এই রাশিয়া সেই রাশিয়া নয়

চীন ও রাশিয়া রোহিঙ্গাদের পাশে নেই
চীন ও রাশিয়া রোহিঙ্গাদের পাশে নেই

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে গুটিকতক দেশ আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, তাদের অন্যতম ছিল রাশিয়া, অর্থাৎ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেদিন মারণাস্ত্রে সজ্জিত একটি অত্যাধুনিক সামরিক বাহিনী বাঙালি জাতিকে নির্মূল করার এক নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। এক কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হিসেবে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। নিহত হয়েছিল প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। সেটি ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ শতকের জঘন্যতম গণহত্যা। রাশিয়া সেদিন এই গণহত্যার প্রতিবাদ করেছিল, আমাদের প্রতিরোধ আন্দোলনকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের স্বীকৃতি দিয়েছিল।
এখন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জাতিসত্তার বিরুদ্ধে যে পরিকল্পিত নিধনযজ্ঞ চলছে, জাতিসংঘ তাকে জাতি হত্যার এক ‘টেক্সট বুক’ উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। ঠিক কত রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে, সে সংখ্যা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত হয়নি। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের তদারকি ছাড়া সেখানে বিদেশি সাংবাদিক বা ত্রাণ সংস্থাকে ঢুকতে দিচ্ছে না। স্যাটেলাইট–চিত্র থেকে দেখা গেছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সর্বস্ব হারিয়ে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
দুই পরিস্থিতির মধ্যে ফারাক আছে, কিন্তু বিস্তর মিলও রয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার প্রতিবাদে বাংলাদেশে গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, যার পরিণতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা। রাখাইন রাজ্যেও খুব সীমিত আকারে সশস্ত্র প্রতিরোধের কথা শোনা যাচ্ছে। এর সঙ্গে রাখাইন রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসার যুক্ততার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কে বা কারা এই আরসা, কে তাদের অর্থ ও অস্ত্র জোগাচ্ছে, সে ছবিটা অবশ্য এখনো খুব স্পষ্ট নয়।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রতিরোধ আন্দোলনের ব্যাপারে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া হয়েছে নাটকীয়। একটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর হাতে সম্পূর্ণ নির্মূল হওয়ার মুখে। এই নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ প্রতিবাদ করার বদলে রাশিয়া মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পক্ষাবলম্বনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে সংহতির তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না, উল্টো তারা সে আন্দোলনকে ঢালাওভাবে সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্মূল অভিযানকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় বলে তার পক্ষে সাফাই গেয়েছে।
১৯৭১ ও ২০১৭—এই দুই সময়েই নাটকের কেন্দ্রস্থল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিরাপত্তা পরিষদ একবারের জন্যও মিলিত হয়নি, হতে পারেনি। অবস্থা বদলে যায় ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে। রোহিঙ্গা সমস্যাটি নতুন নয়, এক যুগেরও বেশি পুরোনো। অথচ এই প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদ ১৩ সেপ্টেম্বরের আগ পর্যন্ত একবারের জন্যও মিলিত হতে পারেনি। রোহিঙ্গা প্রশ্নে একটি সম্মিলিত ঘোষণা যাক, ইউরোপীয়দের এই দাবি পর্যন্ত চীন ও রাশিয়ার আপত্তির কারণে বাতিল হয়ে যায়। এদিকে সেপ্টেম্বরে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয়ের জন্য প্রবেশ করলে এই নিয়ে বিশ্ববাসীর টনক নড়ে। বিশ্ববাসী মানে রাশিয়া নয়, মুখ্যত পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো। তাদের চাপেই নিরাপত্তা পরিষদ বার দুয়েক দরজা সেঁটে মতবিনিময়ের জন্য বসে। পরে ওই ইউরোপীয়দের চাপেই ২৮ সেপ্টেম্বর পরিষদ একটি উন্মুক্ত বৈঠকে মিলিত হয়। আর এই বৈঠকে রাশিয়ার বক্তব্য শুনে লজ্জায় আমাদের অনেকের মাথা নিচু হয়ে যায়।
প্রথমে ১৯৭১ সালে নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার (অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন) বক্তব্য স্মরণ করা যাক। বাংলাদেশের সে সময়ের ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত আবু সায়ীদ চৌধুরী সে সময় নিউইয়র্কে। তিনি নিরাপত্তা পরিষদের সামনে পরিস্থিতি সবাইকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টায় ছিলেন। পাকিস্তান ও চীন সে চেষ্টার বিরোধিতা করে, সমর্থন জানায় ভারত ও রাশিয়া। যে ভাষায় ও যুক্তিতে রাশিয়া এই প্রস্তাবে সমর্থন করে, তা মনে রাখার মতো। ৪ ডিসেম্বর রুশ রাষ্ট্রদূত ইয়াকফ মালিক বললেন, আমরা যদি উটপাখির মতো বালিতে মাথা গুঁজে থাকতে চাই, তাহলে এ নিয়ে ভাবার কিছু নেই। কিন্তু বাস্তব সত্য জানতে হলে, এই সংঘর্ষ কেন তা বুঝতে হলে এই সংকটের মূল কারণ খুঁজতে হবে। আর মূল কারণ হলো একটি জাতিগোষ্ঠী নিজেদের অস্তিত্বের জন্য লড়াই করছে। ইয়াকফ মালিক সেই ভাষণে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন।
যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হলে ৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ জরুরি ভিত্তিতে মিলিত হয়। এখানে ইয়াকফ মালিক তাঁর দেশের অবস্থান আরও স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলেন, ‘বাস্তব সত্য হলো পূর্ব পাকিস্তানে রক্তাক্ত নিষ্পেষণের মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি মানুষের কণ্ঠরোধের চেষ্টা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে, উদ্বাস্তু হয়েছে এক কোটি মানুষ। সমস্যাটির মূল কারণ বুঝতে হবে। বাস্তবতা অগ্রাহ্য করে একপেশে সিদ্ধান্ত নিলে তা দৃশ্যত চমৎকার হতে পারে কিন্তু সমস্যা সমাধানে তা কোনো ভূমিকা রাখবে না।’ (বিস্তারিত দেখুন, হাসান ফেরদৌস, মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত বন্ধুরা, প্রথমা, ২০১৫)।
এবার নজর দেওয়া যাক রোহিঙ্গা প্রশ্নে ২০১৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনের দিকে। সেখানে রুশ রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেনজিয়া তাঁর বক্তব্যে চলতি সহিংসতার জন্য সব দায়ভার চাপান তথাকথিত রাখাইন রোহিঙ্গা লিবারেশন আর্মি বা আরসার ওপর। তিনি দাবি করেন, এই সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে বেসামরিক নারী-পুরুষ নিহত হয়েছে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছে। পরিস্থিতিকে ‘জাতি হত্যা’ বা জেনোসাইড, অথবা জাতি নির্মূলকরণ বা এথনিক ক্লিনজিং নামে অভিহিত করার বিরুদ্ধেও তিনি সতর্কতা উচ্চারণ করেন। তাঁর মোদ্দা বক্তব্য ছিল, রোহিঙ্গা সংকটের আসল কারণ এই জনগোষ্ঠীর অধিকারহীনতা অথবা তাদের ওপর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ঢালাও সামরিক হামলা নয়। আরসার প্রতিরোধ আন্দোলন রুশ রাষ্ট্রদূতের ভাষায় ‘সন্ত্রাস’।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, একই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা সহিংসতার জন্য শুধু যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে দায়ী করে তাই নয়, এই বাহিনীর সঙ্গে সব সামরিক সহযোগিতার বিরুদ্ধেও মত রাখে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হেইলি এমন আশ্চর্য মন্তব্য করেন যে আরসার তথাকথিত সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জবাবে মিয়ানমারের বাহিনীর সামরিক হামলা মোটেই আনুপাতিক নয়। যেসব পাঠকের একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কথা মনে আছে, হেইলির এই বক্তব্য তাঁদের কাছে বিস্ময়কর ঠেকবে বৈকি।
সপ্তাহ দু-এক আগে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ বিষয়ে একটি সেমিনারে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে অতি রক্ষণশীল থিংক ট্যাংক হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের এশিয়া বিশেষজ্ঞ অলিভিয়া ইনস বলেন আরও বিস্ময়কর একটি কথা। তিনি বলেন, আরসা নামে যে সন্ত্রাসী গ্রুপের কথা বলা হচ্ছে তার সদস্যসংখ্যা বড়জোর শ পাঁচেক। এদের সঙ্গে একটি নিয়মিত বাহিনীর তুলনা করা ভুল। তা ছাড়া অব্যাহত নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গারা যদি অস্ত্র তুলে নেয়, তাহলে অবাক হওয়ার কী আছে?
একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বিপক্ষে ছিল। রোহিঙ্গা প্রশ্নে আজ আমাদের পক্ষে। সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থান রাশিয়ার। মানছি, একাত্তর আর ২০১৭ এক নয়। সেদিনের রাশিয়া ও আজকের রাশিয়াও এক নয়। একাত্তরে রাশিয়ার ভূমিকা শুধু জাতীয় স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়নি, এর পেছনে কিছু নীতিগত অবস্থানও ছিল। এখন আর সে কথা বলা যাবে না।
মিয়ানমারে ভারত বা চীনের মতো রাশিয়ারও লক্ষ্য অর্থনৈতিক ও সামরিক। রাখাইন রাজ্যের গ্যাস-তেল একা চীন ভোগ করবে, রাশিয়া তা চায় না। কিন্তু এ ব্যাপারে চীন অনেক এগিয়ে গেছে, তারা নিজের দেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সরাসরি সড়ক ও সমুদ্রপথে যোগাযোগ নির্মাণ করছে। পেছনে পড়ে মিয়ানমারকে নিজের পকেটে রাখতে রাশিয়া সামরিক বাণিজ্যের পথ ধরেছে। ২০০১ সাল থেকেই রাশিয়া মিয়ানমার বিমানবাহিনীকে তাদের অত্যাধুনিক মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে তারা পাঠিয়েছে হেলিকপ্টার গানশিপ ও সামরিক পরিবহন হেলিকপ্টার। মিয়ানমারে একটি পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে এই দুই দেশ একটি চুক্তি করেছে। মিয়ানমারের সেনাসদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য রাশিয়া সে দেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রশিক্ষকও পাঠিয়েছে। এই দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা কীভাবে আরও বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে সলা-পরামর্শের জন্য মিয়ানমারের সেনাপ্রধান গত বছর রাশিয়া সফর করেছেন। এসব দেখে এ কথা বলা অন্যায় হবে না যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাশিয়ার একটি নিয়মিত ‘ক্লায়েন্ট’।
রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণে অবশ্য রাশিয়ার আরও একটা কারণ আছে। রাশিয়াকে নিজ দেশেই বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিদ্রোহ তাকে সামাল দিতে হচ্ছে। রোহিঙ্গা ও রুশ চেচেনদের অবস্থা খুব একটা ভিন্ন নয়। মস্কো ট্যাংকের নিচে চেচেনদের পিষে মেরে ফেলে চেচনিয়ায় কবরের শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। বড় ভাইয়ের কাছ থেকে এই শিক্ষা নিয়েই হয়তো মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এখন রোহিঙ্গা নির্মূলে উঠেপড়ে লেগেছে। অক্টোবর বিপ্লবের এই শতবার্ষিকীতে সত্যি বলছি, পুরোনো সোভিয়েত ইউনিয়নের বড্ড অভাব বোধ করছি।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।