আত্রাই বাঁধে মমতার আপত্তি

দিনাজপুরের আত্রাই নদে রাবার ড্যাম
দিনাজপুরের আত্রাই নদে রাবার ড্যাম

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একটি আন্তদেশীয় নদে ভারতের সঙ্গে আলোচনা না করে বাংলাদেশ বাঁধ দিয়েছে বলে মমতা অভিযোগও করেছেন। তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে তাঁর অবস্থান জানিয়েছেন। রাজ্যের ওই অঞ্চলে ‘আত্রাই বাঁচাও’ আন্দোলন নামে একটি আন্দোলনও গড়ে তুলেছেন।

নদ-নদীতে বাঁধ বা স্থাপনা যতটা না করা যায়, ততই মঙ্গল। তবু মানুষ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, মত্স্য চাষ ইত্যাদির প্রয়োজনে এ ধরনের বাঁধ দিয়ে আসছে যুগে যুগে। সভ্যতা ও উন্নয়নের গতিতে তা বেড়েও চলছে। তবে আমাদের দেখা দরকার, হঠাৎ করে এ অভিযোগ কেন এল? বাঁধটি তো ২০১২-১৩ সালের দিকে তৈরি করা হয়। এর উচ্চতা মাত্র ৪ মিটার এবং দৈর্ঘ্য ১৩৫ মিটার। ক্ষীণস্রোতা এ নদের রাবার ড্যামটি নিয়ে এত দিন ভারতের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তির কথা জানা যায়নি। এমনকি ২০১৫ সালে দিনাজপুরে বাংলাদেশের ছয়জন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে ভারতের জেলা শাসকদের যে সীমান্ত বৈঠক
হয়, এতেও এ বিষয়ে কোনো আপত্তি আসেনি বলে জানা যায়। আন্তদেশীয় নদীর পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টির আগে আলোচনা করে বণ্টন চুক্তি করতে হয়। বিষয়টা প্রমত্তা তিস্তার গজলডোবায় ২৮৫ ফুট উচ্চতায় ৫৭৭ ফুট দৈর্ঘ্যের বাঁধটি করার সময়ও প্রাসঙ্গিক ছিল। প্রাসঙ্গিক ছিল ফারাক্কা বাঁধ তৈরির সময়ও, কিন্তু তা হয়নি। যাহোক, ফারাক্কা নিয়ে পরবর্তী সময়ে
একটি বণ্টন চুক্তি হয়েছে বর্তমান সরকারের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে। তবে তিস্তার প্রশ্নে হতে গিয়েও কিছু হয়নি। আর এখানে তো বণ্টনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে অনড় অবস্থানে রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। তিনি এ ধরনের যৌথ নদীর পানি ব্যবস্থাপনার চিরায়ত ধারার বাইরে থেকে বলছেন, তাঁর রাজ্যের চাহিদা মিটিয়ে যদি থাকে, তবেই তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দেওয়া হবে।

ভারত বাংলাদেশের তিন দিক বেষ্টন করে আছে। উদীয়মান পরাশক্তি। স্বাধীনতাসংগ্রামে আমাদের প্রধান মিত্র ছিল সে দেশের সরকার ও জনগণ। এ দেশকে মুক্ত করতে ভারতীয় সৈনিকেরাও রক্ত দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে উভয় দেশের মাঝে একটি গভীর সম্প্রীতিমূলক মনোভাব থাকার কথা, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোনো না কোনো কারণে এ সম্পর্কের কিছু
ক্ষেত্র কণ্টকাকীর্ণ থেকে যাচ্ছে। বাস্তবতা এটুকু যে উভয়ে উভয়ের জন্য প্রয়োজনীয়। বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে আমাদের সব সময়কার ভালো সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। নদীমাতৃক বাংলাদেশের ৫৪টি নদীর উৎস ভারতে। এগুলোর পানি ন্যায়সংগতভাবে বণ্টনের সঙ্গে আমাদের অর্থনীতি ও সমাজচিত্রের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ভারতের বাজারে আমাদের যথোচিত প্রবেশাধিকারও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঠিক তেমনি সে দেশের সাতটি পার্বত্য রাজ্য আমাদের ঘিরে আছে। তারা ভূমি আবদ্ধ এবং ভারতের অন্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা দুর্গম। সে ক্ষেত্রে আমাদের বন্দর, রেলপথ, নৌপথ ও সড়ক যোগাযোগব্যবস্থাকে ব্যবহার করলে সময় ও খরচ বাঁচে।

এ ছাড়া এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা দুই দেশের স্বার্থেই জরুরি। এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে উভয় দেশই। ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র হামলা কিংবা বাংলাদেশ থেকে ওই সাত রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা কার্যকরভাবে বন্ধ হয়েছে—এ বিষয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের জোর আপসহীন প্রচেষ্টা ভারতকে অনেকটা নির্ভার করেছে। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তায় ১৯৭৪ সালের স্থলসীমান্ত চুক্তি মাত্র কিছুকাল আগে কার্যকর হয়েছে। অনেকটা একতরফাভাবেই আমরা ভারতকে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধা দিতে শুরু করেছি। এ ক্ষেত্রে ধার্য করা হয়েছে অতি কম মাশুল। ভারত এ দেশে পাচ্ছে বেশুমার বাজারসুবিধা। এ দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু ভারতীয় কাজ করে প্রচুর টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন। ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি ব্যাপক ও ক্রমবর্ধমান। এটা কিছুটা কমাতে আমাদের অনেক পণ্য সে দেশে রপ্তানিতে কাগজে–কলমে ব্যাপক ছাড় দেওয়া হয়। বাস্তবে নানা অশুল্ক বাধা সে সুবিধার গুড়ে বালি দিচ্ছে। এসব টানাপোড়েন আছে, থাকবে; সময়ে সময়ে মিটমাটও হবে।

তবে যৌথ নদীর পানি বণ্টনসংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের এ মেয়াদে কোনো অগ্রগতি হয়নি। মনমোহন সিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিস্তা চুক্তির একটি খসড়া চূড়ান্ত হয়েছিল। তাঁর বাংলাদেশ সফরকালে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বেঁকে বসায় সেটি স্থগিত হয়ে যায়। এখনো এর ভাগ্য অনিশ্চিত। তবে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও
এ ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ, কিন্তু তিনি এখন পর্যন্ত সামলে উঠতে পারছেন না। কী এমন সমস্যা? বলা হয়, ভারতীয় সংবিধান ‘সেচ’কে রাজ্য সরকারের কার্যতালিকায় রেখেছে। আর সেটার ব্যাখ্যা হওয়ার কথা তো সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সেচব্যবস্থা।

পররাষ্ট্রনীতি এবং অন্য দেশের সঙ্গে চুক্তি তো কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়। তিস্তা থেকে বাংলাদেশ যে পানি পাবে, তার দেনদরবার ও চুক্তি হবে ভারত সরকারের সঙ্গে। তাদের প্রাপ্য ভাগ নিয়ে সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ সে দেশের সংবিধান অনুসারে ব্যবস্থা নেবে। নদটি দেশের উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি, জীবন-জীবিকা এমনকি সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। একে ঘিরে একটি সেচ প্রকল্পও আছে বাংলাদেশে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা থেকে শুষ্ক মৌসুমে প্রায় সব পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় আমরা একরূপ শুষ্কই থাকছি। ডিসেম্বর থেকে মে সময়কালে ঐতিহাসিক তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রবেশমুখে তিস্তার প্রবাহ ছিল পাঁচ হাজার কিউসেক। আর এখন পাঁচ শ কিউসেকের কমবেশি। অবশ্য অতিবৃষ্টি হলে খুলে দেওয়া হয় গজলডোবার সব গেট। তখন সেই পানির চাপে বন্যাকবলিত ও ফসলহানি হয় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটের রাজনীতি করছেন প্রতিবেশী দেশের ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে এ বিষয়ে কিছুটা আন্তরিক মনে হলেও ফয়সালা হওয়ার আগে চূড়ান্ত কিছু বলার সুযোগ নেই। দুই বছর পরই ভারতের লোকসভা নির্বাচন। এর মাঝেই হাঁকডাক পড়ে গেছে। তিস্তা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ মনোভাবের সমালোচক ভারতে এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও আছেন অনেকে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, সে দেশের সুশীল সমাজের বড় একটি অংশ এসব বিষয় নিষ্পত্তি করে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি স্থায়ী ও কার্যকর সম্পর্ক করার প্রশ্নে জোর দিচ্ছে। তারা বলছে, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ভারতের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে সহায়ক হবে।

বাংলাদেশের ২০০৯ সালের নির্বাচিত সরকার ভারতকে একতরফা বিভিন্ন সুবিধা দিতে থাকে। আশা করা হয়েছিল, এর প্রতিদানে ভারত অনুকূল সাড়া দেবে। কিছুটা দেয়নি এমন নয়, তবে মূল পানি বণ্টনের বিষয়টি থাকছে উপেক্ষিত। গজলডোবা বাঁধ থেকে তো এক লাখ হেক্টর জমিতে চাষ দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হয়েছে সেচ অঞ্চল। সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে এ নদে স্থাপিত পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে বলেও জানা যায়। অথচ এই পানিতে তো আমাদের ভাগ আছে। এই ভাগ চাইলে নির্মমভাবে না বলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। আর আমরা চার হাজার একর সেচসুবিধার একটি রাবার ড্যাম দিলে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা না করার অভিযোগ তোলা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় উপেন ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন:

“কহিলাম তবে, ‘আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব—

দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব!’’

ভারতের দায়িত্বশীল মহলের কাছে আমাদের নিবেদন, দয়া করে বাংলাদেশের মানুষকে এরূপ ভাবতে যেন না হয়, এর জন্য দ্রুত কিছু করুন।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।