উৎসব মানেই আরও আরও মৃত্যু?

ফাইল ছবি : প্রথম আলো
ফাইল ছবি : প্রথম আলো

ট্রাকের ছাদে সিমেন্টের বস্তার ওপর বসে যাচ্ছিলেন স্বল্প আয়ের লোকগুলো। চোখে তাঁদের স্বপ্ন, মনে আনন্দ, আর মাত্র কয়েকটি ঘণ্টা। তারপর দেখা পাবেন আপনজনদের। মমতাময়ী মা, স্নেহশীল বাবা, আদরের স্ত্রী, সন্তান। প্রিয় সব মুখ। তাদের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন করবেন। কিন্তু হলো না। তাঁদের আশা পূরণ হলো না। প্রিয়জনদের কাছে আর ফেরা হলো না। ট্রাকটি উল্টে গিয়ে তাঁদের সব স্বপ্নকে মাটি করে দিল। ঝরে গেল ১৬টি তাজা প্রাণ।

আজ শনিবার ভোর পাঁচটায় ঘটে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা। সিমেন্টবোঝাই ট্রাকটি গাজীপুর থেকে রংপুরের দিকে যাচ্ছিল। পথে চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে ট্রাকটি রাস্তার পাশের একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায়। এতে ছাদে থাকা লোকজন সিমেন্টের বস্তার নিচে চাপা পড়েন। ঘটনাস্থলেই ১১ জন আর মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পথে আরও পাঁচজন মারা যান। আহত হয়েছেন আরও আটজন। তাঁদের বেশির ভাগই পোশাকশ্রমিক।

এভাবে ট্রাক উল্টে সিমেন্টের বস্তার নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু অবশ্য নতুন কিছু নয়। প্রতিবছর ঈদের সময় এ এক সাধারণ চিত্র। একটু কম ভাড়ায় যেতে পারবে, এই জন্য স্বল্প আয়ের লোকজন ট্রাকের ছাদে, বাসের ছাদে, ট্রেনের ছাদে ওঠেন। তাঁরা জানেন, এতে জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। তারপরও যান। কারণ বাস, ট্রেনের ভাড়া যে অনেক বেশি। ঈদের সময় তা বেড়ে যায়। কী করবেন তখন এই স্বল্প আয়ের লোকজন? কারণ, এর আগে তো তাঁরা ছুটি পান না। ছুটি না পেলে যাবেন কী করে? শেষ মুহূর্তে তাঁদের বাস, ট্রাকের ছাদই ভরসা। বাস-ট্রাকের চালকেরাও বাড়তি আয়ের লোভে এভাবে ছাদে যাত্রী পরিবহন করছেন।

বছরের পর বছর এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। অথচ কারও যেন কিছু করার নেই। এ রকম কি চলতেই থাকবে? কোনো প্রতিকার নেই? আসলে এ রকমভাবে যারা মারা যায়, তারা সবাই গরিব মানুষ। গরিব মানুষের জন্য চিন্তা করার সময় কোথায়? এসব ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সাধারণ মানুষের জীবন কত তুচ্ছ, কত খরচযোগ্য!

ঈদ এলেই বাস, ট্রেন, লঞ্চ, স্টিমার—সবকিছুর ভাড়া বেড়ে যায়। এই ভাড়া তিন গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। তারপরও টিকিটের এত বেশি চাহিদা থাকে যে দ্বিগুণ, তিন গুণ ভাড়া দিয়েও টিকিট পাওয়া যায় না। কালোবাজারে অনেকে বেশি দাম দিয়ে টিকিট কেনেন। কিন্তু সবার তো আর সেই সামর্থ্য থাকে না। কিন্তু ঈদে তো প্রিয়জনের কাছে যাওয়া চাইই চাই। কী করবেন তখন তাঁরা? বাসের ছাদ, ট্রেনের ছাদ, লঞ্চের ছাদই তাঁদের ভরসা। শুধুই তা-ই নয়, বাসের হ্যান্ডেল, ট্রেনর হ্যান্ডেলে ঝুলে ঝুলে, ট্রেনের ইঞ্জিনের পাদানিতে দাঁড়িয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা তখন গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আর এ রকম করতে গিয়ে অনেকেই বেঘোরে প্রাণটা হারিয়ে বসেন।

অথচ চাইলেই এমন মৃত্যু রোধ করা যায়। সরকার চাইলেই বাস-ট্রেনের ছাদে যাত্রী পরিবহনের ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। যেসব বাস-ট্রাকের চালক এভাবে ছাদে যাত্রী তোলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। যেহেতু বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে ঈদের সময় বেশি মানুষ গ্রামের বাড়ি যায়, সে জন্য ঈদ উপলক্ষে পরিবহনের সংখ্যা বাড়াতে পারে। ঈদের সময় পরিবহনের ভাড়া না বাড়ানোর ব্যাপারে নির্দেশ জারি করতে পারে। বরং ঈদের সময় পরিবহনের ভাড়া কমানোর উদ্যোগ নিতে পারে। কালোবাজারে টিকিট বিক্রি বন্ধ করতে কালোবাজারিদের বিরুদ্ধ ব্যবস্থা নিতে পারে। সরকারের পক্ষে সবই সম্ভব। এ ক্ষেত্রে দরকার একটু সদিচ্ছা। গরিব মানুষগুলোর জন্য সরকার এসব করবে কি?
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক