জেলা শহরের শিক্ষা ঢাকার চেয়ে ভালো

কয়েক দিন আগে ঢাকার পাসপোর্ট অফিসের দিকে যাচ্ছিলাম গাড়িতে। কারওয়ান বাজারে দেখলাম এক বন্ধু পাশের ফুটপাত দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে হাঁটছিলেন। ডেকে শুনলাম সেও আগারগাঁওয়ের দিকেই যাচ্ছে। বললাম, গাড়িতে উঠে আয়, একসঙ্গে যাই।
একটুও না থেমে ও বলল, তুই যা, আমার তাড়া আছে!
ঢাকা শহরের জ্যামের এর চেয়ে ভালো তুলনা সম্ভবত আর নেই। আমার বন্ধুটি জানে গাড়িতে গেলে কারওয়ান বাজার থেকে আগারগাঁও যেতে ঘণ্টা দুয়েক সময় লেগে যেতে পারে, তার চেয়ে হেঁটে যাওয়াই উত্তম। বন্ধুর এই ধারণাটা মোটেই অমূলক নয়। সব বিশ্লেষণ বলছে, ঢাকায় এখন আর গাড়ি চলে না, হাঁটে কিংবা থেমে থাকে!
রাস্তার তুলনায় গাড়ির সংখ্যা বেশি এবং বাংলাদেশের অপর নাম হয়ে যাওয়া জনবহুল ঢাকা শহর এখন এক নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে। আমি খুব নিশ্চিত নই এই শহরটিকে আর শহরের দিকে তাকিয়ে বাঁচানো যাবে কি না।
তবে শহরটিকে বাঁচানোর একটা উপায় হতে পারে শহরের বাইরে তাকানোর মাধ্যমে। ঢাকাকে রক্ষা করার উপায় হলো আগামী বছরগুলোতে ঢাকার মতো সুযোগ-সুবিধা অন্তত ১০টি শহরে ছড়িয়ে দেওয়া। আর সেটির শুরু হওয়া দরকার এখনই।
প্রথমেই হাত দিতে হবে শিক্ষায়। যখনই ঢাকা থেকে কোনো সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ঢাকার বাইরে বদলি হন, তখনই তিনি তাঁর স্ত্রী-পুত্রদের ঢাকায় রেখে যান, সঙ্গে নেন না। আর বলেন, জেলা শহরে তাঁর সন্তানের পড়ার মতো ভালো স্কুল নেই।
তাঁরা কেন এই অজুহাতটি দেন তা আমার ঠিক বোধগম্য হয় না। কিন্তু ১৭ বছর ধরে দেশজুড়ে গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজনের সূত্র ধরে আমি হলফ করে বলতে পারি, ঢাকার বাইরের স্কুলগুলো বরং ঢাকার তথাকথিত এবং বিখ্যাত স্কুলগুলো থেকে কয়েক গুণে ভালো। আমি বরং একটা উদাহরণ দিই। আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের শিক্ষার্থীরা ২০১০ সাল থেকে প্রতিবছরই এখন বিশ্বখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), হার্ভার্ড বা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে পড়তে যাচ্ছে। এ বছর এমআইটিতে পড়তে গিয়েছে আদীব হাসান আর কেমব্রিজে পড়তে গেছে সাজিদ আখতার ও আসিফ-ই-এলাহী।
এদের মধ্যে আদীব ময়মনসিংহ, সাজিদ সিরাজগঞ্জ আর আসিফ সিলেটে তাদের স্কুল ও হাইস্কুল পর্ব শেষ করেছে। তাদের কেউ ঢাকার বিখ্যাত কোনো স্কুলে পড়েনি! শুধু এই তিনজন নয়, সদ্য স্নাতক হয়ে সিলিকন ভ্যালিতে একটি স্টার্টআপ কোম্পানির প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত তারিক আদনানের পড়ালেখা কুষ্টিয়ায়, নাজিয়া চৌধুরী আর বৃষ্টি শিকদার পড়েছে চট্টগ্রামে। এই কয়েক বছরে যে সাতজন শিক্ষার্থী এমআইটিতে বৃত্তি নিয়ে পড়তে গেছে তাদের মধ্যে দুজন ময়মনসিংহের, দুজন চট্টগ্রামের, একজন দিনাজপুর, একজনের স্কুল চট্টগ্রাম ও কলেজ ঢাকা কলেজ এবং মাত্র একজন ঢাকা শহরে পড়েছে! কাজেই যাঁরা ভাবছেন ঢাকার বাইরের স্কুল-কলেজে পড়ালেখা হয় না, তাঁরা মূলত বালুতে মুখ গুঁজে আছেন।
আর এই ভুল ধারণা রয়েছে জেলা প্রশাসকদেরও। এই কলাম লেখার সময় কয়েকটি জেলা শহরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, সেখানকার জেলা প্রশাসকদের সন্তানেরা জেলার স্কুলে পড়ে না, তারা ঢাকায় রয়ে গেছে। জেলা প্রশাসকদের মতো অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারাও পড়ালেখা আর ভালো স্কুলের দোহাই দিয়ে পরিবারকে ঢাকায় রেখে যান। কিন্তু বিশেষ করে জেলা প্রশাসকদের কথা তোলার একটি কারণ রয়েছে। পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসক জেলার প্রধান স্কুলগুলোর পরিচালনা কমিটির প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ছেলেটি যদি বালক বিদ্যালয়ে আর মেয়েটি যদি বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ত, তাহলে জেলা প্রশাসক সব সময় একটি তৃতীয় মতের খোঁজ পেতেন, যা তিনি ব্যস্ততা ও চাটুকারিতার কারণে পান না। আর তাঁর ছেলেমেয়েরা যদি জেলা শহরে পড়ত, তাহলে অন্য কর্মকর্তারাও তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার সাহস পেতেন, উৎসাহ পেতেন। আর জেলা প্রশাসক নেতৃত্ব দিয়ে শুরুতে জেলার দুটি বিদ্যায়তনকে বিশেষ পর্যায়ের মানে উন্নীত করতে পারতেন সহজেই।
আমার ধারণা, জেলা শহরের বিদ্যালয়গুলোর চাকচিক্য আর জৌলুশ না থাকতে পারে কিন্তু সেগুলোর শিক্ষার মান ঢাকার বিখ্যাত স্কুলগুলোর চেয়ে কোনো অংশে কম না হলেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে স্কুলগুলোর কথা আগের মতো ছড়িয়ে পড়ছে না। বিগত আট বছরে আনন্দ মোহন কলেজের দুজন শিক্ষার্থী এমআইটিতে সুযোগ পেয়েছে, যারা কিনা তাদের স্কুলজীবনও ময়মনসিংহে কাটিয়েছে। এমন কলেজ দ্বিতীয়টি কই?
হ্যাঁ, বলতে পারি ঢাকার মতো প্রাইভেট পড়ানো এবং কোচিং করানোর ব্যবস্থা জেলা শহরগুলোতে নেই। কারণ, সেখানে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানোর জন্য বুয়েটের শিক্ষার্থীরা কিংবা চৌকস কোচিং সেন্টার নেই। কিন্তু যাঁরা এই যুক্তিটা দেন, তাঁরা একটু ভেবে দেখবেন কীভাবে আসিফ-আদীবরা ঢাকার বাইরে থেকে কেমব্রিজ-এমআইটিতে পাড়ি দিতে পারে।
কাজেই জেলা শহরে পড়াশোনা হয় না বলে যে যুক্তিটা দেওয়া হয়, সেটি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং সেসব স্কুল-কলেজের কথা ঢাকার মিডিয়ায় আসে না বলেই তাদের সাফল্যের কথা দেশবাসী জানতে পারে না। এখন যদি তাদের ব্যাপারে আর একটু কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায়, তাহলেই পর্যায়ক্রমিকভাবে সারা দেশে মানসম্মত শিক্ষার (জিপিএ ৫-এর সংখ্যা নয়) ব্যাপারটাকে জোরদার করা যাবে।
বলছিলাম ঢাকার বাইরের ১০টি শহরকে ঢাকার মতো বানানোর কথা। শিক্ষা দিয়ে শুরু করলে অচিরেই সেখানে স্বাস্থ্য, ব্যবসা ইত্যাদি নিয়েও এগোনো যাবে। কারণ, তখন সেখানে দক্ষতার ঘাটতি হবে না। সম্প্রতি যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক স্থাপন করে ঢাকার বাইরে বিশ্বমানের অবকাঠামো গড়ে তোলায় সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ পেয়েছে। এখন সেখানে বেসরকারি উদ্যোক্তারা হাজির হলেই কেবল এই উদ্যোগ পূর্ণতা পাবে।
ঢাকাকে বাঁচানোর জন্য নয়, বাংলাদেশকে আলোকিত করার জন্য আগামী ১০ বছরে ১০টি নগরীকে উন্নত করার কোনো বিকল্প নেই। এই সত্য আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝব, ততই আমাদের মঙ্গল।
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।