এবার আসছে সির চিন্তাধারা?

প্রেসিডেন্ট  সি চিন পিং
প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং

বিশ্বের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটির প্রতিনিধিরা আজ তাঁদের রাজনৈতিক দিশা নির্ধারণের সম্মেলন উনিশতম কংগ্রেসে মিলিত হচ্ছেন। এই দলটি হচ্ছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি। যদিও পার্টির নেতারা কখনো কখনো বলে থাকেন যে দল ও সরকার এক নয়, কিন্তু বাস্তবে সেখানে রাষ্ট্র ও দলের মধ্যে কোনো পার্থক্যরেখা টানা যায় না। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) হিসাবে তাদের দলের সদস্যসংখ্যা এখন প্রায় নয় কোটি। এসব পার্টি সদস্য তাঁদের বিভিন্ন ইউনিটে নির্বাচনের মাধ্যমে যে ২ হাজার ৩০০ প্রতিনিধি নির্বাচন করেছেন, তাঁদেরই নিয়ে গণকংগ্রেস (১৩ জন অবশ্য নানা অনিয়মের কারণে অযোগ্য ঘোষিত হয়েছেন)। আজ যে কংগ্রেসের উদ্বোধন হবে, সেটি বহাল থাকবে পাঁচ বছর। এবারের কংগ্রেসের প্রতি বাকি বিশ্বের আগ্রহের মূল কারণ হচ্ছে, দলের নেতৃত্বে কী ধরনের পরিবর্তন আসে, সেটা দেখা।

দলের সেক্রেটারি জেনারেল পদে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের নেতৃত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে কিছু আনুষ্ঠানিকতা থাকবে। কিন্তু তাঁর পরের দুটি স্তর—পলিট ব্যুরো ও স্ট্যান্ডিং কমিটিতে কারা আসছেন, সবার কৌতূহলী দৃষ্টি সেদিকেই। এই দুই কমিটির অধিকাংশ নেতাই অবসরে যাবেন, কেননা, তাঁদের বয়স ৬৮ পেরিয়ে গেছে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের ধারণা, মি. সি তাঁর ক্ষমতা আরও সংহত করতে পারেন। নতুন কমিটিগুলোতে তাঁর অনুসারীরাই জায়গা পাবেন। এসব পর্যবেক্ষকের ধারণা, মি. সি রাষ্ট্র পরিচালনায় যেসব নীতি গ্রহণ করেছেন, সেগুলো এখন সি চিন পিং চিন্তাধারা হিসেবে দলের রাজনৈতিক ঘোষণায় স্থান পাবে। মাওয়ের চিন্তাধারার মতোই শোনা যাবে সির চিন্তাধারার কথা। এমনকি প্রেসিডেন্ট দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার প্রথা ভাঙার ঘোষণাও দিতে পারেন বলে অনেকের ধারণা।

সির অনুসৃত নীতিমালার মূল কথা হচ্ছে অর্থনৈতিক সংস্কার। এই অর্থনৈতিক সংস্কারের মূল কথা হচ্ছে বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো। দলটির ঊনবিংশতি কংগ্রেসের বিষয়ে একদল এশীয় সাংবাদিকের সঙ্গে গত মাসে কথা বলেন সিপিসির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের উপপরিচালক শি গুহোই। তাঁর কথায়, ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত সিপিসির ৯৬ বছরের ইতিহাসের প্রথম ২৮ বছর কেটেছে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনে, পরের ২৯ বছর গেছে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় এবং ৩৯ বছর ধরে দলটির মনোযোগ হচ্ছে সংস্কার সাধন এবং অর্থনৈতিক উদারীকরণে। তাঁর কথায়, চীন এখন অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্র এবং বৈশ্বিক পরিসরে উন্নয়নের এক নতুন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। তিনি জানান, সিপিসি চারটি বিষয়কে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে—সুশাসন, সংস্কার ও উদারীকরণ, বাজার অর্থনীতির উন্নয়ন এবং বাইরের ঘটনাপ্রবাহে প্রয়োজনীয় ভূমিকা গ্রহণ। সিপিসি চীনের জন্য যেসব বিষয়কে চ্যালেঞ্জ মনে করছে, সেগুলো হচ্ছে অর্থনীতির পুনর্গঠন, পরিবেশদূষণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গৃহায়ণ এবং আয়বৈষম্য দূর করার মতো সামাজিক চাহিদা পূরণ।

চীনে অর্থনৈতিক উদারীকরণের শুরু দেং শিয়াও পিংয়ের সময় থেকে। ১৯৭৮ সালে সেই উদারীকরণ শুরু হওয়ার পর থেকে দেশটি সেখান থেকে আর পিছু হটেনি। বরং প্রায় কুড়ি বছর আগে হংকং ফিরে পাওয়ার পর চীন এক দেশে দুই নীতি অনুসরণে বাড়তি উৎসাহ পেয়েছে। হংকংয়ের মুক্তবাজার নীতি চীনের মূল ভূখণ্ডেও আমদানি করা হয়েছে এবং দুই ধরনের অর্থনীতির মিশ্রণ ক্রমেই বেড়েছে। প্রথমে সাংহাই, তারপর অন্যান্য জায়গায়। বিশেষ বিশেষ অর্থনৈতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। এখন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি বেশ জোর গলায় কৃতিত্ব দাবি করে যে তারা দেশটিতে ৬০ বছরের ব্যবধানে মানুষের গড় আয়ু ৩৮ বছর থেকে ৭৫ বছর—প্রায় দ্বিগুণে উন্নীত করতে পেরেছে। দেশটিতে এখনো চার কোটি লোক দরিদ্র এবং প্রেসিডেন্ট সির লক্ষ্য হচ্ছে ২০২০ সালের মধ্যেই দেশটিকে পুরোপুরি দারিদ্র্যমুক্ত করা। সিপিসির লক্ষ্য হচ্ছে চীনকে দারিদ্র্যমুক্ত করে দলটির শতবার্ষিকী উদ্‌যাপন।

চীনের উন্নয়নের মূল রহস্য হচ্ছে বাজার উদারীকরণের পর থেকে চীন বিশ্বের কারখানা হিসেবে কাজ করেছে। যে কারণে তারা বিশ্বের এক নম্বর রপ্তানিকারক। আবার পণ্য তৈরির জন্য কাঁচামাল ও জ্বালানির যে বিপুল চাহিদা তৈরি হয়েছিল, তার সুবাদে আমদানিতেও তারা এখন এক নম্বর। চীনা নীতিনির্ধারক ও নেতাদের এখনকার লক্ষ্য হচ্ছে উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে পা রাখা। আর সেখানেই প্রেসিডেন্ট সি এনেছেন বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প। বাণিজ্য প্রসার নীতির অংশ হিসেবে তাঁর এই প্রকল্পের কেন্দ্রে আছে প্রাচীনকালের সিল্ক রোড বা বাণিজ্যপথগুলোর পুনরুজ্জীবন—স্থলপথ ও সমুদ্রপথ। সেই উদ্যোগের অনেকটাই এখন বাস্তব রূপ নিতে শুরু করেছে। বেইজিং থেকে পণ্য নিয়ে রেলগাড়ি পরীক্ষামূলকভাবে পৌঁছে গেছে লন্ডনে। মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপের একটা বড় অংশের সঙ্গে ইতিমধ্যে স্থলপথে বাণিজ্যিক পণ্য চলাচল করছে। পণ্য পরিবহনের সময় ও খরচ নাটকীয়ভাবে কমে আসছে। চীন তার অন্য প্রতিবেশীদেরও এই বাণিজ্যপথে যুক্ত করতে চায়। আর দক্ষিণ ও পূর্ব দিকের প্রতিবেশীদের মধ্যে বাংলাদেশও আছে।

বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের পেছনে চীনের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাও যে আছে, তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হওয়ার পর সেই রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা যে আরও দানা বাঁধবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। এই রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার অংশ হচ্ছে এশিয়ায় তার নিজের নেতৃত্বকে সংহত করা এবং একই সঙ্গে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। তাই যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন বিশ্বায়নের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, চীনা প্রেসিডেন্ট সি তখন বেশি বেশি করে বিশ্বায়নের কথা বলছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার বৈশ্বিক চুক্তি প্যারিস সনদ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন, তখন প্রেসিডেন্ট সি ওই বৈশ্বিক লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। আমরা জানি, বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুই দূষণকারী দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।

দ্রুত শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও উন্নয়নের পরিবেশগত মূল্য যে কত চড়া, তা উপলব্ধির একটা বড় জায়গা হচ্ছে বেইজিং। বেইজিংয়ে সকাল হতে কখনো কখনো দুপুর হয়ে যায়। কথাটি আক্ষরিক অর্থে ঠিক না হলেও সূর্যের চেহারা দেখতে পাওয়া বা না পাওয়ার নিরিখে পুরোপুরি ঠিক। মধ্য সেপ্টেম্বরের দুই সপ্তাহের অভিজ্ঞতা আমার সে রকমই। একধরনের ঘন কুয়াশা—জ্বালানি বর্জ্য তথা শিল্পপ্রসূত ধোঁয়ার আস্তরণ, ইংরেজিতে যা Smog বলে পরিচিত। জ্বালানি বর্জ্য তথা শিল্পপ্রসূত ধোঁয়ায় যেসব কণাকার পদার্থ (particulate matter, PM2.5) থাকে, তা মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। বেইজিংয়ের বাতাসে এই ক্ষতিকর পদার্থ কণিকার হার স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত তিন গুণ বেশি। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে তা আরও বেড়ে বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছে যায়।

শুধু বেইজিংই নয়, দেশটিতে এ রকম দূষণ ঘটছে আরও অনেক শহরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মূল্যায়নে ২০১১ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ু যে শহরটিতে ছিল, সেটি হচ্ছে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় গানসু প্রদেশের রাজধানী লানঝো। সেখানে আছে বিশ্বের বৃহত্তম কপার খনি। খনির পাশাপাশি ভারী এবং পেট্রোরসায়ন–শিল্পই ওই শহরটির দূষণের প্রধান কারণ। কর্তৃপক্ষ এরপর ১৩টি বৃহদাকার শিল্পের কার্যক্রম কমাতে বাধ্য করে, দুই শতাধিক দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানে শীতকালে উৎপাদন বন্ধ করে দেয় এবং ৭৮টি প্রতিষ্ঠানকে শহরের বাইরে এক নতুন শিল্পপার্কে স্থানান্তর করে। এসব পদক্ষেপের ফলে লানঝোর বাতাসের দূষণ চীনের সব শহরের তুলনায় দ্রুততম সময়ে কমেছে।

দেশটির ২৮টি শহরের বায়ুদূষণ নিয়ে কর্তৃপক্ষ উদ্বিগ্ন এবং এগুলোর মাত্রা কমাতে এখন বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের মধ্যে আছে কয়লার ওপর নির্ভরশীলতা কমানো, কম দূষণ করে এমন উন্নত মানের কয়লা ব্যবহার, বেইজিং থেকে বড় বড় রাসায়নিক কারখানা স্থানান্তর, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো ইত্যাদি। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে চীন এখন সবার থেকে এগিয়ে। তবে তা এখনো দেশটির মোট জ্বালানি চাহিদার মাত্র ১ শতাংশের মতো। বিশ্বের বৃহত্তম গাড়ির বাজার চীনে সরকার এখন বিক্রেতাদের নির্দেশ দিয়েছে যে তারা জ্বালানি তেলচালিত গাড়ি যতগুলো বিক্রি করবে, তার চেয়ে বেশি বিক্রি করতে হবে বিদ্যুৎ বা ব্যাটারিচালিত গাড়ি। ফোর্বস পত্রিকা জানাচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যেই চীন জ্বালানি তেলচালিত গাড়ি থেকে মুক্ত হতে চায়।

উন্নয়নের তোড়ে পাহাড় কাটা, বনাঞ্চল ধ্বংস কিংবা জলাশয় নষ্ট করার মতো ক্ষতিকর কাজগুলো বন্ধে এখন কঠোর নীতি নেওয়া হয়েছে। পরিবেশদূষণের জন্য হাজার হাজার শিল্পকারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নতুন নগর গড়ে তোলা বা অন্য যেকোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এখন তার পরিবেশগত টেকসই যোগ্যতা নিশ্চিত করার বিধান করা হয়েছে। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট এ বছরের ২ সেপ্টেম্বর জানিয়েছে যে পরিবেশগত মান অনুসরণ না করায় দেশটি ১৮ হাজার কোম্পানিকে শাস্তি দিয়েছে। পরিবেশগত মান অনুসরণে সরকারি অধিকর্তাদের গাফিলতি-দুর্নীতির বিরুদ্ধেও কঠোর হয়েছে সরকার এবং এ পর্যন্ত ১২ হাজার কর্মচারীকে নানা ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। লানঝোতে আমার সাম্প্রতিক সফরের অভিজ্ঞতাতেও পরিবেশগত দিকটিতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিশেষ মনোযোগ লক্ষ করেছি। পুরোনো খনির ব্যবস্থাপনা, নতুন শিল্পপার্ক নির্মাণ এবং পরিচালনা ও নগর ব্যবস্থাপনায় এগুলো খালি চোখেই দেখা যায়। যেমন সন্ধ্যাবেলার আলোঝলমলে শহরে রাত ১১টার পর একটিও নিয়ন বাতি সচল থাকে না।

শুরু করেছিলাম চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ঊনবিংশতি কংগ্রেসের কথা দিয়ে। এই কংগ্রেসে চীন তার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক গতিধারা এবং রাজনৈতিক যে দিশা গ্রহণ করবে, তার প্রভাব শুধু ১৪০ কোটি চীনা নাগরিকের জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, সেটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, চীনের ভবিষ্যৎ আমাদের কতটা এবং কীভাবে প্রভাবিত করবে? বিশ্বায়নের ধারায় নেতৃত্ব দেওয়ার রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা থেকে প্রেসিডেন্ট সি যে সিল্ক রোড পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ নিয়েছেন, অনেক অর্থনীতিবিদই একে নতুন মার্শাল প্ল্যান বলে অভিহিত করেছেন। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙা করার পাশাপাশি দীর্ঘ মন্দায় ভোগা পাশ্চাত্যের দেশগুলোর জন্যও তা টনিকের কাজ করতে পারে বলে তাঁদের ধারণা। কিন্তু একই সঙ্গে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার মাত্রা নিয়ে সন্দেহও থেকে যাচ্ছে। সেই সন্দেহ কি প্রেসিডেন্ট সি দূর করতে পারবেন?

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।