কম দামে জ্বালানি-বিদ্যুৎ কীভাবে পাব?

বাংলাদেশ সরকারের ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান ২০১০’ পাঁচ বছর পর সংশোধিত আকারে প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালে। ‘জাইকা’র আর্থিক সহায়তায় এক জাপানি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সে লক্ষ্যে ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান ২০১৬’-এর খসড়া তৈরি করে বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছিল। সে খসড়া নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা যথেষ্ট হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাথমিক জ্বালানি উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাম্প্রতিক সময়ে চূড়ান্ত খসড়া ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান ২০১৬’ অনুসরণ করা শুরু করেছিল। চূড়ান্ত আকারে সে পরিকল্পনা প্রকাশ করার আগেই খবর বেরিয়েছে, উল্লিখিত খসড়া পরিকল্পনায় সরকার আরও পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা পূরণে আমদানি করা তরল গ্যাস বা এলএনজি ব্যবহারকে পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান ২০১৬’-এর খসড়া আরও সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে জ্বালানি নিয়ে আলাপ-আলোচনায় শীর্ষে উঠে আসছে এলএনজি আমদানি এবং নিয়মিত ব্যবধানে জ্বালানি গ্যাস ও তেলের মূল্যবৃদ্ধির খবর। অপরিমিত ও অদক্ষ ব্যবহারে দেশের সীমিত পরিমাণের মজুত গ্যাস দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। দেশের সিংহভাগ শিল্পকারখানা প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে গ্যাস ব্যবহারে অভ্যস্ত। এখন অন্তত তিন গুণ বেশি দামে গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে দেশে উৎপাদিত গ্যাসের (বর্তমানে দেশে প্রতিদিন প্রায় ২৭৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত ও ব্যবহৃত হয়) সঙ্গে তা মিলিয়ে ক্রেতাদের সরবরাহ করার পরিকল্পনার কথা বলা হচ্ছে। কত পরিমাণ এলএনজি আমদানি করে কী মূল্যে শিল্প ও বাণিজ্যিক ক্রেতাপর্যায়ে গ্যাস সরবরাহ করা হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আগামী বছরগুলোতে কখন গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য কত হবে, তা নিয়ে সরকারের কাছে স্পষ্ট তথ্য নেই। শিল্প ও ব্যবসায় যাঁরা বিনিয়োগ করেছেন এবং বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন, তাঁদের জন্য জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চয়তা ও তার মূল্য সম্পর্কে ধারণা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ আগামী বছরগুলোতে শ্রমঘন, কম জ্বালানিনির্ভর পোশাকশিল্পের ওপর একক নির্ভরতা কাটিয়ে, অপেক্ষাকৃত উচ্চপ্রযুক্তির ও বেশি জ্বালানিনির্ভর বিভিন্ন শিল্পে বিনিয়োগের দিকে মনোযোগ দিতে চাইছে। মোট জাতীয় উৎপাদন বাড়াতে দেশে শিল্পের ভূমিকা দ্রুত বাড়ানোর তাগিদও বাড়ছে। এর সঙ্গে কর্মসংস্থান ও মাথাপিছু আয় বাড়ানোর সম্পর্ক রয়েছে। প্রাথমিক জ্বালানি ও বিদ্যুতের মূল্য সম্পর্কে স্পষ্টতা ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্ষেপণ দেশের শিল্প বিকাশের জন্য খুবই জরুরি।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর পেট্রোবাংলা কাতারের ‘রাসগ্যাস’ কোম্পানির সঙ্গে বছরে ২৫ লাখ টন তরল গ্যাস (এলএনজি) আমদানির আনুষ্ঠানিক ও প্রথম চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। আমদানি করা তরল গ্যাসকে নির্মীয়মাণ মহেশখালীর ভাসমান প্ল্যান্টে (এফএসআরইউ) জ্বালানি গ্যাসে রূপান্তর করে (প্রায় ৫০ কোটি ঘনফুট সমপরিমাণ গ্যাস) পাইপলাইনে সরবরাহ করতে প্রতি ইউনিটের (১ হাজার ঘনফুট) মূল্য দাঁড়াবে প্রায় ৬ দশমিক ৫০ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে দেশে উৎপাদিত প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য প্রতি ইউনিটের গড় মূল্য দিতে হয় প্রায় ২ দশমিক ১৯ মার্কিন ডলার। স্বাক্ষরিত চুক্তির অধীনে আমদানি করা গ্যাস আগামী বছরের মাঝামাঝি পাইপলাইনে প্রবাহিত হওয়া শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ প্রায় ৪০০ কোটি ঘনফুট সমপরিমাণ এলএনজি আমদানি ও ব্যবহার করবে বলে সরকার আশা করে। এ জন্য কয়েকটি এফএসআরইউ নির্মাণ ও ব্যবহার করতে হবে। এ লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি কয়েকটি বিনিয়োগ প্রস্তাব সরকারের বিবেচনাধীন। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে কর্মরত সরকারি ও বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আরও এফএসআরইউ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এলএনজি আমদানি করে গ্যাস সরবরাহ করলে দেশে গ্যাসের জন্য শিল্প-বাণিজ্য খাতের ক্রেতাদের বর্তমানের কয়েক গুণ বেশি মূল্যে গ্যাস কিনতে হবে। তবু বিশেষজ্ঞরা যৌক্তিক পরিমাণ এলএনজি আমদানির পক্ষে।

প্রাথমিক জ্বালানির সরবরাহ ঘাটতি দেশে সাশ্রয়ী মূল্যে ও মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত। দেশের নতুন গ্যাসক্ষেত্র খুঁজে পাওয়ার জন্য অপর্যাপ্ত অনুসন্ধান, বিদ্যমান কয়লাসম্পদ উত্তোলন ও ব্যবহারে অনীহা এবং বিদ্যমান গ্যাসসম্পদের দক্ষ ব্যবহারে জ্বালানিসাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যে নির্দিষ্ট কৌশলের অনুপস্থিতি সম্মিলিতভাবে প্রাথমিক জ্বালানির ঘাটতি তৈরি করেছে। শুধু এলএনজি আমদানি করে সে ঘাটতি পূরণ এবং সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা তৈরি হবে না। ‘পাওয়ার সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান ২০১০’ বিদ্যুৎ উৎপাদনের (প্রায় ৩৭ হাজার মেগাওয়াট) জন্য ২০৩০ সাল পর্যন্ত ৫০ শতাংশ কয়লা (দেশজ ৩০ শতাংশ ও আমদানি উৎস থেকে ২০ শতাংশ, ৩৫ শতাংশ গ্যাস দেশজ ও আমদানি উৎস থেকে), আমদানি করা তেল থেকে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং অবশিষ্ট অন্যান্য উৎস (আমদানি, পারমাণবিক শক্তি, জলবিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি) থেকে পূরণের প্রস্তাব করেছিল। ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান ২০১৬’ (খসড়া) ২০৪১ সাল পর্যন্ত প্রাক্কলনে (৫৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে) প্রাথমিক জ্বালানির জন্য আমদানি উৎসকে প্রাধান্য দিয়েছে (৩৫ শতাংশ গ্যাস, ৩৫ শতাংশ কয়লা, প্রায় সম্পূর্ণ আমদানি উৎস থেকে), ৫ শতাংশ আমদানি করা তেল ও অন্যান্য উৎসের প্রস্তাব করেছে।

বড় আকারে আমদানি করা কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন এখনো বেশ দূরবর্তী বিষয় হিসেবে স্পষ্ট হয়েছে। নীতিনির্ধারকেরা কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদনকে বাংলাদেশের বাস্তবতায় যত সহজ ভেবেছিলেন, কার্যত বিষয়টি তার চেয়ে অনেক জটিল হিসেবে পরবর্তী সময়ে স্পষ্ট হয়েছে। শুরু থেকেই কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যঁাদের ওপর সরকার নির্ভর করেছে, তাঁরা নিজেরাই বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতেন না বা বুঝতে আগ্রহী ছিলেন না। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এখন প্রায় ৩৫ শতাংশ জ্বালানিনির্ভরতা তৈরি হয়েছে। আগামী কয়েক বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানির ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ আমদানিনির্ভর তেল, তরল গ্যাস ও কয়লানির্ভর হবে বলে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো এই কার্যক্রম সমন্বিত ও নির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক না এগিয়ে সংকট মোকাবিলার নিয়মিত অপূর্বনির্ধারিত (অ্যাডহক) কার্যক্রম হিসেবেই চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এতে জ্বালানি খাতের টেকসই উন্নয়ন এবং ক্রেতাদের সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ পাওয়ার নিশ্চয়তা দূরবর্তী স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে।

ড. মুশফিকুর রহমান: জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।