দালান তো হলো, থাকা যাবে তো?

প্রথম আলো ও ক্রাউন সিমেন্ট আয়োজিত ‘নির্মাণসামগ্রীর গুণগত মান রক্ষা ও উৎকর্ষ সাধন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে কথা বলেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তাঁর পাশে হাউজিং বিল্ডিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) পরিচালক মোহাম্মদ আবু সাদেক। ২৮ সেপ্টেম্বর, প্রথম আলো কার্যালয়, ঢাকা। ছবি: আবদুস সালাম
প্রথম আলো ও ক্রাউন সিমেন্ট আয়োজিত ‘নির্মাণসামগ্রীর গুণগত মান রক্ষা ও উৎকর্ষ সাধন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে কথা বলেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তাঁর পাশে হাউজিং বিল্ডিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) পরিচালক মোহাম্মদ আবু সাদেক। ২৮ সেপ্টেম্বর, প্রথম আলো কার্যালয়, ঢাকা। ছবি: আবদুস সালাম

উন্নত মানের স্থাপনা বা ভবন তৈরির জন্য দরকার উন্নত মানের নির্মাণসামগ্রী। আবার উন্নত নির্মাণসামগ্রীই ভালো মানের ভবনের নিশ্চয়তা দেয় না। ভবন নির্মাণের পর অগ্নিনিরাপত্তা, ভূমিকম্প নিরোধক বা দুর্যোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা আছে কি না, তা-ও পরীক্ষা করতে হবে। আর সেই জন্য সনদ দেওয়ার জন্য একটি সংস্থা গঠন করা দরকার, যাতে ওই সংস্থা নিরাপত্তা সনদ দেওয়ার পরই মানুষ ভবনে উঠতে পারে, তার আগে নয়।

প্রথম আলোর আয়োজনে আজ বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ‘নির্মাণসামগ্রীর গুণগত মান রক্ষা ও উৎকর্ষ সাধন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা উঠে আসে।

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন। বৈঠকের শুরুতে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন নির্মাণ খাতের জন্য সরকার কী, কী করেছে এবং ভবিষ্যতে আরও কী, কী করবে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরেন। এরপর অন্যরা আলোচনায় অংশ নেন।

গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, স্থাপনা তৈরির জন্য উপরিভাগের মাটি (টপ সয়েল) আর নষ্ট করা যাবে না, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কেউই তা করে না। তিনি বলেন, ‘সিমেন্ট ও রডে আমাদের অবস্থা এখন অনেক ভালো। সংকট শুধু পাথরের।’ গণপূর্ত অধিদপ্তরের দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলী রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, এ অধিদপ্তর ভবন নির্মাণে গবেষণাও করে।

ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন পরে এ-ও বলেন, ‘দেশে নকশা অনুযায়ী বাড়িঘর হচ্ছে না। তা দেখার লোক আছে, কিন্তু দেখছে না। বারবার বলার পরও কাজ হচ্ছে না। বরং ঢাকার গুলশান, ধানমন্ডিতে জমির শ্রেণির পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের চেয়ারম্যান মো. সামছুল হক বলেন, একসময় সিমেন্টের সঙ্গে মাটি মেশানো হতো, সেদিন এখন নেই। সিমেন্টের মান ভালো হচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে উন্নত হচ্ছে রডের মানও। সমস্যা তারপরও রয়ে গেছে। পরীক্ষার জন্য বুয়েট নিজে নমুনা সংগ্রহ করে না, গ্রাহকের দেওয়া নমুনাই পরীক্ষা করে।

কোনো কোনো কোম্পানি নিম্নমানের ফ্ল্যাট তৈরি করলেও তা দেখার কেউ নেই বলে মন্তব্য করেন সামছুল হক। তাঁর পরামর্শ দুটি। কিছু ভবন ধ্বংস করে অন্যদের সতর্ক হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। আর নজরদারির জন্য হয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (রাজউক) অথবা আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে। কোনো ফ্ল্যাট ভবন নির্মাণের পর ভবনটিতে বসবাস করা যাবে মর্মে সনদ দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা। ২৮ সেপ্টেম্বর, প্রথম আলো কার্যালয়, ঢাকা। ছবি: আবদুস সালাম
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা। ২৮ সেপ্টেম্বর, প্রথম আলো কার্যালয়, ঢাকা। ছবি: আবদুস সালাম

বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম জোর দেন ভূমির যথাযথ ব্যবহারের ওপর। বলেন, ‘পুর প্রকৌশলী, পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি—সবাইকেই জানতে হবে ভূমির অবস্থাটা কী? যে ভূমিতে ভবন হবে, তা কি দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত?’

ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টসের (আইএবি) সভাপতি কাজী গোলাম নাসির বলেন, দেশে যে অগ্রগতি দেখা যায়, তার সঙ্গে নির্মাণ খাত সরাসরি জড়িত। আর মানুষের মৌলিক অধিকার বাসস্থানের বিষয়টি তো আছেই। কিন্তু খুব কষ্ট লাগে যে যখন দেখি বিজ্ঞাপনে বুয়েটকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে বুয়েট কর্তৃক স্বীকৃত। বুয়েট কি তাহলে বিজ্ঞাপনে জড়িয়ে যাচ্ছে?

হাউজিং বিল্ডিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) পরিচালক মোহাম্মদ আবু সাদেক দেশে পাথরের অভাবের চিত্র তুলে ধরেন। কৃত্রিম পাথর তৈরির পাশাপাশি তিনি নদী খননের মাটি দিয়ে ব্লক তৈরির ওপর জোর দেন। 

নারী স্থপতি, প্রকৌশলী, পরিকল্পনাবিদ (ডব্লিউএইপিএ) বাংলাদেশের সভাপতি ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান স্থপতি সেলিনা আফরোজা নির্মাণসামগ্রী পরীক্ষার জন্য শুধু বুয়েটকে মানদণ্ড বিবেচনা করার বিপক্ষে। বুয়েটের শিক্ষক সামছুল হকের দেওয়া উদাহরণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখানে কীভাবে নমুনা সংগ্রহ করা হয়, তা তো শুনলেন।’ নির্মাণসামগ্রীর মধ্যে বালুকে ভালোভাবে পরিষ্কার না করেই ব্যবহার করা হয় বলে জানান তিনি।

শেলটেকের উপমহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, উপকরণ মানসম্পন্ন না হলে কখনোই ভালো ভবন তৈরি হবে না। কোনো কোনো দেশীয় কোম্পানির সিমেন্টে বেশি ‘ফ্লাই অ্যাশ’ আছে এবং সে কারণে এগুলোর প্রতি আস্থা রাখা কঠিন বলে মনে করেন তিনি। অন্যদিকে গ্রাহকেরা মানের চেয়ে দামের ব্যাপারে বেশি সতর্ক বলে তাঁর ধারণা।

বৈঠকে ক্রাউন সিমেন্টের কারিগরি উপদেষ্টা মো. শাহ আলম ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের সভাপতি কবীর আহমেদ ভূঞা বক্তব্য দেন।

গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী বৈঠকে অংশ নেওয়া প্রায় সবার অভিযোগ-আপত্তিই মেনে নেন। বলেন, ‘আমিই দোষী, স্বীকার করি।’