বাংলাদেশের পাশে চীন

বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী নতুন কিছু নয়; এ সম্পর্ক প্রাচীন। দুই হাজার বছর কিংবা তারও বেশি আগের সম্পর্ক। বাংলাদেশকে চীনের সঙ্গে যুক্ত করেছিল যে পথ, তার নাম রেশম পথ, যা সিল্ক রোড নামে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। ছিল পশ্চিমা সিল্ক রোড, যার সূচনা হয়েছিল রাজধানী সিয়ান (তৎকালীন ছাংআন) থেকে। সেই পথ সিনজিয়াং হয়ে আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে ভারত হয়ে পৌঁছেছিল বাংলাদেশে (মংচিয়ালা)।
কয়েক শতাব্দী ধরে এই মংচিয়ালাই ছিল চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যকার সম্পর্কের সেতুবন্ধ। একটি পূর্ব সিল্ক রোডও ছিল, যার উৎপত্তি হয়েছিল দক্ষিণ চীনের কুনমিং থেকে। মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে তা সংযোগ স্থাপন করেছিল বাংলাদেশের সঙ্গে। এই দুটি পথ ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল, বৃদ্ধি পেয়েছিল সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান।
প্রাচীনকাল থেকেই চীন ও বাংলাদেশ উভয়ই সমুদ্র উপকূলীয় দেশ বিধায় সমুদ্রপথে তাদের মধ্যকার আদান-প্রদান ছিল চমৎকার। প্রায় ৬০০ বছর আগে চীনের মিং রাজবংশের পরাক্রমশালী সম্রাট ছিলেন ইয়ংলে। সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ নাবিক অ্যাডমিরাল ঝেং হে ছিলেন সম্রাটের শান্তির দূত; তিনি ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর পরিভ্রমণ করেন। তিনিই সমুদ্রপথে চীনা সিল্ক রোড সৃষ্টি করেন। ১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অ্যাডমিরাল ঝেং হে শতাধিক জাহাজের বিশাল বহর নিয়ে সাতটি আন্তসমুদ্র অভিযান পরিচালনা করেন এবং এশিয়া ও আফ্রিকার ৩০টি দেশ ও অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। অ্যাডমিরাল ঝেং হের নৌবহর দুবার চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিল। বাংলার শাসক সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ তাঁর রাজধানী সোনারগাঁয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানান চীন থেকে আসা অ্যাডমিরালকে। সুলতান পরবর্তী সময়ে একটি দীর্ঘ গ্রীবার জিরাফসহ মূল্যবান নানা উপহার পাঠান মিং রাজার দরবারে। চীনা ঐতিহ্য অনুসারে জিরাফকে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করা হয়।
প্রাচীনকাল থেকে চীন নৌ ও স্থলশক্তিতে অত্যন্ত বলবান দেশ হওয়া সত্ত্বেও সমগ্র ইতিহাসে চীন অন্য কোনো দেশে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করেনি, অন্য কোনো দেশ দখল করে নেয়নি। বরং সব দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এসেছে।
বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা ঘটে ১৯৭৫ সালে। এর সূচনা ঘটান জিয়াউর রহমান, যাঁর দৃষ্টি ছিল পূর্বমুখী। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু হওয়ার পর থেকে বরাবরই তা চমৎকার ছিল, ক্রমে তা আরও নিবিড় হয়েছে এবং এই সম্পর্ক সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার ভিন্নতা সত্ত্বেও এই দুই দেশের মধ্যকার চমৎকার কূটনৈতিক সম্পর্ক একটি রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প এবং প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও চীন সহযোগিতা করে এসেছে।
বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক, ভূকৌশলগত ও ভূ-অর্থনৈতিক অবস্থান এমন যে, তা আঞ্চলিক কৌশলগত ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে পরিণত হয়েছে। এমনকি বৈশ্বিক কৌশলগত ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের স্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগ-সেতু হিসেবে বিবেচিত। এশিয়ার দুই বৃহৎ দেশের মধ্যখানে বাংলাদেশের অবস্থান, যার একটি উদীয়মান ভারত। অন্যটি চীন, যা ইতিমধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
বাংলাদেশের ভূকৌশলগত গুরুত্ব অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে এর অবস্থানের কারণে। বঙ্গোপসাগর হচ্ছে ভারত মহাসাগরের পূর্ব অংশ এবং ভারত মহাসাগরের ওপরে অবস্থিত দেশগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপনের পথ। বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে বাণিজ্যিক যোগাযোগ পূর্বে চীন থেকে পশ্চিমে পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অঞ্চলের সব সমুদ্রপথই বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে গেছে; গুরুত্বপূর্ণ মালাক্কা প্রণালি ও তাইওয়ান প্রণালিকে যুক্ত করেছে এবং দক্ষিণ চীন সাগর, পূর্ব চীন সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের একটি শক্তিশালী অংশীদার ভারত; দেশটি বঙ্গোপসাগরকে নিজের হ্রদ হিসেবে বিবেচনা করে এবং আসিয়ানের ব্যাপারে তার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উদ্যোগসমূহের জন্য একটি সামুদ্রিক জলসীমা বলে মনে করে। যুক্তরাষ্ট্রও একটি প্রধান অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত; যার ভূরাজনৈতিক কৌশলের প্রধান খুঁটিই হলো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। যুক্তরাষ্ট্র তার নৌশক্তির ৬০ শতাংশই প্রশান্ত মহাসাগরে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
চীন একটি বিনম্র শক্তি; দেশটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী এবং শান্তির পথই অনুসরণ করে। তবে চীন তার সমুদ্রসীমার নিরাপত্তার ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ এবং সে অনুসারেই নিজের নৌশক্তি গড়ে তুলেছে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে।
চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রতিরক্ষা। ২০০২ সালে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার চীন সফরকালে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেটি একটি সাধারণ সামগ্রিক চুক্তি, যার অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ, প্রযুক্তি স্থানান্তর, যৌথ উদ্যোগে প্রতিরক্ষা প্রকল্প গ্রহণ, সামরিক প্রশিক্ষণ, যৌথ অভিযান, লজিস্টিক লাইনসমূহ উন্নয়ন, সন্ত্রাসবাদ দমন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য সম্ভাব্য ক্ষেত্র। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীগুলোর আধুনিকায়ন ও শক্তিশালীকরণ প্রয়োজন; হালনাগাদকরণের মাধ্যমে সময়োপযোগী করে তোলা প্রয়োজন। আমাদের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (ইইজেড) ও সম্প্রসারিত মহীসোপানের নিরাপত্তা এবং সমুদ্রতলের মূল্যবান হাইড্রো-কার্বনসহ আমাদের সামুদ্রিক সম্পদের সুরক্ষার জন্য সমুদ্রসীমার সার্বভৌমত্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা উল্লিখিত প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় চীনের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা চাই। এ লক্ষ্য সামনে রেখে আমরা আমাদের নৌবাহিনীকে সমুদ্রপৃষ্ঠে যুদ্ধ করার উপযোগী নৌবহর, সমুদ্রতলে সাবমেরিন এবং আকাশে নৌবাহিনীর নিজস্ব জঙ্গি বিমানে সুসজ্জিত করে তোলার ক্ষেত্রে চীনের সহযোগিতা পাওয়ার চেষ্টা করি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে চীন সফর করেন এবং একই বছর চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফর করেন। শি এখন চীনের প্রেসিডেন্ট, সর্বোচ্চ নেতা। গত অক্টোবরে খালেদা জিয়া চীন সফরে গেলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়; সে আলোচনায় চীনা নেতা বাংলাদেশকে সহযোগিতা দেওয়ার ব্যাপারে পরিপূর্ণ আশ্বাস ব্যক্ত করেন। খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী হিসেবে ওই সফরকালে আমারও সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মির উপপ্রধান জেনারেল মা জিয়াওতিয়ানের সঙ্গে, যিনি বর্তমানে চীনের সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের সদস্য এবং পিপলস লিবারেশন আর্মির বিমানবাহিনীর কমান্ডার। তিনিও বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীগুলোর প্রতি চীনের অব্যাহত সমর্থন ও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
বাংলাদেশ পূর্ব দিকে তাকায় এবং সেখানে সে একটি শক্তিশালী হাত তার দিকে প্রসারিত দেখতে পায়। বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সর্বতোমুখী সংযোগ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সমুদ্রপথে আমাদের যোগাযোগ উন্নত ও শক্তিশালী করা প্রয়োজন; সে জন্য চীনের সহযোগিতায় চট্টগ্রামের দিকে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা জরুরি। মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে চট্টগ্রাম ও কুনমিংয়ের মধ্যে আমরা সড়ক ও রেল যোগাযোগও গড়ে তুলতে চাই। এর মধ্য দিয়ে প্রাচীন দক্ষিণ সিল্ক রোডের পুনঃপ্রবর্তন ঘটবে; উন্মুক্ত হবে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ব্যাপক সহযোগিতার দ্বার।
একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলে লেখাটির সমাপ্তি টানব। ১৯৯৬ সালে, যখন আমি বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ছিলাম, সে সময় চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি আমাকে চীনে আমন্ত্রণ জানায়। সেই সফরকালে আমার সুযোগ হয়েছিল চীনের প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিনের সাক্ষাৎ লাভের। মনে আছে, চীনা প্রেসিডেন্ট আমাকে বলেছিলেন, ‘চীন অনেক বদলে গেছে। সত্তর-আশির দশকে আপনি যে চীন দেখে গেছেন, আজ সে চীন নেই। আজকের চীন আধুনিক চীন, উন্নত চীন এবং এখানে এখন এক নতুন প্রজন্ম, নতুন নেতৃত্ব।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘পৃথবী বদলে যাচ্ছে। আমি শুনেছি, ঢাকার দিগন্তরেখাও বদলে গেছে। কিন্তু এসব পরিবর্তনের মধ্যেও একটি বিষয়ের পরিবর্তন ঘটেনি, ঘটবেও না। সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক, বাংলাদেশ বিষয়ে আমাদের নীতি।’ তিনি আরও বলেন, ‘জেনারেল, আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, চীন সব সময় বাংলাদেশের বন্ধু থাকবে। প্রয়োজনের মুহূর্তে চীন আপনাদের পাশে থাকবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘চীন ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক বন্ধুত্বের, কেবলই বন্ধুত্বের, অন্য কিছু নয়।’
জিয়াং জেমিনের কথাগুলো আজও আমার কানে বাজে। আমার মনে হয়, তাঁর এসব কথার মধ্য দিয়ে আমাদের দুই জাতির সাধারণ বিশ্বাস ও মূল্যবোধ এবং প্রকৃত মৈত্রীর চেতনার মূর্ত প্রকাশ ঘটেছে।

লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান: সাবেক সেনাপ্রধান।