'সিল্ক হ্যাভেন রাজশাহী'

আজ বৃহস্পতিবার রাজশাহীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসছেন। এর আগে এসেছিলেন ২০১১ সালের নভেম্বরে। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে রাজশাহীর মানুষ অনেক স্বপ্ন দেখেছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১৪ দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়েছিল। বড়ই আশার কথা, এবার প্রধানমন্ত্রী রাজশাহীতে হাইটেক পার্কসহ ১৬টি প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন। হাইটেক পার্ক নিয়ে ইতিমধ্যে রাজশাহীর মানুষ অনেক স্বপ্ন দেখছে। সেখানে বিপুল পরিমাণ মানুষের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সঙ্গে ইতিমধ্যে রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। তবে এই ১৪ দফার মধ্যে ছিল রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী মৃতপ্রায় রেশমশিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। গৌরবের কথা, ইতিমধ্যে রাজশাহীকে ‘সিল্ক হ্যাভেন রাজশাহী’ হিসেবে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে। জেলার অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রাজশাহীর জন্য রেশমের পরিচয়ই বড়। ব্র্যান্ডিং যথার্থ হয়েছে, এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। তবে শুধু এই নাম রাজশাহীর মানুষের জন্য গৌরবের হলেও তাদের মনে শান্তি নেই। রাজশাহীর মানুষের কাছে রেশমের ব্র্যান্ডিংটা সিনেমার একটি গানের মতোই শোনাচ্ছে। ‘রাজা নাই শাহী নাই রাজশাহী নাম/হাতিঘোড়া কিছু নেই আছে শুধু আম।’
‘নির্বাচিত হলে রাজশাহীর বন্ধ রেশম কারখানা খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন’—নির্বাচনী ইশতেহারে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি রাজশাহী সদর আসনে দ্বিতীয়বারের মতো সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন, কিন্তু রাজশাহী রেশম কারখানা বন্ধই রয়েছে। এদিকে ঠাকুরগাঁও রেশম কারখানাটি চালু করার বিষয়ে সম্ভাব্য সমীক্ষা সম্পাদনের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন রাজশাহীর মানুষের দাবি, রাজশাহীর রেশম কারখানাটিও খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হোক। তাহলে রাজশাহী ফিরে পাবে রেশমের ঐতিহ্য। রক্ষা হবে সাংসদের প্রতিশ্রুতি। (প্রথম আলো, ৩০ মার্চ, ২০১৭)
রেশম কারখানা বন্ধ করার সময় এর প্রায় ৩০০ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। পাশাপাশি রেশমকে ঘিরে আরও প্রায় ৫০ হাজার পলুচাষি বিপাকে পড়েন। সে সময় আন্দোলন করেও কারখানাটি চালু করতে পারেনি রাজশাহীবাসী। হতাশা থেকে এ অঞ্চলের পলুচাষিরাও চাষ কমিয়ে দেন। এই অবস্থায় রেশমকে রাজশাহীর ব্র্যান্ডিং করার বিষয়টি রাজশাহীর মানুষের সঙ্গে তামাশা করার মতোই বটে। তাদের দাবি, ঠাকুরগাঁওয়ের কারখানাটি খোলার উদ্যোগ নিলে রাজশাহীর কারখানাটিও খোলার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এই ১৪ দফার মধ্যে হাইটেক পার্ক আর মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি বাস্তবায়িত হয়েছে। রাজশাহীতে ২০১১ সালের মাদ্রাসা মাঠের ওই জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শিল্পে গ্যাস সংযোগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগ পাওয়াও রাজশাহীর মানুষের আরও একটি স্বপ্ন ছিল।
পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লি. (পিজিসিএল)-এর সূত্রমতে, রাজশাহীতে ১০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন ব্যাসের ২৭০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসানো হয়েছে। রাজশাহীর মানুষকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের স্বপ্ন দেখানো হলো। ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারির সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে ৭ জুন রাজশাহী নগরের বাসাবাড়িতে গ্যাসের সংযোগ দেওয়ার কাজ শুরু করা হলো। রাজশাহীর মানুষের সেই স্বপ্নও ষোলো আনা পূরণ হলো না। বাসাবাড়িতে গ্যাসের সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ৯ হাজার ১০৩টি আবাসিক সংযোগ দেওয়া হয়েছে। আবেদন পড়ে রয়েছে আরও ১১ হাজার। ডিমান্ড নোট ইস্যু করে সাড়ে ৫ হাজার গ্রাহকের টাকা জমা নেওয়া হয়েছে। তাঁদের স্বপ্নপূরণের আশ্বাস আপাতত পিজিসিএল কর্তৃপক্ষের কাছে শোনা যাচ্ছে না। এত বছরে রাজশাহীর মাত্র সাতটি শিল্পে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্যিক আবেদন পড়ে রয়েছে আরও ২৫০টি। সবাই আশা করছেন, আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁদের এই স্বপ্নভঙ্গের কথা আগামী বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরবেন। যদিও ২০১১ সালের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের ১৪ দফার একটিও সুস্পষ্ট করে পূরণের আশ্বাস দেননি। শুধু বলেছিলেন, ‘অর্থের জোগান হলে তাঁরা রাজশাহীতে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় করবেন।’ (প্রথম আলো, ২৫ নভেম্বর ২০১১)। সেই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় করার কোনো আলামতই এখনো রাজশাহীতে দেখা যাচ্ছে না।
এ জন্য রাজশাহীর মানুষ মনে করে, তারা আসলে উপেক্ষিত। হাতের কাছেই এ রকম একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। এবার সারা দেশের ৩৫টি জেলার ক্ষয়ক্ষতি ও ত্রাণ কার্যক্রমের তালিকা প্রকাশ করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো রাজশাহী জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হলেও সরকারের তালিকায় রাজশাহীর নাম নেই। বন্যায় রাজশাহীর ২৮ হাজার ৫৩৭টি পরিবার ও ১৬ হাজার ৪০০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ৮০০ পরিবার ও ৮৩৪ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের নাম এই তালিকায় রয়েছে। বরাদ্দও দেওয়া হয়েছে।
রাজশাহীর জন্য আরও একটি শঙ্কার বিষয়, ‘বোরো চাষের জন্য নির্বিচারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে এখন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে মানুষ। ১৩ বছর ধরে পানির স্তর গড়ে ১ দশমিক ২৩ ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। এখন চাষাবাদ দূরের কথা, মানুষের খাওয়ার পানি জোগাড় করাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে (প্রথম আলো, ৫ জুন ২০১৭)। এই সমস্যার সমাধানের জন্য রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ কয়েক দশক ধরে উত্তর রাজশাহী শেষ প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে।
যাঁরা রাজশাহীতে আসেন, তাঁরাই প্রশংসা করেন রাজশাহী শহর খুব সুন্দর। এখানকার মানুষ ভালো। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে রাজশাহীর বাতাস খুব নির্মল। একজন তরুণ চলচ্চিত্রনির্মাতা দীপান্ত সরকার একটি ছড়ায় লিখেছেন, ‘আমার যদি থাকত ডানা উড়ে যেতাম রাজশাহী/ সেই শহরে ছিল আমার ছোটবেলার বাদশাহি।’
রাজশাহীর মানুষের প্রত্যাশা, প্রধানমন্ত্রী রাজশাহীর মানুষের কষ্টের কথাটাও বুঝবেন। দাবিগুলোর কথা ভাববেন।

আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ: সাংবাদিক