নওয়াজ না ইমরান: দম কার বেশি লম্বা?

পাকিস্তান নিয়ে একটি গল্প বলা যায়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর এক পুণ্যবানের স্বপ্নে দেখা দিলেন এক সাধুপুরুষ। বললেন, ‘দেশ পেয়েছ ভালো কথা, বলো আর কী চাও?’

পুণ্যবান বললেন, ‘হুজুর, আমাদের এমন নেতা দিন, যারা যুদ্ধেও জিতবে, আবার গণতন্ত্রও মানবে।’
সাধুপুরুষের কপালে দুশ্চিন্তার রেখা দেখা দিল। তিনি বললেন, ‘বৎস্য, বড়ই কঠিন জিনিস চেয়েছিস রে! এই দুই গুণ এক করা আমার পক্ষেও কঠিন। যা, পুরোটা না হলেও একেকবারে অর্ধেকটা করে তোরা পাবি।’

সেই থেকে পাকিস্তানে গণতন্ত্র থাকলে যুদ্ধ হয় না, আর যুদ্ধবাজেরা এলে গণতন্ত্র থাকে না।

নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ শেষ হয় না পাকিস্তানে। এবার নিয়ে তৃতীয়বারের মতো ব্যর্থ হলেন নওয়াজ শরিফ। বিজয়ের হাসি হাসলেন যিনি, সেই ইমরান খান নিজেই সরকার গঠনে বারবার ব্যর্থ। এর মধ্যে কেউ মিঠাই খাচ্ছে, কেউ ভিরমি খাচ্ছে। ইমরানের অনুসারীরা মিঠাই বিলাচ্ছে আর নওয়াজের এক ভক্ত ঘটনার ধাক্কায় অক্কা গিয়েছেন। দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচন আগামী বছর। সেনাবাহিনীর স্নেহভাজন এই ‘কাপ্তান সাব’ সেই দিনের অপেক্ষায়। ক্রিকেটের বিজয়ী বোধহয় রাজনীতির পরাজয় আর মানতে পারছেন না। তাই নিয়েছেন বাঁকা পথ।

পাকিস্তানি গণতন্ত্র পাকিস্তানিদের মিষ্টিমুখ করাবে নাকি তাদেরও সহমরণের পথে নেবে, দেশটি আবার সেই সন্ধিক্ষণে। তেহরিক-ই-ইনসাফ প্রধান ইমরান খান সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দিয়ে নওয়াজ শরিফের বরখাস্ত দাবি করেছিলেন। যে যৌথ তদন্ত দলের (জেআইটি) প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নওয়াজ ক্ষমতা হারালেন, তাতে ছিলেন ইমরানের প্রকাশ্য সমর্থক থেকে শুরু করে প্রভাবশালী সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং এমআইয়ের সদস্যরাও। কাজেকাজেই, যৌথ তদন্ত প্রতিবেদনকে ‘ইমরান খানের সেবায়’ প্রণীত বলে অভিযোগ তুলেছেন নওয়াজের সমর্থকেরা।

নওয়াজ শরিফ একাই যাননি, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সহযাত্রী হয়েছেন ‘অযোগ্য’ ঘোষিত অর্থমন্ত্রীও। তাঁর সময়েই কিনা পাকিস্তানের অর্থনীতি জোরদার হচ্ছিল। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তাই শুধু গণতন্ত্রই ভড়কাল না, অর্থনীতিও থমকাল।

পাকিস্তানের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় ব্যর্থ প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে তিনজন বাঙালিও ছিলেন। খাজা নাজিমুদ্দীন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মোহাম্মদ আলী। আর হাল আমলে আদালতের রায়ে ধারাবাহিকভাবে ‘অযোগ্য’ ঘোষিত তালিকার মধ্যে ছিলেন পিপিপি নেতা প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিও। একইভাবে মোহাজের (এমকিউএম) নেতা আলতাফ হোসাইনও আদালতের রায়ে রাজনীতি ও স্বদেশ উভয় থেকেই নির্বাসিত। পাকিস্তানি রাজনীতির নক্ষত্র বেনজির ভুট্টোকেও বিদায় নিতে হয়েছিল আততায়ীর গুলিতে। তাঁর স্বামী সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি লুকোচুরি খেলে কোনোমতে টিকে আছেন। একে একে যখন অন্য সব বেসামরিক নেতা অপদস্থ, তখন পরের শিকার যে ইমরান খান হবেন না, তার নিশ্চয়তা কী? তাঁর মতো নওয়াজ শরিফও একদা সেনাবাহিনীর প্রিয় ছিলেন, কিন্তু যেই তিনি ‘রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র’ তথা ডিপ স্টেটকে সংযত করতে চাইলেন, অমনি ক্ষমতা হারালেন।

কোনো বেসামরিক নেতাই যখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সামলাতে চান এবং ভারতের সঙ্গে ‘শান্তি’র পথে হাঁটেন, তাঁকে চড়া মূল্য দিতে হয়। প্রেসিডেন্ট বা বিচার বিভাগের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুতি কিংবা সামরিক অভ্যুত্থান হলো তাঁদের রক্তপাতহীন শাস্তি। নওয়াজ শরিফ ক্ষমতাসীন হয়ে সংবিধান সংস্কার করে সেনা-অভ্যুত্থানের পথ বন্ধ করতে পারলেও, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অপসারণের আইনি ছিদ্রটা খোলাই ছিল। ‘সততা’ প্রমাণের সেই ছিদ্রপথেই নওয়াজের ক্ষমতার বাসরে সাপকে ঢুকল।

দৃশ্যত নওয়াজ শরিফের অপরাধ দুটি: এক. তিনি ভারতের সঙ্গে আপসপন্থা এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তা নিয়ে সেনাবাহিনীকে চটিয়ে দিয়েছিলেন। গত এপ্রিলের ভারতীয় শিল্পপতি সজ্জন জিন্দাল গোপনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। পাকিস্তান ও ভারতের গণমাধ্যমে এই সাক্ষাৎকে পেছন দরজার কূটনীতি বলা হয়। এবং দুই. কথিত রয়েছে, পররাষ্ট্রনীতির হাতিয়ার হিসেবে তিনি আইএসআইকে জঙ্গিদের কাজে লাগাতে নিষেধ করেছিলেন।

প্রশ্ন হলো, নওয়াজকে অপসারণে পানামা পেপার্সে বর্ণিত দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর বিচার কেন করা হলো না? উত্তর হচ্ছে, সেটা এক দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। সামনেই সিনেট নির্বাচন। আরও বেশি সময় পেলে নওয়াজ শরিফ নিজের হাত শক্তিশালী করতে পারতেন। বিষয়টাকে তিনি রাজনীতির মাঠে মোকাবিলার মওকা পেতেন।

এসব যুক্তিতেই পাকিস্তানের এই পালাবদলকে অনেকে ‘বিচার বিভাগীয় ক্যু’ বলতে চাইছেন। নকশাটা বুঝতে প্রথমেই পরিষ্কার করা দরকার যে পরিবারের কারও দুর্নীতির জন্য নওয়াজ শরিফ পদ হারাননি। পানামা পেপার্সে তাঁর নাম নেই, আছে ছেলেমেয়েদের নাম। উপমহাদেশে দুর্নীতিমুক্ত রাজনৈতিক নেতা সুন্দরবনের বাঘের মতোই বিরল ও বিপন্ন। পাকিস্তানি আদালত চাইলেই দুর্নীতির মামলাতেই নওয়াজকে গাঁথতে পারতেন। তবে তার জন্য সময় ও সুযোগ দরকার ছিল। হয়তো সে জন্যই আদালত বিচার তো পরের কথা, তদন্তকে সেদিকে নিলেনই না। ওই তামাদি তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে জাতীয় জবাবদিহি ব্যুরোর (এনএবি) কাছে। মামলা করলে তাঁরাই করবেন।

লন্ডনের ফ্ল্যাট, ক্যালিব্রি ফন্টে লেখা মিথ্যা চিঠি, কাতারি চিঠি, দুবাইয়ের কারখানা, দুর্নীতি কিংবা অর্থ পাচারের বিষয়গুলোকে তাই সংবিধানের ৬২ ও ৬৩ ধারায় বর্ণিত শপথভঙ্গের অপরাধের জন্য যথেষ্ট মনে করেননি আদালত! নওয়াজ শরিফ বরখাস্ত হয়েছেন বিমূর্ত ও অস্পষ্ট এক কাজের জন্য।

আদালতের রায়টি দাঁড়িয়ে আছে দুটি বিমূর্ত শব্দের অর্থের ওপর। একটি হলো ‘রিসিভেবল’ বা ‘আদায়যোগ্য’ এবং অন্য শব্দটি হলো ‘সম্পদ’। নওয়াজ শরিফ ‘আদায়যোগ্য’ একটি ‘সম্পদের’ খবর গোপন করেছিলেন। নির্বাসন থেকে ফিরে নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় এই আয়ের হিসাব তিনি দেননি। নওয়াজের পক্ষের যুক্তি হলো: ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের হাতে ক্ষমতা সঁপে দিয়ে নওয়াজ সৌদি আরবে নির্বাসন নেন। উপসাগরীয় দেশগুলোয় ভ্রমণের জন্য তখন তাঁর ‘আকামা’ বা নিয়োগপত্র দরকার হয়ে পড়েছিল। অতএব তিনি দুবাইয়ে ছেলের কোম্পানির পরিচালক হন এবং মাসিক বেতন হয় প্রায় তিন লাখ রুপি। যদিও সেই বেতন তিনি নেননি, ব্যাংক থেকে কখনো তোলেনওনি।

আদালতের যুক্তি হলো, যেহেতু ওই অর্থ তাঁর জন্য আদায়যোগ্য বা প্রাপনীয়, সেহেতু তা সম্পদের সমান। কিন্তু এ সম্পদের বিবরণ কেন মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হয়নি? সেই হাতে না পাওয়া টাকা ভবিষ্যতের ‘সম্পদ’ হয়, তবে সেই ‘সম্পদের’ হিসাব না দেওয়ায় নওয়াজ শরিফ ‘অসৎ’। অতএব তিনি পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার অযোগ্য। সুতরাং তিনি প্রধানমন্ত্রিত্বেরও অযোগ্য। এতগুলি ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’তে কুপোকাত হলো রাজনীতি!

আদালতের হিসাবটা সহজ হলেও রাজনীতির হিসাবটা বড়ই জটিল। সেই রাজনীতিতে কখন কার ‘দুর্নীতি’র বিচার হবে, আর কার দুর্নীতি বিচারের ঊর্ধ্বে থেকে যাবে, তা বলা কঠিন। পাকিস্তানের ঘটনার রাজনৈতিক শিক্ষা এটাই যে, কার বিচার হবে আর কারটা হবে না, তা ঠিক করার মালিক আর জনগণ নয়। তাহলেও রাজনীতির ময়দানে যে মার খেয়েও শেষ পর্যন্ত খাড়া থাকবে, জয় একদিন তার কাছে আসে। দেখা যাক, নওয়াজ না ইমরান, কার দম বেশি টেকে।

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]