বেল্ট অ্যান্ড রোডের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

শ্যাং-জিন ওয়েই
শ্যাং-জিন ওয়েই

২০১৩ সাল থেকেই চীন তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্প নিয়ে এগোতে শুরু করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ থেকে শুরু করে নীতিগত সংযোগের মাধ্যমে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের ৬০টি দেশকে যুক্ত করা। সমালোচকদের উদ্বেগ, চীন হয়তো এর মাধ্যমে ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে চাইবে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মতো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য তাকে এটা করতে হবে। কিন্তু সে এমন প্রকল্প নিতে পারে, যার তেমন কোনো অর্থনৈতিক গুরুত্ব থাকবে না। কিছু শর্ত মেনে চলা গেলে এই উদ্যোগের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা আরও জোরালো হবে।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এটা নিশ্চিত হয়েছে, বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের অনেক দেশে অবকাঠামোর ঘাটতি আছে। বড় ধরনের অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগের ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আর চীন ঠিক সেই ধরনের প্রকল্পে বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। এই প্রকল্পভুক্ত বাংলাদেশ ও কিরগিজস্তানে বিদ্যুতের ঘাটতি আছে। এ কারণে তাদের উৎপাদন খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত ও রপ্তানির সম্ভাবনা বিনষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক একাঙ্গীকরণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য যে বন্দর দরকার, তার ঘাটতি আছে।
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের লক্ষ্য হচ্ছে এসব দেশকে এই বাধাগুলো উতরাতে সহায়তা করা। এই প্রকল্পের আওতায় বন্দর, সড়ক, বিদ্যালয়, হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও গ্রিড নির্মাণে বাহ্যিকভাবে অর্থায়ন করা হবে। সেই অর্থে এই উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৪৫ সাল-পরবর্তী মার্শাল প্ল্যানের মতো কাজ করতে পারে, যার বদৌলতে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের পুনর্গঠন সম্ভব হয়।
তবে সফলতার জন্য শুধু বাহ্যিক অর্থায়ন যথেষ্ট নয়। গ্রহীতা দেশগুলোকে বড় বড় সংস্কারকাজেও হাত দিতে হবে, যাতে নীতিগত স্বচ্ছতা ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায় এবং যার মাধ্যমে বিনিয়োগ–ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব। মোদ্দা কথা, এই উদ্যোগের ফল পেতে হলে পরিপূরক সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।
চীনের বেসরকারি কোম্পানিগুলো এই প্রকল্পে কাজ পেলে চীনের জন্য তা অর্থনৈতিকভাবে প্রলুব্ধকর। ২০১৩ সালে চীন যখন প্রথম বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ নেয়, তখন তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল সাড়ে চার লাখ কোটি ডলার। কিন্তু এ থেকে তারা বেশি মুনাফা পাচ্ছিল না, বছরে ১ শতাংশের কম। চীনের নিজস্ব মুদ্রার সাপেক্ষে এই আয় ছিল নেতিবাচক, বিশেষ করে যখন ডলারের বিপক্ষে চীনা মুদ্রা রেনমিনবির মূল্য বাড়ছিল।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাব্য মুনাফার বিবেচনায় এই বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের বিনিয়োগ চীনের জন্য ব্যয়বহুল হবে না। চীনের জিডিপি-বিনিয়োগের অনুপাতের হার ৪০ শতাংশের বেশি, যার আংশিক কারণ হচ্ছে দেশটির অনুন্নত অবকাঠামো ও অপর্যাপ্ত অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণ। এই দুর্বলতা বিবেচনায় নিয়েই বলা যায়, ওই প্রকল্পে বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে চীনসহ অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর বাণিজ্যের পরিমাণ অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে।
তার মানে এই নয় যে এসব বিনিয়োগে চীনের একেবারেই ঝুঁকি নেই। এখান থেকে কত মুনাফা আসবে, তা নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তের ওপর। এ কথা বলার বিশেষ কারণ হলো, চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে দক্ষতা মূল বিবেচ্য বিষয় না হওয়ায় তারা স্বল্প মুনাফার প্রকল্প হাতে নিতে পারে। সে জন্য তাদের কার্যক্রম সতর্কতার সঙ্গে নজরদারি করা প্রয়োজন। এই প্রকল্পের কৌশলগত লক্ষ্য থাকলেও তার খরচ ও মুনাফার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অপরিমেয়। তাই কেউ ভাবতেই পারেন, চীন আগে কেন এই প্রকল্প হাতে নেয়নি।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশও এই প্রকল্প থেকে লাভবান হতে পারে। বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের এক দশক পরও পুনরুদ্ধারের হার খুবই কম। এ ধরনের সাহসী ও বড় প্রকল্প বৈশ্বিক সম্মিলিত চাহিদা সাময়িকভাবে বাড়িয়ে দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি, ইঞ্জিন, বিমান, উচ্চ প্রযুক্তির নির্মাণ উপকরণ এবং তার আর্থিক, হিসাবরক্ষণ, শিক্ষাগত ও আইনি সেবার চাহিদা বেড়ে যেতে পারে।
দীর্ঘ মেয়াদে নতুন অবকাঠামো উপকরণগত বাধা দূর করবে, এতে উৎপাদন ব্যয় কমে আসবে। এতে উৎপাদনশীলতা ও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাবে। বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প যদি উচ্চ পরিবেশ ও সামাজিক মানদণ্ডের নিরিখে প্রণয়ন করা যায়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তন ও অসমতা দূর করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে পারবে। যত বেশি দেশ এতে অংশ নেবে, তত দ্রুত এই মান অর্জন করা সম্ভব।
যখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশ নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাচ্ছে এবং বাণিজ্য বাধা ও সীমান্তদেয়াল তৈরির কথা ভাবছে, তখন সড়ক ও সেতু নির্মাণে পৃথিবীকে মনোযোগ দিতে হবে। আক্ষরিক ও আলংকারিক দুই অর্থেই বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প সে রকমই ব্যাপার।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
শ্যাং-জিন ওয়েই: এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ।