জাতিসংঘ: 'কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে'?

জাতিসংঘর মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান সংস্থা ওএইচসিএইচআর (অফিস অব দ্য ইউনাইটেড ন্যাশনস হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস) আবারও পারল না। তারা হেরে গেল। তারা সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলতে পারল না। তারা জেনোসাইড বলতে পারল না। জেনেভায় ১১ অক্টোবরে প্রকাশিত তাদের নতুন প্রতিবেদন ‘Brutal attacks on Rohingya meant to make their return almost impossible’ প্রকাশ করে, কক্সবাজারে আসা সংস্থাটির মিশনপ্রধান টমাস হানিকি একটি খোঁড়া অজুহাত খাড়া করেছেন। বলেছেন, ‘আমরা জেনোসাইড ঘটেছে কি ঘটেনি, সেটা সাব্যস্ত করার অবস্থানে ছিলাম না।’ তাঁর কথা শুনে মনে হয়েছে, জাতিসংঘকে তাহলে বলে দিতে হবে, আর কত মৃত্যু, আর কত ধ্বংস, আর কত রক্তের নদী পেরোলে তবে তাঁরা জেনোসাইডকে জেনোসাইড বলবেন।

খুন একটি অপরাধের নাম। যেমন: ধর্ষণ, লুণ্ঠন, রাহাজানি, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি একটি করে অপরাধের নাম। তাই মিয়ানামারে যা ঘটেছে এবং ঘটছে, তা কি সাধারণ খুনখারাবি, সাধারণ ধর্ষণ, লুণ্ঠন, হত্যাকাণ্ড? এটি তো পদ্ধতিগত জাতিহত্যা। কোনো ফৌজদারি অপরাধের বিবরণ দিয়ে মিয়ানমারের বর্বরতাকে মাপা যাবে না। তাই কেন জাতিসংঘ জেনোসাইডকে জেনোসাইড বলবে না? তাহলে তারা বলুক, কখন, কোথায়, কী ঘটলে তবে বিশ্ব তাকে বলবে জেনোসাইড? নাকি এটি এমন একটি অপরাধ, যা জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে অপরাধীরা এখনো সংঘটিত করেনি!

জাতিসংঘ কখন, কবে, কোথাকার জাতিহত্যাকে জেনোসাইড বলেছে, সেটাও তাকে বলতে হবে। কম্বোডিয়ায় পলপট শাসনে দেশটির এক-চতুর্থাংশ মানুষকে হত্যা করার অনেক অনেক বছর পরে জাতিসংঘ তার বিচারে একটি হাইব্রিড ট্রাইব্যুনাল করেছে সত্য। কিন্তু তারা জেনোসাইড বলেনি, সেটাই আমরা এখন কেবল অসহায়ভরে স্মরণ করতে পারি।

আরও একটি বিষয় হলো, জাতিসংঘ মিশন একটি অতি সাধারণ রীতি মেনে ৬৫ জন প্রত্যাগত রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এই কাজ ব্যতিরেকে অন্য কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ ব্যবহার করার আদৌ কোনো চেষ্টা তারা করেছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। সুতরাং নতুন প্রতিবেদন দিয়ে তারা নতুন কী উদ্বেগ বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরল, তা নির্দিষ্ট করা কঠিন। তারা নীরব থাকেনি, কিছুই করেনি, সেটা এখন হয়তো বলা যাবে না।

তারা নতুন যা বলেছে, তা হলো, রোহিঙ্গাদের যেহেতু গ্রাম ও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সে কারণে এখন ফিরে গেলে তাহলে তারা অন্তরীণ হতে পারেন। এই প্রতিবেদনের শিরোনাম র‍্যাপিড রেসপন্স মিশন। যদি যুক্তি দেওয়া হয় যে তাদের এই প্রতিবেদন তো সুগভীর অনুসন্ধান বা গবেষণাপ্রসূত হওয়ার নয়। কারণ, এর নামই হলো র‍্যাপিড রেসপন্স। সেটা একটা যুক্তি উঠতে পারে। কিন্তু ১৩ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর একটি মিশন কাজ করেছে। গত শতাব্দীর কোনো একটি পরিস্থিতি হলে না হয় একটা কথা ছিল। কিন্তু স্মার্টফোন, অ্যান্ড্রয়েড ও স্যাটেলাইটের যুগে বাস করে এতগুলো সপ্তাহ পরে যে প্রতিবেদন পাওয়া গেল এবং তাতে আশু চ্যালেঞ্জ হিসেবেও যা চিহ্নিত করা হয়েছে, তা আমাদের কাছে নিদারুণ দায়সারা বলে মনে হয়েছে। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বড়জোর একটা মুখ রক্ষার ‘টেড স্যাংশন’ দিতে পারে। কিন্তু কোনো একটি পশ্চিমা বৃহৎ কোম্পানি তাদের ব্যবসা গুটানোর ঘোষণা দেয়নি। অবশ্য ‘উম্মাহ’র স্বার্থে কাতার আগামী পাঁচ বছরে গোটা মিয়ানমারে টেলিকম-সেবা বিস্তৃত করার যে পরিকল্পনা আগে করেছিল, তা এখনো রদ করার ঘোষণা দেওয়ার দরকার মনে করেনি।

তাই আমরা মনে রাখব, সরকারগুলো ‘জাতি’ পরিচয়ে টিকে থাকলে, তার সংঘও এ রকমই থাকবে। জাতিসংঘ প্রতিবেদন বলেছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘন ঘটেছে। জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণের সঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী জড়িত।

তারা বলেছে, এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সহিংসতা চলমান রয়েছে। কিন্তু সেটা কারা করছে, তা প্রতিবেদন উল্লেখ না করাটা নিছক সারল্য মনে হয় না।

ওই প্রতিবেদন বলেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের একটি অংশ ফিরতে চায় কয়েকটি শর্ত সাপেক্ষে:

১. মিয়ানমারের নাগরিকত্ব প্রদানের বিধান করতে হবে, ২. তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে, ৩. জীবনজীবিকার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, ৪. মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে, ৫. মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার জন্য জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। এবং কেউ কেউ আনান কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়নের শর্তও দিয়েছেন।

মিশনটি এরপর বলেছে, নিকট ভবিষ্যতে এত বিপুল রোহিঙ্গার বোঝা বহন বাংলাদেশের জন্য খুব কঠিন। যেখানে এসে নৌকা ভেড়ে, সেখানে তাদের স্থায়ী উপস্থিতির জন্য একটি স্থায়ী কাঠামো গড়ে তোলা দরকার। তার মানে জাতিসংঘ গোড়া কাটা থামাবে না, তারা আগায় পানি ঢালবে।

প্রতিবেদন বলছে, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন গুরুত্বপূর্ণ। এরপর তারা মানব পাচার ও যৌন সহিংসতার শিকার হওয়ার আশঙ্কার কথা বলেছে। ব্যস, এ–ই হলো জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থার প্রতিবেদনের নির্যাস।

খুঁটিয়ে দেখলাম, তারা এমনভাবে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, যাতে জাতিসংঘ বা তার কোনো সহযোগী কোনো সংস্থাকেই দ্রুত কোনো কাজে নেমে পড়তে না হয়। কোনো ধরনের জরুরি পদক্ষেপ নিতে এতে বলা হয়নি। তারা বলেনি, নিরাপত্তা পরিষদকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

এই প্রতিবেদনের ভয়ংকর দিক হলো তারা ‘মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘন’ চিহ্নিত করলেও সে জন্য কী প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে, সে বিষয়ে নীরব থাকা। এমনকি জবাবদিহির বিষয়টি কোনোমতে উল্লেখ করা হলেও তারা সেটা নিজেরা বলেনি। জবাবদিহির বিষয়টি ফিরতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের অন্যতম প্রত্যাশা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাটির প্রধান জেইদ রাদ আল হুসেইন এর আগে বলেছেন, এটা হলো ‘এথনিক ক্লিনজিংয়ের একটি টেক্সটবুক উদাহরণ।’ জাতিসংঘের তরফে এটাই হলো কঠোরতম উচ্চারণ। এবং তাও ওই প্রতিবেদনে মাত্র একটিবারের মতো সেই কথাটা জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থাপ্রধানের জবানিতেই উদ্ধৃত করা হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি যে জাতিসংঘ এই পরিভাষা সুচি‌হ্নিতভাবে ব্যবহার করে। এবং তা মিয়ানমারকে বাঁচাতে। কারণ, সার্বিয়ার যুদ্ধাপরাধী মিলোসোভিচ উদ্ভাবিত এই পরিভাষা আন্তর্জাতিক কোনো আইনে নেই। তাই এই অপরাধের জন্য মিয়ানমারকে কোনো আদালতে নিতে জাতিসংঘ বা জাতিসংঘের কোনো সদস্য রাষ্ট্রের কোনো দায় তৈরি হলো না।

কোনো সন্দেহ নেই, তারা এটা বিবেচনাতেই নেয়নি যে এই বিপুল জনগোষ্ঠী যাতে বাংলাদেশের জনস্রোতে মিশে না যায় এবং তাদের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেওয়া বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে রোহিঙ্গারা যেভাবে জীবন যাপন করছে, সেখানে জীবনধারণের ন্যূনতম চাহিদাগুলো মিটে গেছে, তা বলা যাবে না। এর আরও অবনতি ঘটলে মানবাধিকার এবং বিশ্ব শান্তির প্রতি তা যে বড় হুমকি হয়ে দেখা দেবে না, তা হলফ করে বলা যায় না। বাংলাদেশ বিরাট নিরাপত্তাঝুঁকিতে, তার স্বীকৃতি নেই জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে। তারা এমনকি বলতেই পারল না, মিয়ানমার নামের রাষ্ট্র সভ্যতাবিধ্বংসী অপরাধ করেছে।

আসলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কোনো ‘অপরাধ’ করেছে বলেই উল্লেখ নেই। পুরো প্রতিবেদনে ‘ক্রাইম’ শব্দটি এসেছে একবার। আর সেটাও ৬০ বছর বয়স্ক এক প্রত্যাগত ভদ্রলোক বলেছেন, ‘মিয়ানমার আমার জন্মভূমি। আমরা কোনো অন্যায় করিনি। আমরা অপরাধী নই। আমরা কী অপরাধ করেছি?’

মিয়ানমার আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু কোনোভাবেই প্রতিবেদনে তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, গত ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যা ঘটেছে তা পদ্ধতিগত। সুপরিকল্পিত। বিশ্ববাসীর কাছে ব্যাপারটা ইতিমধ্যে সুবিদিত। এর আগে একই সংস্থা যে ফ্লাশ প্রতিবেদন তৈরি করেছিল, তাতেও এ কথা বলা হয়েছিল।

উন্নত বিশ্বের স্যাটেলাইটে সবকিছু ছবির মতো ধারণ থাকা সত্ত্বেও কী ঘটেছে, তার বিবরণ বিশ্বকে জানাতে শুধু পলায়নপর ও নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের জবানবন্দিকেই উপজীব্য করা হয়েছে। জাতিসংঘের অজানা নয় যে ভুক্তভোগীর জবানবন্দির চেয়ে স্যাটেলাইট ও পশ্চিমা মিডিয়ার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নথিভুক্তি দুর্বৃত্ত জেনারেলদের বিচারের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু জাতিসংঘ তা করবে না। নিরাপত্তা পরিষদ কোনো বিল (সিদ্ধান্ত) পাস করবে না। তারা নানা ছলছুতায় অং সান সু চি ও তাঁর জেনারেলদের জন্য প্রকারান্তরে ইনডেমনিটি বিল পাস করে যাবে।

এটি একটি গা বাঁচানো প্রতিবেদন। একটি মুখরক্ষার প্রতিবেদন। যেখানে আবারও বুটের তলায় দলিত-মথিত মানবাধিকারের চিত্র ‘কৌশলগতভাবে’ চিত্রিত করার নিপুণ প্রয়াস চলেছে।

তাই বলি, জাতিসংঘ কত হাজার মরলে তবে মানবে যে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চলছে!