কাতালোনিয়া: আলোচনা, নাকি সংঘাত

কাতালোনিয়ার জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে
কাতালোনিয়ার জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে

স্পেনে গণতন্ত্র ফিরে আসার পর আমরা দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণের সাক্ষী হতে যাচ্ছি। এই বছর কয়েক আগেই স্পেনের বাইরের প্রায় কেউই জানত না যে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার স্পৃহা আছে। কিন্তু এখন বেশির ভাগ মানুষেরই এই অঞ্চল সম্পর্কে অন্তত ভাসা–ভাসা ধারণা আছে। এখানকার মানুষের স্বপ্ন সম্পর্কে তারা এখন অবগত।

যাহোক, এ মাসের ১০ তারিখে কাতালানের প্রেসিডেন্ট কার্লোস পুজেমন দেশটির সংসদে শান্তিপূর্ণ পথে স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষা সবচেয়ে চমৎকারভাবে ব্যক্ত করেছেন। বক্তৃতায় তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা বাতিল করে স্পেনের সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনার আহ্বান জানান। এতে বোঝা যায়, কাতালোনীয়রা নিজেদের যুক্তিবুদ্ধির কতটা কদর করে, যার জন্য তাদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি আছে।
অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে স্পেন যেকোনো বিরোধী মত খণ্ডনের চেষ্টা করেছে। আর গণভোটের দিন গণমাধ্যমের কল্যাণে সারা পৃথিবী দেখেছে, কাতালানে কতটা সহিংসতা হয়েছে। স্পেনও দেখিয়ে দিয়েছে, রাষ্ট্র হিসেবে তারা কী করতে পারে। ছবির মাধ্যমে মানুষের আবেগ সঞ্চারিত হয় বলে রাজনৈতিক যোগাযোগে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের দিন স্পেন সরকার এক শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে: প্রয়োজন হলে নিজেদের নাগরিকদের ওপরও আমরা বল প্রয়োগ করতে পারি এবং তা করব। তবে তারা কাতালোনিয়ার গণভোট বন্ধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় পৃথিবীবাসী দেখেছে, রাষ্ট্র হিসেবে তারা কতটা অক্ষম। নির্বাচন বন্ধের সব চেষ্টা করেও তারা সফল হয়নি। অন্যদিকে কাতালান সরকার ইউরোপের প্রতিষ্ঠিত রীতির সঙ্গে অনেকটা সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল অবলম্বন করে। তাদের কাজের ধরনটা খুব সহজ ছিল, সেটা হলো তারা প্রথমত আনুষ্ঠানিকভাবে গণভোটের অনুরোধ জানাল। এরপর দাবি নাকচ করা হলে তারা রাষ্ট্রকে না মেনে যেকোনো উপায়ে তা করে বসল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো তারা কিন্তু এত সব করেছে সহিংসতার পথে না গিয়ে। আর পরিকল্পনার শেষ অংশটুকু বাস্তবায়িত হলো কাতালান সংসদে পুজেমনের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে, যেখানে তিনি আলোচনার দাবি জানান। তিনি বলেন, স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার জন্য জনগণ যে রায় দিয়েছে তিনি তা মেনে নিয়েছেন, কিন্তু স্পেনের সঙ্গে আলোচনা চান বলে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে পিছিয়ে এসেছেন। এতে যেমন বিচারবুদ্ধির সুস্থতা আছে, তেমনি তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনৈতিক আচরণ মডেলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যার ভিত্তি হচ্ছে আলোচনা, মতৈক্য ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্পেন রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক অপরিপক্বতার জন্য এ ধরনের আলোচনা হওয়া সম্ভব নয়। সে কারণে পুজেমনের বক্তৃতার পরও কাতালোনিয়া সম্পর্কে স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান বদলায়নি। পুজেমনের বক্তৃতার পর স্পেনের প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাতালোনিয়াকে ‘পরিষ্কার’ করে বলতে হবে তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে কি না। এরপর তিনি সংবিধানের এক ধারা উদ্ধৃত করে বলেন, এর মাধ্যমে কাতালোনিয়ার স্বায়ত্তশাসন রহিত করা সম্ভব হবে। এই উত্তরের মধ্য দিয়ে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাহয় নিশ্চিত করে বুঝিয়ে দিলেন, কাতালোনিয়ার সঙ্গে স্পেনের আলোচনার দরজা উন্মুক্ত নয়। স্পেনের মূলধারার গণমাধ্যমেও এর প্রতিফলন ঘটে। আর পুজেমনের বক্তৃতার পর স্পেনের দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়, কাতালানের তরফ থেকে আলোচনার দাবিকে তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও দেশদ্রোহ বলে মনে করে।
তবে বর্তমান পরিস্থিতি উভয় পক্ষের জন্য হতাশাজনক। একদিকে কাতালানরা মনে করে স্বাধীনতার ঘোষণা বাতিল করা তাদের এত দিনের সংগ্রাম ও গণভোটের উৎসাহী ফলাফলের সঙ্গে প্রতারণার শামিল, অন্যদিকে স্পেনের সমাজের একটি অংশ চায়, দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার কাতালানের পৃথক হওয়ার দাবির ব্যাপারে আরও শক্ত অবস্থান নিক। পুজেমনের বক্তৃতার এক দিন আগে স্পেনের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী পাবলো কাসাদা বলেন, পুজেমন স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তাঁর অবস্থাও লুইস কমপ্যানিসের মতো হবে। কাতালানের স্বাধীনতা ঘোষণার কারণে ১৯৩৪ সালে দ্রুত বিচারে তাঁর ৩০ বছরের কারাদণ্ড হয়। পরবর্তীকালে ১৯৪০ সালে ফ্রাঙ্কোর জমানায় তাঁর ফাঁসি হয়। তাঁর এই মন্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে।
সময়টা স্পেনের মতো গভীরভাবে বিভক্ত দেশের মানুষের জন্য ভীতিকর হয়ে উঠেছে। কিন্তু স্পেন ও কাতালানের অনেক মানুষ উভয় পক্ষকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানাচ্ছে—এটা আশার কথা, সে তারা স্বাধীনতার পক্ষে থাকুক বা বিপক্ষে। কাতালান সরকার ইতিমধ্যে এই আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। স্পেনও এই যৌক্তিক অবস্থান নিতে পারে। এই দ্বন্দ্ব নিরসনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আরও উন্মুক্ত ও সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে। তথাকথিত স্প্যানীয় গর্বে আঘাত করতে তাদের ভীত হওয়া চলবে না।
স্পেন সরকার সংবিধানের এক ধারাবলে কাতালোনিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছে। এই অবস্থায় কাতালোনিয়ার সামনে দুটি পথ খোলা আছে: স্পেনকে অগ্রাহ্য করে যেকোনো উপায়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করা (যেটা ঠিক হবে না) অথবা স্পেনের কথা মেনে নিয়ে স্বাধীনতার প্রস্তাব প্রত্যাহার করা, যদিও জনগণ তাদের এই রায় দেয়নি।
কাতালোনিয়া স্পেনকে অগ্রাহ্য করে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। সে ক্ষেত্রে স্পেন পূর্ণ শক্তি নিয়ে আইন ও বল প্রয়োগ করবে। তারা কাতালানকে স্তব্ধ করে দেবে। ফলে কাতালানের ইতিহাসে আরেকটি তিক্ত অধ্যায় যুক্ত হবে। এতে তাদের সমস্যার সমাধান হবে না। বরং পরবর্তী ঘটনা পর্যন্ত তারা নিশ্চুপ রাখবে। তারা এখন এই আশা বুকে বয়ে বেড়াতে পারে যে কাতালোনিয়া আবারও স্পেন সাম্রাজ্যে পরিবর্তনের সূচনা করবে। স্পেনের বিরোধীদের মধ্যে কাতালানকে আরও স্বনিয়ন্ত্রণ দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়েছে, যার বিনিময়ে তাকে বিপ্লবী দাবি ছাড়তে হবে।
বিশ্বাস করতে চাই, এখনো এই সমস্যার যৌক্তিক সমাধান বের করা সম্ভব। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মধ্যস্থতা করতে পারে। তাদের পক্ষে এটা নিশ্চিত করা সম্ভব যে উভয় পক্ষ সম-অবস্থান থেকে আলোচনায় অংশ নেবে। তবে যা-ই হোক না কেন, এটা নিশ্চিত যে কাতালোনিয়ার সামনে কঠিন সময়।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।

রাফা পেরেজ বেল: বার্সেলোনাভিত্তিক লেখক।