কেউ কেউ কেন ধর্ষক হয়

চারদিক থেকে মাথাটা চেপে আছে। অসহনীয় পরিবেশ। পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেই ধর্ষণের খবর। অবুঝ শিশু থেকে বৃদ্ধ—কেউ বাদ যাচ্ছে না।

হঠাৎ দেশটার হলোটা কী? এত ধর্ষক কোত্থেকে আসে? পুরুষেরা কেন ধর্ষক হচ্ছে? নানান প্রশ্ন মাথার মধ্যে গিজগিজ করে।

পুরুষ বলেই নিজেকে নিজের কাঠগড়ায় তুলি। প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। মনে মনে ভাবি, আমার মতো কোনো পুরুষই তো ধর্ষক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। পুরুষের এই বর্বরোচিত অপরাধের ভাগীদার তো আমিও। আত্মগ্লানিতে মাথা হেঁট হয়ে যায়। অপরাধবোধ ভোগায়, তাড়িয়ে বেড়ায়।

মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ মেখলা সরকারের সঙ্গে কথা হলো। আচ্ছা, কেউ তো ধর্ষক হয়ে জন্মায় না। তাহলে পরবর্তী সময়ে একটা ছেলে বা পুরুষ কী করে ধর্ষক হয়?

পাল্টা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেন মেখলা সরকার। আগে বুঝতে হবে, সব পুরুষ কেন ধর্ষক হয় না? শিশুর বিকাশ তার চরিত্র গড়ে দেয়। ব্যক্তিত্ব নির্মাণ করে। চরিত্র বা ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য ব্যক্তির আচরণের ওপর প্রভাব ফেলে।

শুধু যৌনতার আকর্ষণ পুরুষকে ধর্ষক বানায় না। নিয়ন্ত্রণহীন যৌন আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি পুরুষের চারিত্রিক অবক্ষয়ের চরম পর্যায়—ধর্ষণ। ব্যক্তির বেড়ে ওঠা, তার পরিবেশ, শিক্ষা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি নিয়ামক বিবেচনায় নিয়ে একজন পুরুষের ধর্ষক হয়ে ওঠার গতিপথ নির্ণয় করা যায়।

সুস্থ পরিবেশ ও সুশিক্ষার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা পুরুষটি তার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আবেগের পরিণতি বাছবিচারের মাধ্যমে সঠিক আচরণ নির্ধারণ করতে পারে। তার নীতির জায়গাটি থাকে পোক্ত। আবেগ বা প্রলোভনে তার নৈতিকতায় ফাটল ধরে না। একজন ‘সুস্থ’ পুরুষ ধর্ষণের কথা ভাবতেও পারে না।

জন্মের পর প্রথম পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে একটি শিশুর ব্যক্তিত্বের গঠন সম্পন্ন হয়ে যায় বলে মত দিয়েছেন বিখ্যাত মনঃসমীক্ষক সিগমুন্ড ফ্রয়েড। তাঁর এই মত আমলে নিয়ে শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে অভিভাবকেরা মনোযোগী হলে অনেক সামাজিক ও মানসিক সমস্যার প্রতিকার সম্ভব। এ প্রসঙ্গে মেখলা সরকারের অভিমত, বিকাশকালকে গুরুত্ব না দিলে, যা ক্ষতি হওয়ার তা শৈশবেই হয়ে যায়।

আমাদের সমাজে ছোটবেলা থেকেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে একধরনের দূরত্ব তৈরি করে রাখা হয়। এই দূরত্ব বিশেষ করে মেয়েদের ব্যাপারে ছেলেদের একটি অনাবশ্যক ‘কৌতূহল’ তৈরি করে। মাত্রাতিরিক্ত ‘কৌতূহল’ বিধ্বংসী রূপ নিতে পারে, নেয়ও।

নারীর প্রতি পুরুষের বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষমতাকেন্দ্রিক। এই দৃষ্টিভঙ্গি পুরুষকে চেতনে বা অবচেতনে নারীর বিরুদ্ধে বল প্রয়োগে প্ররোচিত করে। নারীর ওপর পুরুষের যৌন সহিংসতা ব্যাখ্যায় ক্ষমতার প্রপঞ্চটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এ জন্য ছোট থেকেই পরিবারসহ সর্বত্র নারীর প্রতি পুরুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সাবলীল সম্পর্ক ও সমান অধিকারের শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া জরুরি।

অভিভাবকদের দায়িত্ব সন্তানকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য তাদের বুঝিয়ে দেওয়া। ছেলেকে ‘পুরুষ’ হিসেবে গড়ে না তুলে ‘মানুষ’ হিসেবে গড়ে তোলা।

পুরুষকে ধর্ষক বানানোর দায় শিক্ষাব্যবস্থার ওপরও বর্তায়। শিক্ষার উদ্দেশ্য সনদসর্বস্ব জনশক্তি তৈরি নয়। মানুষ গড়তে না পারলে শিক্ষা অর্থহীন। আমাদের দেশে যৌনশিক্ষা নিয়ে একটা ‘ছি ছি’ রব আছে। অথচ বিষয়টি যৌন সহিংসতার মতো অপরাধ নিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

ধর্ষণ রোধে কঠোর আইন ও তার সঠিক বাস্তবায়ন দরকার আছে। তবে সবার আগে ধর্ষক উৎপাদনের অনুষঙ্গ ও কারখানা সমূলে উৎপাটন করতে হবে। সেই কাজটা সমাজের, প্রশাসনের এবং সব মিলিয়ে সরকারের।

সাইফুল সামিন: সাংবাদিক
[email protected]