শীতল রাজনীতিতে সামান্য উত্তাপ!

গত সপ্তাহে কালের পুরাণে প্রশ্ন রেখেছিলাম, দেশটা কি সঠিক পথে চলছে? পাঠকদের অনেকে ই-মেইল ও অনলাইন মন্তব্য করেছেন, দেশটি ঠিকমতো চলছে না। আবার কেউ কেউ সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে বলার চেষ্টা করেছেন, দেশটা ঠিক পথেই চলছে।

বিষয়টি অনেকটা গ্লাসের অর্ধেক খালি ও অর্ধেক পূর্ণ—এই বিতর্কের মতো। অতি আশাবাদীরা যুক্তি দেখাবেন, গ্লাসের অর্ধেক খালি থাকা সব সময় খারাপ নয়। গ্লাসের অর্ধেক পানি ভর্তি থাকলে বাকি অর্ধেক ভর্তি করার সুযোগও থাকে। তা ছাড়া অর্ধেক পানিভর্তি গ্লাসে ফুল রাখা যায় এবং সেই ফুলের সৌরভ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ারও সম্ভাবনা আছে। আবার হতাশাবাদীরা যুক্তি দেখাবেন, অর্ধেক পানিভর্তি গ্লাসটির পানি কমতে কমতে একেবারে খালি হয়ে আসতে পারে। অতএব, সেই অবস্থা তৈরি হওয়ার আগে গ্লাসের খালি অংশ পূরণ করার দিকেই সবার দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন যে অর্ধেক পানি অর্ধেক খালি বিতর্কটি গ্লাস ভেঙে এক পক্ষ প্রমাণ করতে চাইবে গ্লাসে কোনো পানি নেই। আরেক পক্ষ দাবি করবে, গ্লাসই ছিল না।

২.

জামায়াতে ইসলামী নামের নির্বাচন কমিশনে অনিবন্ধিত দলটি বৃহস্পতিবার হরতাল ডেকেছিল। সেই সুবাদে অনেক দিন নয়, অনেক মাস পর হরতাল শব্দটি সংবাদপত্রে জায়গা পেয়েছে। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের আমলে হরতাল শব্দের ওপরই নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল বেশ কিছুদিন। হরতালের বদলে আমাদের লিখতে হতো কর্মসূচি। ১২ ঘণ্টার কর্মসূচি, ২৪ ঘণ্টার কর্মসূচি কিংবা ৭২ ঘণ্টার কর্মসূচি ইত্যাদি।

বুধবার সকালে দেখলাম, কিছু যুবক হরতাল হরতাল বলে রাস্তায় ঝটিকা মিছিল করে পুলিশ আসার আগেই হাওয়া হয়ে গেল। জামায়াতে ইসলামীর আমির, মহাসচিবসহ নয়জন নেতাকে উত্তরার এক বাসা থেকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে দলটির ডাকা হরতালে জনগণ সাড়া দেয়নি। জামায়াতের হরতাল সত্ত্বেও বৃহস্পতিবার জীবনযাত্রা মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল। তবে রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি কম বের হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছিল। প্রভাবহীন হরতালেরও একটা প্রভাব থাকে।

হরতাল নিয়ে কথা বলার আগে পর্যুদস্ত জামায়াতের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা সম্পর্কে সাচ্চা গণতন্ত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমির, মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নয়জন নেতাকে গ্রেপ্তারের পরপরই দলীয় নেতৃত্ব নতুন আমির ও মহাসচিবের নাম ঘোষণা করেছে। আমাদের সাচ্চা গণতান্ত্রিক দলগুলো কাজটি করতে পারত কি না সন্দেহ। ১/১১-এর পর দেখেছি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির
শীর্ষ দুই নেত্রী গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুই দলেরই অন্য নেতারা নানামুখী তৎপরতা চালিয়েছেন। সাইফুর রহমান, মান্নান ভূঁইয়ারা তো আলাদা বিএনপিই তৈরি করে বসলেন। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা দল না করলেও দলে অধিক গণতন্ত্রায়ণের দাবি সামনে নিয়ে এসেছিলেন।

হরতাল ঘোষণার আগে গত বুধবার বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। বিএনপি বিক্ষোভ করেছে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির প্রতিবাদে। আর জামায়াত বিক্ষোভ করেছে তাদের নয়জন নেতার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে। বিক্ষোভের বিষয়টি কাকতালীয় হলেও জামায়াতের হরতালে বিএনপির সমর্থন তা নয়। প্রথমে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সচিব রুহুল কবির রিজভী বললেন, জামায়াতের হরতালে তাঁদের সমর্থন নেই। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরই অবস্থান পাল্টে তিনি হরতালে বিএনপির সমর্থনের কথা জানিয়ে দিলেন। জামায়াত নিয়ে বিএনপির এই টানাপোড়েন বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নতুন নয়। দেশবাসী দূরে থাক, বিএনপির নেতারা দলের নতুন প্রজন্মের কর্মী কী চান, তাও বুঝতে পারেন না।

বুধবার বিক্ষোভ কর্মসূচির সময় বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। দুই দলের স্থানীয় পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে যে নাশকতা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসের মামলা আনা হয়েছে, তার বিচার হবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। এর আগে হরতাল-অবরোধকে কেন্দ্র করে পুলিশ বিএনপি-জামায়াতের বহু নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছিল। কিন্তু আসামির সাজা খাটা কিংবা জেলে থাকার উদাহরণ কম। বেশির ভাগ মামলায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছিল। গত তিন-চার বছরেও পুলিশ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের নাম বের করতে পারেনি। হুকুমদাতাদের ধরে জেলে পুরলেও হুকুম পালনকারীদের খুঁজে পাচ্ছে না।

দীর্ঘদিন ধরে সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা এককভাবে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। বৈকালিক প্রেস ব্রিফিং ও ঘরোয়া আলোচনার মধ্যে বিএনপির কার্যক্রম সীমিত ছিল। একটি সহযোগী পত্রিকা শিরোনাম করেছে, ‘পরোয়ানায় নড়েচড়ে বসেছে বিএনপি।’ বৃহস্পতিবার আরও দুটি মামলায় আদালত বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। প্রতিবাদে বিএনপি আজ ফের সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। মনে হচ্ছে হঠাৎ করেই বিরোধী দলের শীতল রাজনীতি কিছুটা উত্তাপ ছড়াচ্ছে। বিএনপির নেতারা মনে করেন, খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা কিংবা দেশে আসতে না দেওয়ার কৌশল হিসেবে সরকার এসব করছে। তিনটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর খালেদা জিয়া দ্রুতই দেশে ফিরে আসছেন বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। 

আজকের বিএনপির বিক্ষোভ কর্মসূচিটি কেমন হবে, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে দুটি পক্ষ। বিক্ষোভ কর্মসূচি আহ্বানকারী বিএনপি ও সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুই পক্ষ সীমার মধ্যে থাকলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে এবং দেশের জন্য স্বস্তিদায়ক হবে। টিভির খবরে দেখলাম, বুধবার খুলনায় বিএনপি অফিসের সামনে নেতা-কর্মীরা সমাবেশ করেছেন। আর পুলিশ চারপাশে পাহারা দিচ্ছে। কোনো সংঘাত হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক থাকবে জনগণের শান্তি ও সম্পদ বিনষ্ট হয় এমন কিছু যাতে না ঘটে। এটাই গণতন্ত্রের ব্যাকরণ।  

৩.

আওয়ামী লীগের নেতারা অভিযোগ করে চলেছেন, লন্ডনে বসে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমান সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছেন। আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী বিএনপির কোনো নেতা বা নেত্রী যদি লন্ডনে বসে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন, সরকারের প্রথম কর্তব্য হবে যুক্তরাজ্যের সরকারকে বিষয়টি জানানো। সে রকম কোনো বার্তা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। এর আগে দিল্লিতে ইসরায়েলের এক রাজনীতিকের সঙ্গে (দেশটির সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কই নেই এবং কথিত ওই রাজনীতিক ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের লোক বলেও ব্যাপকভাবে প্রচারিত) বিএনপির এক যুগ্ম মহাসচিব বৈঠক করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। তাঁদের একত্রে ছবিও নানা সূত্রে দেশে চলে এসেছিল। বিএনপির সেই নেতা এখন অন্য মামলায় কারাগারে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ষড়যন্ত্র’ তত্ত্বটি অনেকটা গ্রামে বাঘ আসার মতো। এক দুষ্টু বালক প্রতিদিন বাঘ এসেছে বলে চিৎকার করে গ্রামবাসীকে এক জায়গায় জড়ো করে। কিন্তু গ্রামবাসী এসে দেখে বাঘ কোথায়, বিড়ালেরও নামগন্ধ নেই। তারা বালককে ভর্ৎসনা করে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। এরপর সত্যি সত্যি যেদিন বাঘ এল, বালকের শত চিৎকারেও কেউ ঘর থেকে বের হলো না।

তাই আওয়ামী লীগ নেতাদের বলব, ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্র বলে আকাশ না ফাটিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। ষড়যন্ত্রের প্রমাণাদি জনগণের কাছে তুলে ধরুন। আর ষড়যন্ত্র যে সব সময় ঘরের বাইরে থেকে হয়, তা-ও ভাববেন না। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করেছিল, তাদের একাংশ দলের ভেতরেই ছিল। বাইরের ষড়যন্ত্র নিয়ে শুধু মাথা না ঘামিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের উচিত হবে দলের ভেতরের খবর নেওয়া। 

এই যে সারা দেশে আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে, ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে, যুবলীগের নাম ভাঙিয়ে একশ্রেণির নেতা-কর্মী দখলবাজি, চাঁদাবাজি করছে, টেন্ডারবাজি করছে, ষড়যন্ত্র নিয়ে সদা উদ্বিগ্ন সরকার তাদের কজনের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে, নিচ্ছে? নারী লাঞ্ছনার দায়ে বগুড়ায় এক তুফান ধরা পড়েছে, আর তুফানেরা কোথায় আছে? নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নূর হোসেনের সহযোগীরা মামলার সরকারপক্ষের কৌঁসুলির মেয়েকে বিষ মেশানো মিষ্টি খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল বলে পত্রিকায় খবর এসেছিল। সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে ওই সহযোগীদের বিরুদ্ধে? সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি করছে। কিন্তু খুনের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে সসম্মানে ছেড়ে দিয়ে সেটি সম্ভব নয়। আইনের শাসন আলগা হলেই ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর হয়ে ওঠে।

দলের কোনো নেতা-কর্মী অঘটন ঘটালে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতারা বহিষ্কার বা সাময়িক বহিষ্কারের আদেশ দিয়ে দায়িত্ব এড়াতে চান। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দলের কেউ নয় বলে ঘোষণা দেন। কিন্তু দলে বা সংগঠনে এ ধরনের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বা দানব যাতে তৈরি না হতে পারে, সে জন্য কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?

আওয়ামী লীগ বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামীর সংস্রব ত্যাগ করতে বলছে। খুবই ভালো কথা। কিন্তু যখন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কমিটিগুলোতে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ভিড় দেখা যায়, যখন জামায়াত পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের যুক্ত হতে দেখি তখন আর তাঁদের এই বক্তব্যের সারবত্তা থাকে না। রাজশাহীর বাগমারা আওয়ামী লীগের একাংশ দলীয় সাংসদের বিরুদ্ধে যখন বিএনপি-জামায়াত তোষণ, জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ করে, তখন মনে হয় ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়।’

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।