নোয়াখালী থেকে কত দূর রাঙামাটি?

দেশজুড়ে এখন অনেক খবর। গণমাধ্যমের বুকজুড়ে শুধু খবরের পালাবদল। এত সব খবরের অদল-বদলে একটি খবরে চোখ আটকে গেল। ঈদের দিনটা কোনোমতো কাটিয়েই রাঙামাটির আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষ আবারও তাদের ঝুঁকিপূর্ণ বসতিতে ফিরতে শুরু করেছে। পাহাড়ধসের অন্যতম কারণ ওই অবৈধ বসতিতে ফিরে যাওয়ার জন্য অনেকেই তাদের দোষারোপ করতে পারেন। বলতে পারেন, তারা কি বোকা, অবুঝ বা পাগল। এত বড় একটি বিপর্যয়ের পরও তারা আবারও কীভাবে ওই পাহাড়ে ফিরে গেল। তারা কি ষড়যন্ত্রকারী? সরকারকে বিপদে ফেলতে, আরেকটি পাহাড়ধসের পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে।

যেমন দোষের কবলে পড়েছে খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালি ইউনিয়নে বেড়িবাঁধের বাসিন্দারা। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরে সব হারা ২৫ হাজার উপকূলবাসী প্রায় ১০ বছর ধরে বেড়িবাঁধে অবস্থান করছে। এতে বেড়িবাঁধগুলো তো আরও দুর্বল হয়ে তো পড়ছেই, একই সঙ্গে নতুন বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের মহাযজ্ঞ বাধা পাচ্ছে। রাষ্ট্রের পক্ষে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বেড়িবাঁধবাসীকে জানিয়ে দিয়েছে, এক মাসের মধ্যে বেড়িবাঁধ ছেড়ে চলে যেতে হবে। নয়তো বল প্রয়োগে সরানো হবে।
পাহাড়ের বুকে ও বেড়িবাঁধের ওপরে যারা বসতি গড়ে আছে, তাদের কেউ বোকা বলতে পারেন। রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের অবৈধ দখলদার বলতেও পিছপা হবে না। শিগগিরই হয়তো তাদের ‘অবৈধ বসতি’ থেকে উচ্ছেদ করা হবে। কিন্তু কেউ কি ভেবে দেখেছেন হাওরের বা উপকূলের মানুষ কেন বেড়িবাঁধকে ঝুঁকিতে ফেলে বসত গড়ছে।
দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত বাংলাদেশে কেন এমনটা হচ্ছে। সেই কবেকার সিডর-আইলায় ঘরহারা মানুষ কেন এখনো নিরাপদ ঘর পেল না? এসব প্রশ্ন মাথায় নিয়ে ভাবতে ভাবতে ২০১৪ সালে জাপানের সেন্দাই শহরের কথা মনে পড়ল। জাতিসংঘের বিশ্ব দুর্যোগ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সুবাদে আয়োজকেরা সেন্দাই শহরের ভূমিকম্প ও সুনামিবিধ্বস্ত এলাকায় গেলেন। তখনো ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়ায়নি শহরটি। বিধ্বস্ত ওই জনপদের প্রধান সড়কের পাশে দেখা গেল রেললাইনের বগির মতো সারি সারি ঘর।
সঙ্গে থাকা জাপানি গাইড বললেন, সুনামির পর ওই ঘরগুলোয় দুর্গত মানুষকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। ছয় মাসের মাথায় তাদের ধ্বংস হওয়া ঘরের আদলে, অনেক ক্ষেত্রে তার চেয়েও উন্নত ঘর করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে এক বছরের মাথায় প্রায় শতভাগ মানুষ তাদের ঘরে ফিরে গেছে। সরকারের আশ্বাসে মানুষ বিশ্বাস করে ওই অস্থায়ী বসতিতে প্রায় এক বছর অবস্থান করেছিল। ওই সময়ের মধ্যে তারা সুনামির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে সেখানে সব ধরনের বসতি ও অবকাঠামো নির্মাণ নিষিদ্ধ করেছিল। ভূমিকম্প ও সুনামির পর ফুকুশিমা শহরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। ওই শহরের গরুর মাংস ও ধান এবং ফল ছিল অন্যতম রপ্তানি পণ্য। পারমাণবিক বিস্ফোরণের ওই এলাকার সব পণ্য বিশ্ববাজারে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সেন্দাই দুর্যোগ সম্মেলনের আগে টোকিওতে এক অনুষ্ঠানে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ফুকুশিমায় উৎপাদিত ধানের তৈরি পিঠা যে কতটা নিরাপদ, তা বোঝাতে নিজেই তা খেয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করলেন।
অনেকে বলতে পারেন, বাংলাদেশ তো জাপানের মতো এত উন্নত-ধনী দেশ না। আমরা তো চাইলেই জাপানের মতো এত দ্রুত বসতি তৈরি করতে পারব না। দুর্গত মানুষকে পুনর্বাসন করতে পারব না। এত বিশাল আর্থিক সামর্থ্য কি বাংলাদেশের আছে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অবশ্য সুদূর চীন-জাপানে যাওয়ার দরকার হবে না। রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রাম পেরিয়ে নোয়াখালীর দিকে গেলেই হবে। ৭০ থেকে ৯০-এর দশকজুড়ে দেশের অন্যতম দুর্যোগপ্রধান ও দরিদ্র এলাকা ছিল নোয়াখালী। নিয়মিত বন্যা ও ঝড়ে সব হারা নোয়াখালীবাসী সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। আশির দশকে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণে মানুষ যখন জীবিকার তাগিদে প্রবাসী হওয়া শুরু করল, তখন সবচেয়ে বেশি মানুষ গেল বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা থেকে।
দুই দশক আগেও এই জেলার অর্ধেকের বেশি মানুষ ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। ২০১৪ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো জেলাভিত্তিক যে দারিদ্র্য মানচিত্র প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা গেল নোয়াখালীর দারিদ্র্যের হার কমে ৯ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। আর দেশের অর্থনীতির কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত যে দুই জেলা, ঢাকা ও চট্টগ্রামের দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি। যথাক্রমে ৩২ দশমিক ৩ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
এই প্রশ্ন তো উঠতেই পারে যে নোয়াখালীতে এমন তো কোনো অর্থনৈতিক তৎপরতা হয় না যে সেখানে দারিদ্র্য কমে যাবে। এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য মিলবে প্রবাসী আয় নিয়ে করা পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের জরিপে। সেখানে দেখা গেছে দেশে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসে বৃহত্তর নোয়াখালীর তিন জেলা নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুরে। ওই আয়ের একটি বড় অংশ তারা ব্যয় করে বাড়ি-ঘর তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে। এই তিন জেলার মানুষদের সঞ্চয়ের প্রবণতাও বেশি।
নোয়াখালী নিয়ে এত সব তথ্য উপস্থাপনের পেছনে আসল উদ্দেশ্যটা আসলে বলে রাখি। অনেকেই বলতে পারেন, রাঙামাটির পাহাড়ধসের সঙ্গে নোয়াখালীর দারিদ্র্য কমে যাওয়ার সম্পর্ক কী। সম্পর্কটি অবশ্য মাথায় দিয়েছিলেন কানাডার মেনিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অধ্যাপক সি এমদাদ হক। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে তাঁর বাংলাদেশে আসার খবর পেয়ে রাজধানীর গুলশানের এক হোটেলে ছুটে যাই। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সফলতা নিয়ে তাঁর সঙ্গে বিস্তর কথা হয়।
কথার এক ফাঁকে তিনি বললেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সাফল্যের আসল দিকটি কেউ বলে না। প্রবাসী আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে কীভাবে বাংলাদেশে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যু কমে আসছে, তা একটু খোঁজখবর নিয়ে দেখেন। সঙ্গে থাকা জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) শীর্ষ কর্মকর্তা ও বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করা খুরশিদ আলমও এর সঙ্গে একমত হলেন। বললেন, দেশে-বিদেশে এ নিয়ে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাও আছে। প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশির ভাগ গ্রামীণ বসতি কাঁচা থেকে পাকা ঘরে পরিণত হচ্ছে। দুর্যোগে আক্রান্ত পরিবারগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসছে তাদের প্রবাসে থাকা আত্মীয়রা। ওই সব পরিবারে সঞ্চয়ও বেশি। দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্বাসনে ওই সঞ্চয় হয় সবচেয়ে বড় সহায়।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের প্রবাসী আয় নিয়ে করা জরিপের ফলাফল ওই দুই দুর্যোগ বিশেষজ্ঞের মতামতকে সমর্থন করে। ওই জরিপে দেখা যায়, দেশে প্রতিবছর বৈধ পথে যে ১৫ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় আসে, তার ৭৫ শতাংশ ব্যয় হয় ঘরবাড়ি নির্মাণে। আর প্রবাসী আয়ে শীর্ষে থাকা নোয়াখালী এলাকায় গত এক যুগে পাকা ও আধা পাকা ঘরের সংখ্যা তিন গুণ বেড়েছে। ওই ৩ জেলার ৩৩ শতাংশ ঘরই পাকা ও আধা পাকা। ১৬ শতাংশ পরিবারের বাড়ির ছাদ কংক্রিটের তৈরি। ব্যাংকগুলোতে আর্থিক সঞ্চয়ের যে হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া গেছে, তাতে দেখা গেছে রাজধানী ঢাকার পরেই নোয়াখালীর মানুষদের ব্যাংকে আর্থিক সঞ্চয় বেশি। আর্থিক হিসাবে ওই তিন জেলার মানুষের মোট সঞ্চয় ২০ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা।
এই গত মাসেই বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের দারিদ্র্য নিয়ে একটি জরিপ করে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় যখন বলছে দেশে দারিদ্র্যের হার ২২ দশমিক ৩ শতাংশ, সেখানে পার্বত্য তিন জেলায় দারিদ্র্যের হার ৫১ দশমিক ১ শতাংশ। সমতলের চেয়ে ওই পার্বত্য তিন জেলায় পাকা ঘরের সংখ্যা কম, ঝুপড়ি ঘরের সংখ্যা বেশি। জাতীয় হারের তুলনায় আয়বৈষম্য বেশি।
এমন একটি পরিস্থিতিতে পার্বত্য তিন জেলায় পাহাড়ধসের ঘটনাগুলো ঘটল। এত বড় বিপর্যয়ের পর সেখানকার মানুষ যেখানে আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ে ও স্থাপনায়। কবে তারা বাড়িতে ফিরতে পারবে, তার কোনো নিশ্চয়তাও নেই। আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল এই বিশাল জনগোষ্ঠীর নেই আত্মীয়দের প্রবাসী আয়ের ভরসা। রাষ্ট্র-সমাজ, সবার কাছে তারা পাহাড়ের ‘অবৈধ’ দখলদার। জাপানের মতো রাষ্ট্রের কাছ থেকে ভরসা বা নোয়াখালীর মতো প্রবাসী আয়ের আশ্রয় তাদের নেই। ফলে সেই পাহাড়েই তো তারা ফিরবে। আর পরবর্তী ধসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করবে।

ইফতেখার মাহমুদ: সাংবাদিক