ্যুষিত বালিই হোক।

সবচেয়ে রক্ষণশীল মুসলিম এবং আমাদের দেশে ইসলামের আদর্শ ভূমি হিসেবে বিবেচিত সৌদি আরবে উন্মুক্ত স্থানে ভাস্কর্য রয়েছে, বিশেষ করে জেদ্দা শহরে শোভাবর্ধনের জন্য বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কিছু ভাস্করকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিল। তাঁদের রচিত ভাস্কর্যে বাস্তবধর্মী অবয়বও স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি দুবছর অন্তর যে এশীয় শিল্পের প্রদর্শনী হয়, তাতে সৌদি আরবও অংশগ্রহণ করে এবং তাদের চিত্র-ভাস্কর্যে প্রায়ই মানব-অবয়বের রূপায়ণ থাকে। সর্বশেষ ২০১৬ সালের প্রদর্শনীতে একটি ভাস্কর্যে লোহার রডের বেষ্টনীর মধ্যে এক নির্মাণশ্রমিকের অবয়ব রূপায়িত হয়েছে। পাকিস্তানের লাহোরে ন্যাশনাল কলেজ অব আর্টের উন্মুক্ত চত্বরে রয়েছে দোলনায় বসা চুম্বনরত তরুণ-তরুণীর ভাস্কর্য। ইরাকে মার্কিন অভিযানের পর সাদ্দাম হোসেনের বাস্তবধর্মী বিশাল মূর্তি টেনে নামানোর আলোকচিত্র নিশ্চয় অনেকেরই মনে আছে। এ ছাড়া আরও অনেক মুসলিম-গরিষ্ঠ দেশের উল্লেখ করা যাবে, যেসব দেশে এ ধরনের ভাস্কর্য রয়েছে। অতএব, এ ব্যাপারে কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত আছে, এমন বলা যাবে না।

প্রতিটি দেশ তার পরিবেশ-পরিপ্রেক্ষিত ও নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আলোকে তার নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। আলোচিত ভাস্কর্যটি ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের অবয়বধর্মী স্মারক-ভাস্কর্য স্থাপিত রয়েছে, এগুলো সম্পর্কে স্থানীয় মানুষের বরং ইতিবাচক মনোভাবই চোখে পড়ে। তবে অধিকাংশ ভাস্কর্যের শিল্পমান নিয়ে প্রশ্ন আছে। সরকার বরং অধিক বিবেচনার পরিচয় দিত, যদি কারও পক্ষে সাফাই না গেয়ে দেশের প্রতিষ্ঠিত কয়েকজন শিল্পী ও শিল্পবিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইত। যাকে আমরা বলি পাবলিক প্লেস, সেসব উন্মুক্ত স্থানে ভাস্কর্য স্থাপনের আগেই প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত এ ধরনের কমিটির অনুমোদন বাধ্যতামূলক হওয়া বাঞ্ছনীয়।

হয়তো চিত্র-ভাস্কর্য বিষয়ে সরকারের একটু দোলাচলের কারণেই চট্টগ্রামে চারুকলা ইনস্টিটিউটের দেয়ালে আঁকা চিত্রে পোড়া মবিল ঢালার সাহস পেয়েছে দুর্বৃত্তরা, যেখানে আমার ৪০ বছরের শিক্ষকতা জীবনে এমনটি ঘটেনি। চিত্র-ভাস্কর্য, মঙ্গল শোভাযাত্রা, প্রভাতসংগীত, অর্থাৎ বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিকে পুরোপুরি উচ্ছেদের জামাতি বা হেফাজতি দুরভিসন্ধিরই অংশ এগুলো। এদের পূর্বসূরি পাকিস্তানি শাসকেরাও জানত, বাঙালির সংস্কৃতি ধ্বংস না করে বাঙালিকে দমন করা যাবে না। এরা তাদেরই অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে নেমেছে। ফণা তুলতে উদ্যত এ ভয়ংকর বিপদ সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের সরকার সম্পূর্ণ সচেতন ও সজাগ থাকবে, এটিই আমাদের প্রত্যাশা। আর আমরা যারা সৃজনশীল সংস্কৃতির বিকাশকেই উগ্র ধর্মান্ধতা প্রতিহত করার প্রধান উপায় হিসেবে বিবেচনা করি, তাদের উচিত হবে মূর্তি-ভাস্কর্যের বিতর্কে না গিয়ে সব সৃজনশীল শিল্পের চর্চা ও উপস্থাপনের পথে যেকোনো প্রতিবন্ধকতা রচনার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

আবুল মনসুর: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, চারুকলা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়