দুই ছাত্রী বোন, তোমাদের অভিবাদন!

বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের শিকার দুই বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রীর জবানবন্দির সূত্রে আমরা সেই ভয়ংকর রাতের ঘটনার কিছুটা জেনেছি। অভিযুক্ত ধর্ষকের মন–মানসিকতার পরিচয় আমরা পেয়েছি। তাঁদের অর্থবিত্ত, চালচলন ও প্রতিপত্তি সম্পর্কে আমাদের আগেই জানা হয়েছে। ধর্ষণের বিচারের দাবিতে দেশজুড়ে জোরালো জনমত গড়ে উঠছে। দুজন অভিযুক্ত এরই মধ্যে আটকও হয়েছেন। কিন্তু মামলা পরিণতি নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ যে কোনোভাবেই দূর হচ্ছে না! ক্ষমতা ও অর্থবিত্ত যখন প্রতিপক্ষ, তখন আমাদের দেশে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখা সত্যিই বড় কঠিন।

এই মামলার অবস্থা এখন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, তাকে এরই মধ্যে দৃশ্যমান অনেক বাধা পার হতে হয়েছে। অভিযোগ আছে, মামলা ধামাচাপা দিতে বড় অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়েছে এবং এর দেনদরবারে প্রভাশালীদের যুক্ততা রয়েছে। তাদের সেই চেষ্টা কতটা সফল হবে, তা সময়ই প্রমাণ করবে। কিন্তু চেষ্টা থেমে নেই, সহসাই থেমে যাবে, এমন ভাবারও কারণ নেই। বোঝা যায়, সামনে এমন আরও বাধা আসতেই থাকবে। সেগুলো পার হওয়া নিয়েই যত সংশয়। তবে এই লড়াই শুধু কয়েকজন ধর্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের শিকার দুই ছাত্রীর লড়াই নয়; এর সঙ্গে সমাজ ও জনমতও যুক্ত আছে। সমাজের শক্তি ও জনমত ক্ষমতা ও অর্থবিত্তের কাছে হেরে যাবে কি না, আমরা এখন সেই পরীক্ষারই মুখোমুখি।

এমন একটি পরীক্ষা আমাদের জন্য জরুরি ছিল। দুই ছাত্রী অসীম সাহস নিয়ে আমাদের এই পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আমাদের সমাজে ধর্ষণ একটি মেয়ের ওপর এমনই এক ভয়াবহ নির্যাতন, যা কেবল ধর্ষণের সময়ের শারীরিক-মানসিক অত্যাচারের মধ্যে আটকে থাকে না। ঘটনার পরও এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যুক্তি-বুদ্ধি তো এটাই বলে যে যিনি বা যাঁরা ধর্ষণের শিকার হন, তাঁর বা তাঁদের কোনো অপরাধ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে আমাদের সমাজ এই যুক্তিবুদ্ধির ধার ধারে না। ‘লোকলজ্জার ভয়’ এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যা ধর্ষণের পরে একটি মেয়ের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তোলে। রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের রাত্রের বিভীষিকার কথা না হয় আমরা ঘটনার শিকার দুই ছাত্রীর জবানবন্দির সূত্রে কিছুটা জানতে পেরেছি। কিন্তু এর পরের এক মাস তাঁদের কীভাবে গেছে, তা কি আমরা আঁচ-অনুমান করতে পারি?

এই দুই ছাত্রীকে এক মাস ধরে সমাজের তৈরি করা এই ‘লোকলজ্জার’ ভয়কে জয় করতে হয়েছে। সমাজ তাঁদের ওপর লজ্জা চাপিয়ে দিতে চাইলেও তা যে তারা গ্রহণ করতে রাজি নন, তা জানান দেওয়ার মতো শক্তি তাঁদের অর্জন করতে হয়েছে। সাহস দেখানো আমাদের সমাজে এখন খুব কঠিন কাজ। চারদিকে শুধু ভয় আর ভয়। ক্ষমতা আর অর্থবিত্তের শক্তির বিরুদ্ধে সাহস দেখানো তো এখন রীতিমতো দুর্লভ জিনিসে পরিণত হয়েছে। নানা অন্যায় ও অবিচারকে স্বাভাবিক মেনে নিয়ে আমরা অনেকে চুপ মেরে গেছি। আবার অনেকে এ ধরনের লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে রণে ভঙ্গ দিয়েছেন। এ-ই যখন পরিস্থিতি, তখন কতটা মনের জোর নিয়েই না এই দুই ছাত্রী ধর্ষণের বিচার চাওয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে! সিদ্ধান্ত নিয়েও বনানী থানার আচরণে তারা পিছিয়ে যেতে পারত। কিন্তু তাঁরা রণে ভঙ্গ দেননি। বলা যায়, মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়েই তাঁরা প্রতিবাদী হয়েছেন।

এই লড়াইয়ে যদি এখন পর্যন্ত কিছু সাফল্য মিলে থাকে, তা হচ্ছে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত দুজনকে আটক। এর পেছনে আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমের ভূমিকাকে কৃতিত্ব দিতে পারি। কারণ, জনমত সৃষ্টিতে ফেসবুক বা সংবাদমাধ্যমগুলো ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু তাঁরা যখন শুরুটা করেছিলেন, তখন তো তাঁদের পাশে কেউ ছিল না। আর সবাইকে সঙ্গে পাবে, সেই ভরসাও কি তাঁদের শুরুতে ছিল? বনানী থানায় মামলা দায়ের করতে ৪৮ ঘণ্টার ‘যুদ্ধ’ তাঁদের একাই করতে হয়েছে। ক্ষমতা, অর্থ ও দম্ভের বিরুদ্ধে এই লড়াই শুরুর কৃতিত্ব শুধু তাই এই দুই ছাত্রী বোনেরই! এই অসীম সাহসের জন্য, ‘লোকলজ্জার’ তথাকথিত ভয়কে জয় করার জন্য তোমাদের অভিবাদন!

তোমরা যে শুরুটা করেছ, তা শেষ করার দায়িত্ব এখন আমাদের সবার।