জনস্বাস্থ্যের কল্যাণে জাতীয় ঔষধ নীতি ২০১৬

গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা
গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা
২ আগস্ট ২০১৭, প্রথম আলোর আয়োজনে ‘জনস্বাস্থ্যের কল্যাণে জাতীয় ঔষধ নীতি ২০১৬’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

আলোচনায় সুপারিশ

* ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে বিচারিক ক্ষমতা প্রদান করা উচিত

* আমাদের দেশে ফার্মাসিউটিক্যাল গবেষণাকে উৎসাহিত করতে হবে

* ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে দক্ষ ফার্মাসিস্টদের িনয়োগ দেওয়া প্রয়োজন

* ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের জনবল বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে

* নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ ঠেকাতে অধিদপ্তরকে আরও কঠোর হতে হবে

* দেশের সব হাসপাতালে ফার্মেসিব্যবস্থা চালু করা জরুরি

* দেশের সব ফার্মেসিতে স্নাতক ফার্মাসিস্টের উপস্থিতি িনশ্চিত করা দরকার

* ওষুধের কাঁচামাল কালোবাজারে বিক্রি বন্ধ করতে হবে

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

১৯৮২ সালে যখন প্রথমবারের মতো জাতীয় ঔষধ নীতি প্রণয়ন করা হলো, তখন এটি নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহের সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ, এর আগে ওষুধ উৎপাদন ও ব্যবহারের বিষয়ে কোনো ধরনের নীতিমালা ছিল না। এরপর ২০০৫ সালে এই নীতি নবায়ন করা হয় এবং ২০১৬ সালে আবার এই জাতীয় ঔষধ নীতি নবায়ন করা হয়েছে।

আজকের গোলটেবিল বৈঠকে আমরা জাতীয় ঔষধ নীতি ২০১৬-এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করব।

এ কে আজাদ চৌধুরী
এ কে আজাদ চৌধুরী

এ কে আজাদ চৌধুরী

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ফার্মেসি িবভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

স্বল্পমূল্যে মানসম্মত ওষুধ জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া আমাদের জাতীয় ঔষধ নীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত। আমাদের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে কিছুটা হলেও বিচারিক ক্ষমতা প্রদান করা উচিত। কারণ, উন্নত বিশ্বের সব দেশের ঔষধ প্রশাসনেরই বিচারিক ক্ষমতা রয়েছে। ঔষধ  প্রশাসনের জনবল এমন শক্তিশালী হতে হবে, যেন এই অধিদপ্তর জনগণের মাঝে ওষুধের যৌক্তিক ও মানসম্মত ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে। আমাদের দেশের কত ভাগ মানুষ বর্তমানে মানসম্মত ওষুধের আওতায় আছে, সে সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য জরিপ নেই। স্কয়ার, ইনসেপ্টা, বেক্সিমকোসহ বেশ কিছু উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এখন বিশ্বমানের ওষুধ তৈরি করছে। কিন্তু ফার্মাসিউটিক্যাল গবেষণা আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। সে জন্য সরকারের উচিত, দেশে ফার্মাসিউটিক্যাল গবেষণাকে আরও উৎসাহিত করা।

আমাদের ওষুধ উৎপাদনে জনবলের মান বাড়াতে হবে।  ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট এবং ডাক্তাররা যদি একসঙ্গে কাজ না করেন, তাহলে আমাদের দেশে ওষুধের নিরাপদ ও সুষ্ঠু ব্যবহার কখনোই নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে সব পাবলিক ও প্রাইভেট হাসপাতালে ওষুধ মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ কমিটি থাকা উচিত।

তপন চৌধুরী
তপন চৌধুরী

তপন চৌধুরী

ব্যবস্থাপনা পরিচালক, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লি.।

ওষুধের সঠিক মান ঠিক রাখার  জন্য উচ্চমানসম্পন্ন গবেষণা করতে হয়। এ ধরনের গবেষণা করতে যে প্রযুক্তি ও দক্ষতার প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। আমাদের যদি উন্নত বিশ্বের নিয়ন্ত্রিত বাজারে প্রবেশের অনুমতি পেতে হয়, তাহলে সেসব দেশের নিয়ম মেনে ওষুধ তৈরি করতে হবে। আর সেই একই মানের ওষুধ আমাদের দেশের বাজারেও বিক্রি করতে হবে। দুই বাজারের ওষুধের মান একই হতে হবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা মানের তারতম্য করতে পারি না। আর এ কারণেই ওষুধের দামেরও কিছুটা তারতম্য হবে, এটাই স্বাভাবিক।

আমাদের ঔষধ প্রশাসনের নিরীক্ষকেরা যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের নিরীক্ষকদের চেয়ে কোনো অংশেই কম দক্ষ নন। তাঁরা উন্নত দেশের নিরীক্ষকদের মতোই আমাদের কারখানা পরিদর্শন করে থাকেন। তাঁরা উন্নত বিশ্বের নিরীক্ষকদের মতোই কঠোর। কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার মানসিকতা তাঁদের নেই।

গোলাম রহমান
গোলাম রহমান

গোলাম রহমান

সভাপতি, কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন (ক্যাব)।

আমাদের ঔষধ নীতিটি ওষুধশিল্পকেন্দ্রিক, ঔষধ নীতিটি আরও বেশি ভোক্তাকেন্দ্রিক হওয়া উচিত। ভোক্তা হিসেবে আমরা চাই স্বল্পমূল্যে মানসম্মত ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার যেন নিশ্চিত হয়। ঢাকা শহরে হয়তো ভালো ভালো কোম্পানির ওষুধ বিক্রি হয়ে থাকে, কিন্তু দেশের গ্রামাঞ্চলে এই মানসম্মত ওষুধগুলো বিক্রি হয় কি না, সেদিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নজর দেওয়া দরকার। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে নকল ভেজাল ওষুধগুলো অনেক বেশি পরিমাণে বিক্রি হয়ে থাকে। ওভার প্রেসক্রিপশন বলে একটা বিষয় আছে। অনেক সময় অনেক চিকিৎসক একই ধরনের ওষুধ বিভিন্ন ব্র্যান্ড নামে প্রেসক্রাইব করে থাকেন। বিষয়টি আমাদের সাধারণ ভোক্তাদের জন্য অনেক ব্যয়সাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।

রশিদ-ই-মাহবুব
রশিদ-ই-মাহবুব

রশিদ-ই-মাহবুব

সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন।

ওষুধের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকাভুক্ত ওষুধ ছাড়া অন্যান্য ওষুধের মূল্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো নিজেরা ঠিক করে। এখানে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। উন্নত বিশ্বে বিশেষজ্ঞ ফার্মাসিস্টদের নিয়ে গঠিত কমিটি ওষুধের উৎপাদনের খরচ বিবেচনা করে ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। যদিও বাংলাদেশে ওষুধের দাম তুলনামূলকভাবে অনেক কম, তারপরও এখানে স্বচ্ছতার একটি প্রশ্ন থেকে যায়।

আমাদের দেশের ওষুধশিল্প অনেক উন্নতি লাভ করেছে কিন্তু এর বিপণন নীতির দিকে সরকারের একটু নজর দেওয়া দরকার। তারা ওষুধ তৈরি করুক কিন্তু তাদের ওষুধ বিপণন নীতিটা ঠিক আছে কি না, সেটা সরকার বা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নজরদারি করতে পারে। কারণ, এ বিষয়টি নিয়ে অনেক সময়ই ডাক্তার এবং ওষুধশিল্প মালিকদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়ে থাকে।

মো. ইকবাল আর্সলান
মো. ইকবাল আর্সলান

মো. ইকবাল আর্সলান

সভাপতি, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট কর্তৃক পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মানুষের মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৬ শতাংশ শুধু ওষুধের জন্য ব্যয় হয়। আমাদের দেশে ১ হাজার ৪৫৮টি জেনেরিক নামের ২৮ হাজার ৬৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধ বিক্রি হয় এবং ওষুধের বাজারে বার্ষিক লেনদেন হয় আনুমানিক ২০ হাজার কোটি টাকা। সারা দেশে ২ লাখ ওষুধের দোকান এই ওষুধ বিতরণের কাজ করে থাকে। ৬০ থেকে ৭০ হাজার নিবন্ধিত যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসক  এগুলো লেখেন। এই বিশাল একটা ক্ষেত্রের প্রতিটি জায়গায় যদি আমরা দৃষ্টি না দিই, তাহলে আমাদের যে ঔষধ নীতি প্রণীত হয়েছে, তা কখনোই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ১৯৮২ সালের ঔষধ নীতিটিই শুধু আমরা ঠিকঠাক বাস্তবায়িত হতে দেখেছি। এরপর আর ঔষধ নীতি পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়নি। এর কারণ হলো, ১৯৮২ সালের ঔষধ নীতিটি অধ্যাদেশ আকারে অর্থাৎ আইন আকারে জারি হয়েছিল। এ ঔষধ নীতি যতক্ষণ পর্যন্ত আইন হিসেবে না আসবে, ততক্ষণ এটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

সুভাষ চন্দ্র সরকার
সুভাষ চন্দ্র সরকার

সুভাষ চন্দ্র সরকার

অতিরিক্ত সচিব, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়।

জাতীয় ঔষধ নীতি ২০১৬-এ মোট ৪৭টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা হবে। তবে এই লক্ষ্যমাত্রাগুলো দ্রুত ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য আমাদের ১৯৪০ সালের যে ঔষধ আইন রয়েছে, সেটিকে হালনাগাদ করতে হবে এবং এটিকে বাংলায় প্রণয়ন করতে হবে। এটির একটি খসড়া এরই মধ্যে প্রস্তুত করা হয়ে গেছে। দ্রুতই এটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের জনবল বাড়ানোর জন্য ২ হাজার ২৩৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি সাংগঠনিক কাঠামো অনুমোদনের জন্য  প্রস্তাব আমরা পেয়েছি। এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে আমরা শিগগিরই জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে পর্যাপ্তসংখ্যক জনবল এই অধিদপ্তরে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করব। এই জনবল নিয়োগ হলে আশা করি জাতীয় ঔষধ প্রশাসন নীতি বাস্তবায়ন আরও সহজ হবে।

মো. শহিদুল্লাহ
মো. শহিদুল্লাহ

মো. শহিদুল্লাহ

সভাপতি, বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন ও বিএমডিসি।

ঔষধ নীতিতে ৪৭টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো ওষুধের মানসম্মত ও যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এটি খুবই ভালো একটি উদ্যোগ, তবে এটি বাস্তবায়ন করা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিরাট  চ্যালেঞ্জের বিষয়। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে যে একটি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হবে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ, বাংলাদেশে যে হারে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হচ্ছে, তাতে আজ থেকে ১০ বা ১৫ বছরের মধ্যে এ দেশের মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে যাবে। আমরা তখন সাধারণ সংক্রমণ থেকে মৃত্যুর হুমকির সম্মুখীন হবে। আমাদের দেশের কিছু ওষুধ কোম্পানি খুব চতুরতার সঙ্গে তাদের ওষুধের মেয়াদ নিয়ে লুকোচুরি করে থাকে। সব ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এ কাজ করে না, কিন্তু কিছু প্রতিষ্ঠান এই অনৈতিক কাজটি করে থাকে। বিষয়টির দিকে আমাদের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নজর দিতে হবে।

আ ব ম ফারুক
আ ব ম ফারুক

আ ব ম ফারুক

অধ্যাপক, ঔষধ প্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মানসম্মত ওষুধ পাওয়া মানুষের অধিকার। আমাদের দেশের শীর্ষ ১০টি কোম্পানি মানসম্মত ওষুধ তৈরি করছে আর সেই ওষুধ প্রেসক্রাইব করে আমাদের চিকিৎসকেরা নিশ্চিন্ত অনুভব করছেন, এটা দুঃখজনক। কেন বাকি কোম্পানিগুলো মানসম্মত ওষুধ তৈরি করতে পারছে না, সেটা আমাদের ভাবতে হবে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে যে নিয়োগগুলো হচ্ছে, সেখানে দুঃখজনকভাবে আমরা দেখছি যে ফার্মাসিস্টের সংখ্যা খুবই কম। যাঁরা ওষুধ নিয়ে কাজ করছেন বা এ কাজে দক্ষ, সেই ফার্মাসিস্টদের সংখ্যা অধিদপ্তরে বাড়াতে হবে। ওষুধের কাঁচামাল কালোবাজারে বিক্রি বন্ধ করতে হবে। কালোবাজারে কাঁচামাল বিক্রি বন্ধ করতে না পারলে আমরা নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন কখনোই বন্ধ করতে পারব না। পৃথিবীর কোনো দেশে ওষুধ উৎপাদনের কাঁচামাল এভাবে খোলাবাজারে বিক্রি হয় না।

Mosaddek-Hossen(1)
Mosaddek-Hossen(1)

মো. মোসাদ্দেক হোসেন

সহসভাপতি, ফার্মেসি কাউন্সিল অব বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে ওষুধ বিতরণ কার্যক্রমে বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল কর্তৃক নিবন্ধিত স্নাতক ফার্মাসিস্টদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান থাকার কথা। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ডাক্তার এবং নার্সের পাশাপাশি স্নাতক ফার্মাসিস্ট যুক্ত হলে তা পূর্ণতা লাভ করবে। এর ফলে জনগণ সুফল পাবে, স্বাস্থ্যসেবা উন্নত হবে, সঠিক ওষুধ সঠিক মাত্রায় পরিবেশিত হবে। এ যুগান্তকারী ঔষধ নীতি ২০১৬ বাস্তবায়নের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে। এই টাস্কফোর্স একটি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে জাতীয় ঔষধ নীতি ২০১৬ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করবে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের সহযোগিতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় ২০০ মডেল ফার্মেসি তৈরি করা হয়েছে। এই মডেল ফার্মেসিগুলোতে স্নাতক ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাঁরা রোগীদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ প্রদান করবেন এবং তার সঙ্গে সঙ্গে সঠিক পরিমাণ ও সেবনপদ্ধতি সম্পর্কে রোগীদের অবহিত করবেন। তাঁরা রোগীদের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও অবহিত করবেন।

এস এম আব্দুর রহমান
এস এম আব্দুর রহমান

এস এম আব্দুর রহমান

ডিন, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আমাদের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরি তৈরি করা। শুধু এই প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করে দিলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না, এই প্রতিষ্ঠানগুলো যেন কার্যকরভাবে কাজ করে, সে জন্য এখানে দক্ষ জনবল অর্থাৎ দক্ষ স্নাতক ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দিতে হবে। পাশাপাশি আমাদের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে দক্ষ ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ দিয়ে এর পরিধি ও কর্মক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে অনতিবিলম্বে হাসপাতাল ফার্মেসিব্যবস্থা চালু করতে হবে। উন্নত বিশ্বে ফার্মাসিস্টরা হাসপাতালের ফার্মেসিতে কাজ করেন এবং এই ফার্মেসিতে ওষুধ সংরক্ষণ ও বিতরণের কাজগুলো হয়ে থাকে।

মো. মিজানুর রহমান
মো. মিজানুর রহমান

মো. মিজানুর রহমান

পরিচালক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ।

আমাদের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর তাদের সীমিত জনবল নিয়ে যে বিশাল একটি কাজে হাত দিয়েছে, তা এই অধিদপ্তর একা কখনোই বাস্তবায়ন করতে পারবে না। এটি বাস্তবায়নে আমাদের সবাইকে অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। আমি আশা করব, ঔষধ প্রশাসন মন্ত্রণালয় একদিকে যেমন ভোক্তাদের কাছে মানসম্মত ওষুধ পৌঁছে দিতে কাজ করবে, অন্যদিকে তারা আমাদের সম্ভাবনাময় ওষুধশিল্পের বিকাশেও প্রয়োজনীয় সহায়তা করবে।

ওষুধের মান নিশ্চিত করতে হলে আমাদের ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরি বা এনসিএলকে শক্তিশালী ও উন্নত মানের করতে হবে। আমি যদি ওষুধের মানই ঠিকমতো নির্ধারণ করতে না পারি, তাহলে আমি কী করে ওষুধের উন্নত মান নিশ্চিত করব? আমাদের দেশের চিকিৎসকেরা শীর্ষ ১০টি কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রাইব করছেন, কিন্তু নিম্নমানের অন্য কোম্পানিগুলোর ওষুধ তো চলছে। একজন ক্রেতা যখন প্রেসক্রিপশন নিয়ে ফার্মেসিতে যাচ্ছেন, তখন বিক্রেতা প্রেসক্রাইব করা ওষুধ না দিয়ে অন্য কোম্পানির ওষুধ দিয়ে দিচ্ছেন। কারণ, এতে করে বিক্রেতা কমিশন বেশি পান। বিষয়টির দিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নজর দেওয়া উচিত।

মোমেনুল হক
মোমেনুল হক

মোমেনুল হক

উপদেষ্টা, ঔষধ শিল্প সমিতি।

দেশের মোট ওষুধের চাহিদার ৯৮ শতাংশ দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে, এমন সাফল্য আমাদের দেশের আর কোনো শিল্প খাত কিন্তু দেখাতে পারেনি। ভবিষ্যতে এই সক্ষমতা আরও বাড়বে। দেশের ওষুধশিল্প উদ্যোক্তারা অনেক বড় অঙ্কের মূলধন এই শিল্পে বিনিয়োগ করছেন। কিন্তু সেই তুলনায় আমাদের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের জনবল খুবই কম। এই স্বল্প জনবল নিয়েও তারা যে বিশাল একটি কাজে হাত দিয়েছে, তার জন্য তারা  প্রশংসা প্রাপ্য।

জাতীয় ঔষধ নীতি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হলে আমাদের দেশের ওষুধশিল্প আরও এগিয়ে যাবে। আর এ জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে অনেক দক্ষ ফার্মাসিস্ট তৈরি করছে। আগে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে পড়ার সুযোগ ছিল; কিন্তু এখন দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেও অনেক দক্ষ ফার্মাসিস্ট তৈরি হচ্ছে। ফলে আমাদের দক্ষ জনবলের কোনো অভাব নেই, শুধু এই জনবলকে কাজে লাগাতে হবে।

জামাল উদ্দিন চৌধুরী
জামাল উদ্দিন চৌধুরী

জামাল উদ্দিন চৌধুরী

সদস্য, কার্যকরী পরিষদ, বিএমএ।

জাতীয় ঔষধ নীতিতে প্রয়োজনীয় ওষুধের যে তালিকা করা হয়েছে, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রণীত তালিকা থেকে ভিন্ন। যদিও নতুন প্রণীত তালিকায় আগের চেয়ে ওষুধের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তারপরও এই তালিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত।

এই নীতিতে একটি জাতীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হয়েছে কিন্তু এই কর্তৃপক্ষ কীভাবে গঠিত হবে, তা উল্লেখ করা নেই। বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকার। উন্নত বিশ্বের মতো এই ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ওষুধশিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠন করলে এটি অনেক বেশি কার্যকর হবে। নীতিতে বলা হয়েছে, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে খাদ্য ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর হিসেবে গড়ে তোলা হবে। বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা এ দুটি বিষয়কে একটি অধিদপ্তরের অধীনে আনতে কতটা প্রস্তুত, তা নিয়ে আমার কিছুটা সন্দেহ আছে।

মো. আবদুল হাই
মো. আবদুল হাই

মো. আবদুল হাই

সহসভাপতি, বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি।

নকল ও ভেজাল ওষুধ বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের জন্য একটি বড় হুমকি। কিছুদিন আগে উচ্চ আদালতের নির্দেশে নকল ও ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারী কিছু কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও আমাদের দেশে বহু কোম্পানি রয়ে গেছে, যারা এখনো নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে। বাংলাদেশে দুই শতাধিক অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী কারখানা রয়েছে, কিন্তু বাজারে মাত্র ৮০ বা ১০০টি কোম্পানির ওষুধ পাওয়া যায়। তাহলে বাকি কারখানাগুলো কী বানায় আর কী বিক্রি করে, তা সরকারের আরও ভালোভাবে দেখা উচিত। ওষুধ বিপণনের ক্ষেত্রে বিনা লাইসেন্সে ওষুধ বিক্রি বন্ধে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। সারা দেশে বর্তমানে ১ লাখের অধিক লাইসেন্সধারী ওষুধ ব্যবসায়ী রয়েছেন, কিন্তু বাস্তবে দেশে ওষুধের দোকানদারের সংখ্যা এরচেয়ে অনেক বেশি। সরকার যত দিন বিনা লাইসেন্সে ওষুধের ব্যবসা বন্ধ করতে না পারবে, তত দিন দেশে নকল ও ভেজাল ওষুধের বিপণনও বন্ধ করা যাবে না।

মো. রুহুল আমিন
মো. রুহুল আমিন

মো. রুহুল আমিন

পরিচালক, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।

বাংলাদেশের ওষুধশিল্প দ্রুত বিকাশমান একটি শিল্প খাত। বিশ্বমানের ওষুধ বাংলাদেশে উৎপাদন হচ্ছে। বাংলাদেশের ওষুধের চাহিদার ৯৮ শতাংশ আমাদের দেশের ওষুধশিল্প পূরণ করতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপসহ বিশ্বের ১৪০টি দেশে বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানি করছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রপ্তানি হয়েছে ৮১২ কোটি টাকার, যা ২০১৬ সালে বেড়ে ২ হাজর ২৪৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ২০১৭ সালে এই রপ্তানির পরিমাণ আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮৫০টি। ১ হাজার ৪৫৮টি অ্যালোপ্যাথিক জেনেরিকের নিবন্ধিত ওষুধের সংখ্যা  ২৮ হাজার ৬৩টি। সারা বিশ্বে ওষুধশিল্পে ওষুধ উৎপাদনে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের এই অগ্রগতির সঙ্গে সমান তালে চলা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে তৃতীয়বারের মতো ঔষধ নীতি প্রণয়ন করা হয়। এই ঔষধ নীতিতে ওষুধ নিয়ন্ত্রণে অধিকতর কার্যকর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, গুণগত মানসম্পন্ন নিরাপদ ওষুধ এবং ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা, ওষুধশিল্পের উৎকর্ষ সাধন, ওষুধবিষয়ক গবেষণা ও ওষুধের রপ্তানি বৃদ্ধির বিষয়ে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা রয়েছে।

মো. শাহাদাৎ হোসেন
মো. শাহাদাৎ হোসেন

মো. শাহাদাৎ হোসেন

যুগ্ম সচিব ও পরিচালক, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর একই সঙ্গে ভোক্তা এবং ব্যবসায়ী দুই পক্ষের অধিকার সংরক্ষণের জন্য কাজ করে থাকে। আমাদের ওষুধগুলো উৎপাদন করা হয় মূলত ভোক্তাদের জন্যই।  কিন্তু একশ্রেণির প্রতারক ব্যবসায়ী এই ওষুধগুলোর বিক্রয় ও বিপণনের সময় ভোক্তাদের সঙ্গে নানাভাবে প্রতারণা করে থাকে। যেমন তাঁরা যে মূল্য ওষুধের মোড়কে লেখা থাকে, তার ওপর নিজেরা নিজেদের ইচ্ছেমতো মূল্য দিয়ে আরেকটি স্টিকার লাগিয়ে দেন। অনেক সময় তাঁরা ওষুধের মূল্যতালিকা প্রদর্শনই করেন না। তা ছাড়া ভেজাল, নিম্নমানের ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ তারা বিক্রি করেন। এসব প্রতারক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আমাদের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের টিমগুলো সদা তৎপর। আমাদের টিম দেশের প্রতিটি থানা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে এসব অসৎ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। তা ছাড়া আমাদের অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারা দেশে ভোক্তাদের সচেতন করার জন্য বিভিন্ন প্রচার–প্রচারণাও চালানো হচ্ছে।

নিজাম উদ্দিন আহমেদ
নিজাম উদ্দিন আহমেদ

নিজাম উদ্দিন আহমেদ

িনর্বাহী পরিচালক, সিনোসিস হেলথ।

আমাদের জাতীয় ঔষধ নীতি একটি যুগোপযোগী নীতি, তবে এই নীতিমালাকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। যাঁরা ওষুধ ব্যবহার করেন, তাঁদের জানাতে হবে ঔষধ  নীতির আওতায় তাঁরা কী কী সুবিধা পেতে পারেন।  আর এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

আমরা চিকিৎসকেরা বর্তমানে দেশের শীর্ষ ১০টি কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রাইব করে থাকি। বাকি কোম্পানিগুলোর ওষুধ কেন প্রেসক্রাইব করছি না। শীর্ষ ১০টি কোম্পানি ছাড়াও অন্য কোম্পানিগুলো অনেক ভালো ওষুধ তৈরি করছে। কিন্তু আমরা সেসব ওষুধের মান সম্পর্কে নিশ্চিত নই বলে তা প্রেসক্রাইব করছি না। আমাদের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের দেশে উৎপাদিত সব ওষুধের সঠিক মান নিশ্চিত করার জন্য কাজ করা দরকার।

মো. সালাহউদ্দিন
মো. সালাহউদ্দিন

মো. সালাহউদ্দিন

সহকারী পরিচালক, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।

আমাদের দেশ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে ছিল। আমাদের জিসিপি (গুড ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিস) গাইডলাইন ২০১৫ সালে প্রণয়ন হয়েছে এবং সেটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। আমাদের আটটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল প্রটোকল চূড়ান্ত করা হয়েছে এবং সামনের দিনগুলোতে আমাদের আরও কয়েকটি প্রটোকল চূড়ান্ত করার জন্য সভা ডাকা হয়েছে। আমাদের কাজ চলছে এবং এই কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারলে অবস্থার আরও উন্নতি হবে বলে আশা করছি। দেশে ওষুধশিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে।

বিনয় দাস
বিনয় দাস

বিনয় দাস

হেড অব মার্কেটিং, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস িল.।

বাংলাদেশে মূলত দুইভাবে নকল ও ভেজাল ওষুধ বাজারে পাওয়া যায়। একটি হচ্ছে একই রকম দেখতে, আরেকটা হচ্ছে হুবহু নকল ওষুধ। আমাদের দেশের বড় বড় ব্র্যান্ডের ওষুধগুলোর মোড়ক হুবহু নকল করে তৈরি করা ওষুধ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাওয়া যায়। বিষয়টি আমাদের ওষুধ উৎপাদনকারীদের অনেক বেশি ভোগাচ্ছে। এই নকল ওষুধগুলো কোথায় উৎপাদিত হচ্ছে এবং কারা এটি বাজারজাত করছে, তা অনুসন্ধান করে বের করে বন্ধ করা গেলে নকল ওষুধের দৌরাত্ম্য অনেক কমে যাবে। নকল ওষুধ বন্ধ হলে ভোক্তারা প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পাবেন। সবাই তখন মানসম্মত ওষুধ তৈরি করতে চেষ্টা করবে। অসুস্থ মানুষেরা ভালো ওষুধ পাবেন।

আব্দুল কাইয়ুম: গণমাধ্যম হিসেবে আমাদের যে ভূমিকা, সেটি আমরা পালন করার চেষ্টা করি। জতীয় ঔষধ নীতির জনকল্যাণের দিকগুলো আমরা তুলে ধরব। জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা অনেক ইতিবাচক সংবাদ পত্রিকায় ছাপাই। সাফল্যের সংবাদগুলো তুলে ধরার মাধ্যমে আমরা মানুষকে সব সময় অনুপ্রেরণা জোগাতে চেষ্টা করি। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন।

মোহাম্মদ নাসিম
মোহাম্মদ নাসিম

মোহাম্মদ নাসিম

সাংসদ, মন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়।

আমরা দীর্ঘ প্রতীক্ষিত একটি ঔষধ নীতি পেয়েছি আর এই ঔষধ নীতির পরিপ্রেক্ষিতেই খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঔষধ আইন প্রণয়ন করা হবে। কিছুদিন আগে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তিনি বিশেষভাবে বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের উন্নতির প্রশংসা করেছেন এবং সরকারিভাবে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ নেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

স্বাধীনতার ঠিক পরে বাংলাদেশের মোট ওষুধের চাহিদার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। কিন্তু এখন মাত্র ২ শতাংশ ওষুধ আমাদের আমদানি করতে হয়।

দেশে ওষুধ বিতরণব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য আমরা দেশের বিভিন্ন জেলায় মডেল ফার্মেসি তৈরি করেছি। ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায়সহ সিরাজগঞ্জ, খুলনা ও নোয়াখালীতে আমি গিয়ে এসব মডেল ফার্মেসির উদ্বোধন করেছি। এই ফার্মেসিগুলোতে একটি আধুনিক ও মানসম্মত ফার্মেসিতে যে উপাদানগুলো থাকা দরকার, তার সবই থাকবে।

আমাদের দেশের বেশ কয়েকটি ওষুধ কারখানা আমি পরিদর্শন করেছি। আমাদের দেশের ওষুধ কারখানাগুলো বিশ্বমানের। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টও বেশ কয়েকবার কয়েকটি ওষুধ কারখানা পরিদর্শন করে প্রশংসা করেছেন। তবে সব কারখানার মান এক নয় এটা ঠিক এবং এই মান নিশ্চিত করার জন্য আমাদের ঔষধ প্রশাসনের জনবলের সংকট রয়েছে। আমার কাছে ২ হাজার ২৩৭ জনের একটি চাহিদা দেওয়া হয়েছে। জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল এবং দীর্ঘ। তারপরও আমি আশ্বস্ত করছি, খুব দ্রুত এই জনবল নিয়োগের ব্যবস্থা করব।

সাম্প্রতিক কার্ডিয়াক স্টেন্ট (হার্টের রিং), ইন্ট্রাঅকুলার (চোখের) লেন্স, অর্থোপেডিক ইমপ্ল্যান্ট ইত্যাদি মেডিকেল ডিভাইসের রেজিস্ট্রেশন প্রদান ও মূল্য নির্ধারণের ফলে জনগণ সঠিক মূল্যে মানসম্পন্ন সেবা পাচ্ছে। কার্ডিয়াক স্টেন্ট ও ইন্ট্রাঅকুলার লেন্সের নির্ধারিত মূল্যতালিকা সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। এসব কাজের মধ্য দিয়ে গুণগত, মানসম্পন্ন ওষুধ ও মেডিকেল ডিভাইস সুলভ মূল্যে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হচ্ছে।

ওষুধশিল্পের উন্নয়নের জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় মুন্সিগঞ্জে ওষুধশিল্পের জন্য একটি সক্রিয় ফার্মাসিউটিক্যাল উপাদান (এপিআই) পার্ক গড়ে তোলার কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।

এই ঔষধ নীতি বাস্তবায়নের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হবে। এই ঔষধ নীতি বাস্তবায়িত হলে দেশের সর্বস্তরের মানুষ অধিকতর মানসম্পন্ন ওষুধ পাবে, ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত হবে এবং ওষুধের রপ্তানি আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আমি মনে করি। আপনারা বিশ্বদরবারে মানসম্মত ওষুধ রপ্তানি করে আমাদের দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনেন, সেটা আমরা চাই, তবে সবার আগে আমাদের দেশের মানুষের মন জয় করতে হবে। দেশের মানুষের জন্য সুলভ মূল্যে মানসম্মত ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

মো. মোস্তাফিজুর রহমান
মো. মোস্তাফিজুর রহমান

মো. মোস্তাফিজুর রহমান

মহাপরিচালক, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।

আমরা জাতীয় ঔষধ নীতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ওষুধশিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কাজ করছি। ফার্মাকো ভিজিল্যান্সের কাজ চলছে, মডেল ফার্মেসি করা হচ্ছে, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হচ্ছে, পোস্ট মার্কেট সার্ভেল্যান্স চলছে, বাজার থেকে নিয়মিতভাবে নমুনা সংগ্রহ করে তার মান পরীক্ষা করা হচ্ছে।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের সঙ্গে মিলে আমরা তৃণমূল পর্যায়ে নকল ও ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছি। অনেকেই নকল ও ভেজাল ওষুধ নিয়ে তাঁদের হতাশার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু আপনি যদি সারা বিশ্বের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করেন, তাহলে দেখবেন অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে নকল ও ভেজাল ওষুধের মাত্রা অনেক কম। আমাদের পাশের দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানেই এই হার অনেক বেশি। তারপরও নকল ও ভেজাল ওষুধ বাজার থেকে একেবারে নির্মূল করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করাটাই মূল বিষয়। আমাদের ঔষধ প্রশাসনের জনবল বৃদ্ধি করছি। দক্ষ জনবল নিয়োগের মাধ্যমে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাংগঠনিক কাঠামোকে উন্নত বিশ্বের ঔষধ  প্রশাসন সংস্থাগুলোর মতো শক্তিশালী করে তৈরি করব।

কিছু কিছু কোম্পানি ওষুধ প্রস্তুতের সময় মান বজায় রাখছে না, আমরা নিয়মিত তাদের ওপর নজর রাখছি এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। একটি কারখানা আপনি রাতারাতি বন্ধ করে দিতে পারেন না। কারণ, এখানে অনেক লোকের কর্মসংস্থান জড়িত। কিন্তু আমরা কোনো অনিয়ম পেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। আর নকল ও ভেজাল ওষুধ কোনো কারখানায় তৈরি হয় না। এগুলো ঘরের মধ্যে ছোট আকারের যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি করে বাজারে ছাড়া হয়। আমরা ভেজাল ওষুধ নির্মূলে কাজ করে যাচ্ছি।

স্টেম সেল থেরাপি, জিন থেরাপি চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন সংযোজন বায়োলজিকস ও বায়োসিমিলার ড্রাগস, ভ্যাক্সিনস এবং মেডিকেল ডিভাইসের রেজিস্ট্রেশন ঔষধ প্রশাসন প্রদান করছে। ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল প্রটোকল এবং সিআরও অনুমোদন কার্যক্রম ঔষধ প্রশাসন পরিচালনা করছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এসব আধুনিক বিষয় সার্বিক মূল্যায়ন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য কর্মকর্তাদের দেশে–বিদেশে প্রশিক্ষণ একান্ত প্রয়োজন।

জাতীয় ঔষধ নীতির বিভিন্ন বিষয় বাস্তবায়নের জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধি আবশ্যক বিধায় ২ হাজার ২৩৭ জনবলসংবলিত প্রস্তাবিত অর্গানোগ্রাম মন্ত্রণালয়ের জরুরি ভিত্তিতে অনুমোদন প্রয়োজন। ন্যাশনাল রেগুলেটরি অথরিটি এবং ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরির বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি প্রাপ্তির জন্য বাজেট বৃদ্ধি এবং ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরির জন্য নতুন সৃষ্ট ৬২টি পদে নিয়োগের জন্য মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বসে নেই। আমরা এ নীতি বাস্তবায়নে বিশাল দায়িত্ব পালনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এর সুফল খুব দ্রুতই দেশের মানুষ পাবে বলে আশা করি।