টানা বৃষ্টি না হলে বন্যার পানি কমবে: প্রকৌশলী সাজ্জাদ

সাজ্জাদ হোসেন
সাজ্জাদ হোসেন
দেশের অনেক জেলায়ই এখন থই থই বন্যার পানি। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে বন্যার কারণে অশেষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে দুর্গত মানুষ। এই পানি যখন ভাটির দিকে গড়াবে, তখন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হবে। ঘরবাড়ি নিয়ে বিপাকে পড়বে বন্যাকবলিত মানুষ। তাই তাদের জন্য বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কতা জরুরি। এ নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছেন বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন। আরও বলেছেন বন্যার নানা বিষয়ে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কমল জোহা খান

প্রথম আলো: জুলাই ও আগস্ট মাসে পরপর দুই দফা বন্যার কারণ কী?

সাজ্জাদ হোসেন: বন্যার প্রধান কারণ বৃষ্টি। শুধু জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর কারণে আমাদের নদ-নদী অববাহিকায় বৃষ্টি হয়। সেই বৃষ্টিপাতের কারণে আমাদের নদ-নদীতে পানি বাড়ে। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই পানি যখন স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে, তখন বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হবে। কোথাও কোথাও বন্যা হবে।

এখন বিষয় হচ্ছে, আমাদের তিনটি প্রধান নদী অববাহিকা রয়েছে। এগুলো মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা অববাহিকা। এই তিন অববাহিকার ৯৩ শতাংশ এলাকা দেশের বাইরে। বাকি ৭ ভাগ রয়েছে দেশের ভেতর। এসব অববাহিকা দিয়ে উজানের পানির ঢল আমাদের দেশের ভেতর আসে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার বেশির ভাগ এলাকা পড়েছে ভারত, ভুটান, চীনে। মেঘনা অববাহিকার এলাকার বেশির ভাগ এলাকা ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় রাজ্যে। আর গঙ্গা অববাহিকা চীন, নেপাল, ভারতের বিশাল অংশ বয়ে এসেছে বাংলাদেশে। এসব অঞ্চলে বর্ষাকালে টানা বৃষ্টি হলে নদ-নদীর পানি বেড়ে বন্যা হয়।

প্রথম আলো: বৃষ্টি ছাড়াও নদ-নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, নদী ভরাট হওয়া—এসব কি বন্যার পানি ছড়িয়ে পড়ার কারণ নয়?

সাজ্জাদ হোসেন: সেটা অন্য প্রেক্ষাপট। কারণ, এসব নদ-নদীতে ৩০ বছর আগে ১৯৮৮ সালে, এরপর ১৯৯৮ সালেও বন্যা হয়েছে। এর মধ্যে নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তনও হয়েছে। নদীর ক্যাপাসিটি বা পানি ধারণ ক্ষমতা যদি কমে যায়, তাহলেও বন্যা হতে পারে। ধারণ ক্ষমতা কমে গেলে বৃষ্টির পানি উপচে পড়ে বন্যা হতে পারে। যেমন ১০০ মিলিলিটার পানি একটা পাত্র ধারণ করতে পারে। যদি পাত্রটির ধারণ ক্ষমতা কমে যায়, তাহলে তো সেই পানি পাত্রটিতে ধরবে না।

প্রথম আলো: জুলাইয়ে প্রথম দফা বন্যায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা আর সুরমা-কুশিয়ারা অঞ্চলে। এর আগে এপ্রিলে হাওর অঞ্চলেও বন্যা হয়। এখন এই আগস্টেও বন্যা হচ্ছে। এটা কেন হলো?

সাজ্জাদ হোসেন: আমাদের বন্যার চরিত্র বিভিন্ন অববাহিকায় বিভিন্ন রকম। এই চরিত্রটার দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, মেঘনা অববাহিকায় এপ্রিলে আগাম একটা বন্যা হয়ে থাকে। মেঘালয়ে পাহাড়ের দিকে বৃষ্টির কারণে এটা হয়। অববাহিকায়, ত্রিপুরায় বৃষ্টি হয়ে থাকে। এটিকে বর্ষাকালের প্রাক-মৌসুমের বৃষ্টি বলা হয়। এই বৃষ্টিতে সিলেটের হাওর অঞ্চলে পানি এসে বন্যা হয়। এটিকে ফ্লাশ ফ্লাডও আমরা বলি। এরপর জুন মাস থেকে যখন বর্ষা মৌসুম শুরু হয়, তখন কিন্তু সিলেটে বৃষ্টি হয়, বন্যাও হয়। তাই এসব অঞ্চলে একাধিকবার নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে।

এবার আসেন ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দিকে। জুনে যেহেতু বর্ষাকাল শুরু হয়, তখন বৃষ্টিও হয় এবং আমরা পানির হাইড্রোগ্রাফগুলো দেখি, তাহলে এই অববাহিকায় জুলাই ও আগস্ট মাসে দুবার বন্যা হয়।

গঙ্গা অববাহিকায় জুলাই মাসের শেষে পানি বাড়ে। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে পানিটা বেড়ে বন্যা হয়। অর্থাৎ এখন যে বন্যাটা হচ্ছে—রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায়। তাই গঙ্গা অববাহিকায় বছরে একবারই বন্যা হয়।

গতকাল বুধবার রাতে জামালপুরের সরিষাবাড়ীর তারাকান্দি-ভুয়াপুর সড়কের একাংশ ভেঙে গেছে। ফলে জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ছবিটি আজ বৃহস্পতিবার সকালে তোলা। ছবি: শফিকুল ইসলাম
গতকাল বুধবার রাতে জামালপুরের সরিষাবাড়ীর তারাকান্দি-ভুয়াপুর সড়কের একাংশ ভেঙে গেছে। ফলে জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ছবিটি আজ বৃহস্পতিবার সকালে তোলা। ছবি: শফিকুল ইসলাম

প্রথম আলো: এই বন্যা এবার দীর্ঘায়িত হবে?

সাজ্জাদ হোসেন: টানা বৃষ্টি হলে বন্যা হবে—এটা সাধারণ কথা। আপনি যদি আবহাওয়ার পূর্বাভাস পেয়ে থাকেন, তাহলে আপনিও বলতে পারবেন—বন্যা কখন হবে। নদী অববাহিকায় কী পরিমাণ পানি হবে, সেই ধারণাও পাবেন।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই মুহূর্তে (গতকাল বুধবার) আমরা দেখছি বৃষ্টিপাতের পরিমাণটা কমে এসেছে। আমাদের উজানে আসাম, মেঘালয়েও বৃষ্টি কমে এসেছে। ওদেরও কমেছে, আমাদেরও কমেছে। এর ফলে আজ (গতকাল) থেকে ব্রহ্মপুত্রের পানি কমতে শুরু করেছে। এর আরেকটা কারণ হলো, ১০ থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, সেটাও আগের তুলনায় কমে এসেছে। এতে বন্যার পানি হ্রাসের দিকে চলে আসবে।

এখানে আরেকটা বিষয় বলে রাখি, অনেকে ১৯৮৮ সাল, ১৯৯৮ সালের তুলনা করেন। সেই বন্যাগুলোতে তিনটি নদী অববাহিকায় কিন্তু একই সঙ্গে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছিল। পানি যদি একই লেভেলে অতিক্রম করে, তখন কিন্তু বন্যা দীর্ঘায়িত হয়। মানুষের দুর্ভোগও বেড়ে যায়। এই তিনটি অববাহিকার পানি মেঘনা নদীর ওপর দিয়ে সাগরে চলে যায়। যখন তিনটি নদী অববাহিকার পানি একটি চ্যানেল দিয়ে যাবে, তখন কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই এই প্রবাহের ধারাটা ধীর হয়ে আসে। এ জন্যও বন্যা দীর্ঘায়িত হয়।

প্রথম আলো: এবারও কি তেমন পরিস্থিতি হচ্ছে?

সাজ্জাদ হোসেন: বিপৎসীমার ওপরে থাকলেও ব্রহ্মপুত্রের পানি কমতে শুরু হয়েছে—এটা ভালো কথা। গঙ্গার পানি বাড়ছে, তবে গতিটা কম। কয়েক দিন আগের তথ্য অনুযায়ী, মেঘনার পানিও বাড়ছিল। যমুনার পানিও বাড়ছিল। এ কারণে অনেকে বলছিলেন, তিনটি অববাহিকার পানি একসঙ্গে হবে কি না। সেটা আপাতত বলা যায় না। তবে ১৯৮৮, ১৯৯৮ সালে যে বন্যা হয়ছিল, সেগুলো কিন্তু আগস্টের শেষ দিকে হয়েছিল।

প্রথম আলো: কিন্তু দেশের মধ্যাঞ্চলে তো বন্যা পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে?

সাজ্জাদ হোসেন: এখন উত্তরাঞ্চলের পানি কমছে। এই পানি যমুনায় যাচ্ছে, মেঘনায় যাচ্ছে। এর সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গার পানি বাড়ছে। ফলে আমাদের মধ্যাঞ্চল, মানে ফরিদপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জের আরিচায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হবে, বন্যার আশঙ্কা আছে। তবে বন্যার পানি কমা শুরু করেছে। গঙ্গার পানি যদি তিন দিন পর কমে, বিপৎসীমার ওপরে থাকা যমুনার পানি আজ থেকে কমতে পারে। এটা বিপৎসীমার কাছাকাছি নেমে আসতে কমপক্ষে পাঁচ দিন লাগবে। তবে পানি প্রথম দিকে ধীরগতিতে কমে থাকে। কারণ, অমাবস্যার সময় সমুদ্রে পানির উচ্চতা বেড়ে যায়। তাই ভাটিতে পানি দেরিতে কমে। এই কমে যাওয়া বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করছে।

প্রথম আলো: দ্বিতীয় দফায় বন্যা তো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। আগেভাগে সতর্ক হওয়া যেত না?

সাজ্জাদ হোসেন: আসলে বন্যায় অন্য দেশের তুলনায় এখানে প্রাণহানি কম হয়। পানিবাহিত রোগ ও সাপের কামড়ে আমাদের দেশে প্রাণহানি ঘটে থাকে। শিশুরা পানিতে পড়ে মারা যায়। অন্যান্য দেশে পাহাড়ি ঢলে পানি দ্রুত নেমে মানুষ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সে তুলনায় আমাদের এখানে পানি ধীরে আসে। এ বিষয়ে আগাম সতর্কতার বিষয়টি হলো, আমাদের এখানে জুন-জুলাই মাসে সাধারণত বন্যা হয়। কিন্তু এটা কখন হবে, এটা চার-পাঁচ দিন আগে বোঝা যায়। আকাশের মেঘ, মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তা ও টানা বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে। যেমন ২৮ জুন থেকে বৃষ্টি হলে বলতে পারেন, জুলাইয়ের ৭-৮ তারিখে বন্যা হতে পারে। কিন্তু ১৫ জুলাই আপনি বলতে পারবেন না যে কখন বন্যা হবে। এটা আমি বলব—কঠিন কাজ।
প্রথম আলো: ধন্যবাদ আপনাকে।
সাজ্জাদ হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।