গায়ের কালো ভালো, মনের কালো ছাড়ো

ছবিটি প্রতীকী
ছবিটি প্রতীকী

‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ অথবা ‘নাচে নাচে রে মোর কালো মেয়ে’। এসব গান আমরা কমবেশি সবাই শুনেছি। পড়েছি ‘কালো জগতের আলো’। কিন্তু হৃদয়ে ধারণ করেছি কতটা?

চলতে-ফিরতে, বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে, বন্ধুর আড্ডায় কালো মেয়েদের এখনো তো কম হেয় করা হয় না। গায়ের রং কালো বলে মজার ছলে হলেও এখনো অনেক কথা শুনতে হয়, হজম করতে হয় মেয়েদের। কালো মেয়েদের তুলনায় বলাই বাহুল্য কালো ছেলেদের বিড়ম্বনা কম। কথায় বলে, সোনার আংটি বাঁকা হলেও ক্ষতি নেই।

আমাদের চিন্তাচেতনার মধ্যেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, কালো মানেই অসুন্দর, কালো মানেই ভয়, কালো মানেই অমঙ্গল। কালো বিড়াল, সেও অশুভ। সেই ধারণাকে আমরা মিলিয়ে ফেলি গায়ের রঙের সঙ্গে। আর তা বেশি করে ঘটে নারীদের বেলাতেই। গায়ের রং কালো বলে শৈশবে, কৈশোরে, এমনকি বার্ধক্যেও কটূক্তি শুনতে হয় নারীদের।

কালো মেয়েদের প্রতি সমাজে বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই মা-বাবা কখনো বলতে চান না, আমার মেয়ে কালো। বলেন, শ্যামলা। অথবা বলেন, গায়ের রং একটু চাপা। বিয়ের সম্বন্ধের সময় বলেন, ‘গায়ের রং চাপা হলেও মেয়ে দেখতে কিন্তু ভারী মিষ্টি।’ মফস্বল বা গ্রামাঞ্চলে গেলে এই কালো রংই হয়ে যায় ময়লা। মা-বাবা দুঃখ করে বলেন, ‘মেয়ের আমার গায়ের রং ময়লা। আল্লাহ দিছে। কী আর করা।’ গায়ের রং কালো বলে যৌতুক বেশি, বউকে নির্যাতন, এমনকি আত্মহত্যার মতো ঘটনা গণমাধ্যমে কম দেখা বা শোনা যায় না।

বলি কালো মেয়েদের নিয়ে নিজের দেখা বা শোনা কিছু অভিজ্ঞতার কথা।

আমার ছয় বছরের মেয়েকে নিয়ে একদিন শপিং মলে জামা কিনতে গেছি। মেয়ে বলে উঠল, ‘এই রং আমায় মানাবে না।’ শুনে অবাক হলাম। কোথা থেকে এল তার এই চিন্তা। জিজ্ঞেস করতে জানলাম, স্কুলের বন্ধু তাকে বলেছে, ‘তোর হাত কালো। আমার হাত সাদা।’ সেই থেকে মেয়ে বুঝে গেছে, কালো মানে খারাপ। কালোকে সব মানায় না।

বলি আমার সহকর্মীর অভিজ্ঞতা। এক সহকর্মী বলেন, অনেক দিন পর পুরোনো বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হয়েছে। দুই বান্ধবীর প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের পর বন্ধুর ছয়-সাত বছরের ছেলেটি হঠাৎ বলে উঠেছে, ‘মা, ওই আন্টি এত কালো কেন?’ বলাই বাহুল্য, তাঁর মা ফরসা। তিনি সন্তানকে শাসনও করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ওই ছোট্ট শিশুর মনে এমন বর্ণবাদী চিন্তা এল কোথা থেকে? নিশ্চয়ই সে তার চারপাশে এমন কথা শুনে শুনে অভ্যস্ত।

আসলে বৈষম্য মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ছোট্টবেলা থেকেই। রূপকথার গল্পে শিশুরা পড়ে, রানি আর রাজকন্যা মানেই দুধে-আলতা রং, মেঘবরণ চুল। আর রাক্ষুসী মানেই কালো রং, ভাটার মতো চোখ। কী প্রাচ্যে, কী পাশ্চাত্যে, কার্টুন মানেই ফরসা আর সুন্দরের ছড়াছড়ি। অ্যালসার রং ফরসা, সিনডেরেলা ফরসা। গোপাল ভাঁড়ের গল্পে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রানিও ফরসা।

রাজধানী ঢাকার একটি এলাকায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়া এক কিশোরী মেয়ের কথা শুনলাম। গায়ের রং নিয়ে কটূক্তি শুনতে শুনতে একপর্যায়ে ওই কিশোরী মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। সে যেখানেই যেত সবাই বলত, দেখতে সুন্দর। শুধু গায়ের রংটা একটু চাপা।

নাতনির জন্মের পর আরেক বৃদ্ধা আত্মীয়া গেছেন মেয়ের বাড়ি। তাঁর গায়ের রং কালো। কী কারণে নাতনি তাঁর কোলে আসতে চায় না। মেয়ের শ্বশুর ঠাট্টা করে বলে উঠলেন, ‘নাতনির কালো রং পছন্দ না।’

বেশি দূর যেতে হয় না। টিভি খুললেই চোখে পড়ে রং ফরসাকারী ক্রিমের যত বিজ্ঞাপন। সাহিত্যে, উপন্যাসে, সিনেমায়, গানে বা কবিতায় ফরসা, সুন্দরী মেয়ের পাশে কালো মেয়েরা বড়ই কোণঠাসা।

হয়তো অনেকে বলবেন, নারীরাই নারীদের গায়ের রং নিয়ে বেশি দুঃখ দেয়। কথাটি অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু নারীর এই মনোভাব তো এমনি এমনি গড়ে ওঠেনি। পুরুষতান্ত্রিক ভোগবাদী সমাজই তাঁদের অনেকের মনে সেই বীজ বুনে দিয়েছে। নারী যত ‘সুন্দর’, অর্থাৎ ফরসা, সমাজে তাঁর কদর তত বেশি। আর প্রচলিত ধারণা অনুসারে গায়ের রং তার সৌন্দর্য বিচারের মাপকাঠি। শৈশব থেকে যে নারী কালো বলেই নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন, অনেক সময় তিনিও অন্য নারীর সঙ্গে একই ধরনের আচরণ করেন। হয়তো সে আচরণের পেছনে মনের লুকানো প্রতিহিংসা কাজ করে।

চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে কালো রঙের উপকারিতার কথা। বেসরকারি একটি হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তানজিনা হোসেন বলেন, ‘আমাদের ত্বকে মেলানিন নামে একধরনের রঞ্জক পদার্থের মাত্রা বেশি হলে ত্বকের রং গাঢ় বা কালো হয়। এই মেলানিন সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করে। ফলে যাদের ত্বকে মেলানিন বেশি থাকে, অর্থাৎ যারা কালো, তাদের ত্বকের ক্যানসারের ঝুঁকি কম থাকে। এ কারণেই পাশ্চাত্যের দেশের শ্বেতাঙ্গরা ত্বকের ক্যানসারে বেশি আক্রান্ত হয়।’

মানুষ সৌন্দর্যের পূজারি। কিন্তু সৌন্দর্যের ধারণা যুগে যুগে, জাতিতে জাতিতে, এমনিক মানুষে মানুষেও এক নয়। সাধারণত, শাসকদের বর্ণ-চেহারার দাপটেই শাসিতদের মনে নিজেদের চেহারা নিয়ে হীনম্মন্যতা আসে। সৌন্দর্যের একক মডেল সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়াও একধরনের বর্ণবাদ ও বৈষম্য। গায়ের রং নিয়ে যে বৈষম্য, তা নিয়ে পাশ্চাত্যে শত বছর ধরে সংগ্রাম জারি আছে। একজন মানুষের এবং অবশ্যই নারীর আচরণ, বুদ্ধি, দক্ষতাই শেষবিচারে তাঁর মূল্যায়নের মাপকাঠি। তারপরও কথা থাকে, মানুষের জন্মগত, বংশগত, জাতিগত কোনো বৈশিষ্ট্যের কারণে বৈষম্য ও অসম্মান কোনোভাবেই সভ্যতা নয়।

ভেবে দেখুন তো ‘সংশপ্তক’ নাটকে স্বনামধন্য অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারের অভিনয়। আরেক দাপুটে অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা, হালের জনপ্রিয় অভিনেত্রী তিশা, বলিউডের নন্দিত অভিনেত্রী নন্দিতা দাশ, কাজল, কেউই ফরসা নন। নিজেদের সৌন্দর্য ও অভিনয়শৈলী দিয়ে তাঁরা মুগ্ধ করে রেখেছেন দর্শকদের। আমরা যখন মিতা হক, জয়িতা, বেবী নাজনীন, শুভমিতা, সোমলতা, শ্রেয়া ঘোষালের গান শুনি, তখন কি ভাবি তিনি কালো না ফরসা? প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর বা আশা ভোঁসলে কেউই কিন্তু ফরসা নন। গায়ের রং তাঁদের খ্যাতিতে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলেছে কী? ভেবে দেখুন ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেলের কথা।

তাই আসুন, রং ফরসাকারী ক্রিম মেখে বা রূপচর্চা করে গায়ের রং কালো থেকে ফরসা করার চেষ্টা ও প্রচার বাদ দিই। বরং দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর চেষ্টা করি। গায়ের রং নিয়ে কেউ কটূক্তি করলে প্রতিবাদ করুন মেয়েরা। জানিয়ে দিন, রং নিয়ে আপনি মোটেও বিচলিত নন। আর আমরা কেউ এমন মন্তব্য না করি, যা কারও মনঃকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারও মধ্যে হীনম্মন্যতার জন্ম দেয়। সেই সঙ্গে নিজেও বিশ্বাস করুন, সৌন্দর্য মানে গায়ের রং বা এ রকম কোনো একরোখা ধারণা নয়; বরং সুন্দর—সহজ, সাবলীল, বন্ধুত্বপূর্ণ ও মানবিক।