বাঙালির আদি বাড়ি ও সেকেন্ড হোম

জাতি হিসেবে বাঙালি ঈর্ষাকাতর নয়—এমন অপবাদ বাঙালিকে কেউ দিতে পারবে না। কারও শ্রীবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি দেখলে তার অন্তর্দাহ না হয়েই পারে না। কাউকে বাজার থেকে একজোড়া ইলিশ কিনতে দেখলেও তার মন খারাপ হয়। কাউকে একটি নতুন টিনের ঘর তুলতে দেখলেও তার ঈর্ষা হয়।

যদি দেখে প্রতিবেশী একটি নতুন দামি গাড়ি কিনেছে, তাতেও তার বুক জ্বলে। সেই বাঙালি যদি শোনে পরিচিত কেউ আমেরিকায় একটি বাড়ি কিনেছে অথবা মালয়েশিয়ায় হয়েছে সেকেন্ড হোম বা দ্বিতীয় বাড়ির মালিক, তাতে যদি তার অন্তর্দাহ না হয়, তাহলে বুঝতে হবে সে হৃদয়হীন। সেই কারণেই ভাগ্যবান বঙ্গসন্তানদের মধ্যে যাঁরা মালয়েশিয়ায় তাঁর দ্বিতীয় বাড়িটির মালিক হন, তখন তিনি তা গর্ব করে কাউকে না জানিয়ে গোপন রাখেন।

যে মালয়েশিয়ায় অতি অল্প বেতনে একটি চাকরির জন্য লাখ লাখ বাঙালি মাথা কুটছেন, সেই দেশেই দ্বিতীয় হোমের স্বত্বাধিকারী হয়েছেন ৩ হাজার ৫৪৬ বাংলাদেশি। চাট্টিখানি কথা নয়। গর্বে বুক ভরে ওঠে।

আজ যাঁরা সেকেন্ড হোমের মালিক হয়েছেন, একদিন তো বাংলার মাটিতে তাঁদের ফার্স্ট হোম বা প্রথম আদি বাড়ি ছিল। তারপর ঢাকায় হয়েছে আরেকটি বাড়ি বা ফ্ল্যাট। সেটাকেই সেকেন্ড হোম বা দ্বিতীয় বাড়ি বলা যায়। তারপর আরও কোথায় কোথায় কত বাড়ি হয়েছে, তা বিধাতা ছাড়া আর কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। মালয়েশিয়ার বাড়িটি যে কত নম্বর, তা মালয় কর্তৃপক্ষও জানে না।

মালয়েশিয়ায় এখন যাঁদের সেকেন্ড হোম, কেমন ছিল তাঁদের অনেকের ফার্স্ট হোম বা আদি বাড়ি? আমরা কল্পনা করতে পারি সে রকম একটি বাড়ি। কারও ছিল দোচালা শণের ঘর। দুই বছর পরপর চালের ছাউনি ঘরামিদের দিয়ে বদলাতে হতো। কারও বাড়ি টিনের চারচালা। ঘরের মেঝে ও দাওয়া ছিল এঁটেল মাটিতে লেপা। তারও একটা আলাদা সৌন্দর্য ছিল। মুলি বাঁশের বেড়া। চালের কোনায় জালালি কবুতর বাসা বাঁধত। ওগুলো যখন বাকুম বাকুম করত, তখন একটা মদির পরিবেশ সৃষ্টি হতো। অনেকের বাড়িতে কিছু মোরগ-মুরগি, গরু–ছাগলও ছিল।

অনেকের সেই আদি বাড়িতে ছিল ডোবার মতো এঁদো পুকুর। তাতে সন্ধ্যাবেলা ব্যাঙ ডাকত। কখনো ঝিঁঝি পোকা। অনেকের আদি বাড়িতে টিউবওয়েল তো নয়ই, ইঁদারা নয়, পাতকুয়াও ছিল না। মাইটালের পানিতেই নাওয়া ও খাওয়া চলত। গ্রামে মহামারির আকারে ডায়রিয়া দেখা দিলে মসজিদের টিউবওয়েল থেকে খাওয়ার পানি কলসে ভরে আনতে হতো। ওই শান্ত পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন অনেকে।

এর পরের ধাপ ঢাকা। ভাগ্যক্রমে পথের সন্ধান পেয়ে যান। অনেকটা আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়ার মতো। ধাঁ ধাঁ করে উন্নতি। বছর দশেকের মধ্যে হাতে আসে অঢেল অর্থ। অভিজাত এলাকায় বাড়ি নির্মাণ। সপরিবারে বিশ্বভ্রমণ। ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাং হার মানেন। এর মধ্যে একদিন খোঁজ পান সদাশয় মালয়েশীয় সরকার ‘সেকেন্ড হোম প্রকল্প’ চালু করেছে। এমন সুযোগ হাতছাড়া করবেন, বাঙালি তেমন বোকাই নন। যেকোনো অর্থনৈতিক ও বৈষয়িক সুযোগের সদ্ব্যবহারে বাঙালি অদ্বিতীয়। আর বাঙালি ভাগ্যবানও বটে। সুযোগ তার হাতের মুঠোয় এসেও যায়। ‘সম্প্রতি রাজধানী কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত সেকেন্ড হোম কর্মসূচি নিয়ে জাতীয় কর্মশালায় মালয়েশিয়ার পর্যটন ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী নাজরি আজিজ জানান, ২০০২ সালে “মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম” (এমএস২এইচ) নামের বিশেষ কর্মসূচি চালুর পর এ পর্যন্ত ১২৬টি দেশের ৩৩ হাজার ৩০০ জন এ সুবিধা নিয়েছেন। এর মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে চীন; দেশটির ৮ হাজার ৭১৪ জন এ সুবিধা নিয়েছেন। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জাপান; দেশটির ৪ হাজার ২২৫ জন এ সুবিধা নিয়েছেন। আর তৃতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশের ৩ হাজার ৫৪৬ জন এ কর্মসূচির আওতায় বাড়ি কিনেছেন।’ [সমকাল, ৬ অক্টোবর ২০১৭]  এই কথা শোনার পর যদি আমরা মারহাবা মারহাবা না করি, তাহলে প্রমাণিত হবে যে বাঙালি ঈর্ষাকাতর।

চীনাদের মালয়েশিয়ায় বাড়ি বানানোর বিষয়টি আলাদা। সেখানে চীনাদের বসবাস বহু শতাব্দী যাবৎ। সে দেশে তারা বৃহত্তম সংখ্যালঘু। জাপানিরা আগাগোড়াই বিত্তবান। তাঁরা একাধিক দেশে বাড়ি কিনতে পারেন। ব্রিটিশদের উপনিবেশ ছিল মালয় দ্বীপপুঞ্জে বহুদিন। কিন্তু বাংলাদেশিরা?

মালয়েশীয় মন্ত্রী আরও জানান, সেকেন্ড হোম কর্মসূচির আওতায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা স্থাবর সুবিধা ও রাজস্ব হিসেবে মোট ১ হাজার ২৮০ কোটি মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ করেছেন। এক লাখ ডলার জমা দেওয়াসহ বিশেষ কিছু শর্ত পূরণ করে যেকোনো দেশের নাগরিক মালয়েশিয়ায় দীর্ঘ মেয়াদে বসবাসের সুযোগ পান। বিনিয়োগকারীদের আয়ের উৎস গোপন রাখে মালয়েশিয়া সরকার।

মালয়েশিয়ায় একটি সেকেন্ড হোম নয়, ১০টি করে বাড়ি বানানোর ক্ষমতা রাখেন আজ বহু বাঙালি। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে: ‘পাঁচ লাখ রিঙ্গিত বা ১ কোটি ২২ লাখ টাকা জমা দেওয়ার পাশাপাশি মাসিক ১০ হাজার রিঙ্গিত বা ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা বৈদেশিক আয় দেখাতে পারলেই পাওয়া যায় মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ। মালয়েশিয়ার দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, যেকোনো দেশের নাগরিক মালয়েশিয়ার মাই সেকেন্ড হোম প্রোগ্রামের জন্য আবেদন করতে পারেন। এ জন্য ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে পাঁচ লাখ রিঙ্গিত জমা রাখতে হয়।’ ১ কোটি ২২ লাখ টাকা তো আজ বাঙালির কাছে নস্যি।

মালয়েশিয়ায় বাড়ি কিনে যাঁরা সেখানকার নাগরিকত্ব নিয়েছেন, তাঁদের ওপর নাখোশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু সেই ভাগ্যবান-ভাগ্যবতী কারা, তাঁদের পরিচয়টা আমাদের জানা দরকার। মালয়েশিয়ায় গিয়ে রিঙ্গিত রোজগার করে যাঁরা বাড়ি করবেন, তাঁদের আমরা মোবারকবাদ জানাব, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে টাকা নিয়ে সেখানে গিয়ে সুখে থাকবেন, তাতে আমাদের মৃদু আপত্তি আছে।

মালয়েশিয়ায় গিয়ে বাড়ি বানিয়েছেন, এমন ১ হাজার ৬৩ জনের তালিকা তৈরি করেছে আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৬৪৮ জনের বিরুদ্ধে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। দুদকের অনুসন্ধানে ওই প্রকল্পে অনেকের বাড়ির ঠিকানাও পাওয়া গেছে। দুদক সূত্র জানায়, অর্থ পাচার করে মালয়েশিয়ায় যাঁরা সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছেন, তাঁদের মধ্যে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীরা রয়েছেন। সেখানে বাড়ি বানাতে যখন কোনো মানুষের জীবিকার ওপর বিধিনিষেধ নেই, সুতরাং রাজনীতিক হোন বা উপসম্পাদকীয় লেখক হোন, সবাই সুযোগটি গ্রহণ করতে পারেন। আমাদের আবেদন হবে, বাড়িওয়ালা-বাড়িওয়ালিদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করা হোক। সেই সঙ্গে আরও জানালে ভালো, ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তাঁদের ব্যাংকে কত টাকা ছিল এবং ২০০১ সালে তাঁরা কত টাকা আয়কর দিয়েছেন।

সমকাল-এর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম প্রকল্পে আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরাও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন—এমন অভিযোগ উঠেছে। গত জুলাই মাসে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এ তথ্য জানানো হয়।’ রিহ্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, অর্থ পাচারের কারণে দেশের আবাসন ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

মালয়েশিয়ার পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সেকেন্ড হোম প্রকল্পে ২০০৬ সালে বাংলাদেশিরা ছিলেন প্রথম স্থানে। (যখন দুর্নীতিতেও ছিল বাংলাদেশ এক নম্বরে)। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ ছিল চতুর্থ। উদ্দীনীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে সেকেন্ড হোম কেনার মাত্রা বাড়তে থাকে। এখন নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, সেখানে বাড়ি কেনার লোকের সংখ্যা ততই বাড়ছে। ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, বর্তমানে আরও প্রায় দেড় শ বাংলাদেশি আবেদনকারী মালয়েশিয়ার নাগরিকত্ব গ্রহণের অপেক্ষায় রয়েছেন। তাঁদের আবেদন শিগগিরই ফয়সালা হবে। দুদক নাকি অনেকের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করছে। তবে দুদকের কর্মকর্তাদের জন্য সুখবর এই যে দুদক এর ‘অনুসন্ধান টিমকে অধিকতর অনুসন্ধান চালাতে মালয়েশিয়ায় পাঠাবে।’

মালয়েশিয়ায় যাঁরা আলিশান বাড়ি বানিয়েছেন, তাঁরা কষ্ট করে টাকা কামাই করেছেন। তবে তাঁদের সুপ্রসন্ন ভাগ্যের জন্য বিধাতা যতটা দায়ী, রাষ্ট্রের অবদান তার চেয়ে বেশি। কেউ বলবেন, তাঁদের বাড়িগুলো কি তাহলে আমাদের গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা গিয়ে বানিয়ে দিয়ে এসেছেন? আমি বলব, হ্যাঁ, অনেকটা তা-ই। আমাদের কর্মকর্তারা গিয়ে বাড়িগুলো বানিয়ে দিয়ে না এলেও তাঁদের কারণেই আজ তাঁরা সেখানে বাড়ির মালিক।

রাষ্ট্রের আনুকূল্য না থাকলে কোনো সমাজে মানুষ অতি দ্রুত অতিবিত্তের মালিক হতে পারে না। ব্যাংকগুলোর ভল্টের তালা একশ্রেণির মানুষের জন্য খোলা। যতটা অর্থের প্রয়োজন, ততটা অর্থ তাঁরা সেখান থেকে দুহাতে তুলে নিতে পারেন। সে টাকা আর কস্মিনকালেও ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না।

কে কী প্রক্রিয়ায় বেশুমার বিত্তের মালিক হচ্ছেন, সে খোঁজ রাষ্ট্র রাখবে না? তাহলে আর রাষ্ট্রের দরকার কী? অরণ্যজীবনই তো ভালো ছিল? সরকারের কাজ তো ঘোড়ার ঘাস কাটা নয়। কোথায় একজন জঙ্গি হয়ে উঠছে, তার যেমন খোঁজখবর রাখতে হবে, তেমনি একজন ধাঁ করে ধনকুবের হয়ে উঠেছেন, তাঁর অর্থের উৎস কী, সে খোঁজও রাখতে হবে। তা যদি না রাখে, তাহলে বুঝতে হবে রাষ্ট্র ব্যর্থ না হলেও রাষ্ট্রযন্ত্র ঠিকভাবে কাজ করছে না। সেই ব্যর্থতার দায় জনগণ নিতে পারে না। তবে জনগণ, যাদের ট্যাক্সের টাকায় সরকার
চলে, জবাব চাইতে পারে। সেই জবাবদিহির বালাই নেই বলেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। অন্যান্য ব্যাংকের টাকা পাচার হয়ে বিদেশে যায়, সেখানে গড়ে ওঠে অনেকের প্রাসাদোপম বাড়ি। কারও সেকেন্ড হোম, কারও থার্ড হোম, কারও বা ফোর্থ হোম—চতুর্থ বাড়ি। বহির্বিশ্বে এসব বাড়িওয়ালার বিষয়ে জানার অধিকার জনগণের রয়েছে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।