অখণ্ডতার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে হবে

শশী থারুর
শশী থারুর

১৯৭৫ সালে ভারত ত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতক করার উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় ‘বিশ্বায়ন’ শব্দটা তেমন একটা ব্যবহৃত হতো না। সীমান্ত পাড়ি দেওয়াটা তখন বেশ বড় ব্যাপারই ছিল। আর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়াও সহজ কর্ম ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর দেখলাম, ভারতীয় পরিচিতির সঙ্গে একধরনের উদ্ভট ও অনভ্যস্ততার ব্যাপার ছিল।
আজকের দিনে বিশ্বায়ন এক অপরিহরণীয় ব্যাপার। তিন দশকের কম সময়ের মধ্যে পৃথিবীতে বাণিজ্য–বাধা অনেকটা কমেছে। অন্যদিকে বিমান টিকিটের সহজপ্রাপ্যতা, স্যাটেলাইট টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের সম্মিলিত প্রভাবে পৃথিবীতে একধরনের ‘বৈশ্বিক গ্রাম’ তৈরি হয়েছে। কিন্তু দুটি প্রতিক্রিয়ামূলক ঘটনায় বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।
জনমত ঘুরে যাওয়ার ক্ষেত্রে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট ক্রান্তিলগ্ন হিসেবে কাজ করেছে। এই সংকটের আগে লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের চক্র থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং গণতন্ত্রের বিস্তার ঘটেছে। ফলে সাধারণভাবে ধারণা তৈরি হয় যে পৃথিবীতে এক স্বর্ণযুগের অভ্যুদয় হয়েছে। ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা এক বিখ্যাত তত্ত্ব দিলেন, মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামে গণতন্ত্র ও উদার পুঁজিবাদের চূড়ান্ত বিজয় হয়েছে।
এরপর সংকট আঘাত হানে এবং যুগের দম্ভ চূর্ণ হয়ে দ্রুত তার সুনামহানি ঘটে। মানুষ দেখল যে বিশ্বায়নের সুবিধাভোগী ও ভুক্তভোগীদের মধ্যে বিরাট ফারাক, এই যুগে শ্রমের মজুরি বাড়ার হার কম হলেও ধনীদের সম্পদ আরও ফুলেফেঁপে উঠেছে। যুক্তরাজ্যে ২০০৮ সালের পর মজুরি বেড়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ, কিন্তু স্টক মার্কেটের আকার বেড়েছে ১১৫ শতাংশ। ক্রেডিট সুইসের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে ৪৬টি বড় অর্থনীতির মধ্যে ৩৫টিতেই সম্পদের বৈষম্য বাড়ছে, ২০০৭ সালের আগে যেটা ছিল মাত্র ১২টি অর্থনীতিতে।
উন্নত দেশের গরিব ও বেকার মানুষেরা ভাবতে শুরু করেছে যে বিশ্বায়িত ব্যবস্থায় তাদের হিস্যা নেই। ভারত ও চীনে কাজ চলে যাওয়ায় তারা এখন রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঠামোকে দোষারোপ করছে। তারা পুরোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার দাবি করছে। তারা সেই পুরোনো অঙ্গীকারে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছে, যে ব্যবস্থায় মনে করা হতো নতুন প্রজন্ম আগের প্রজন্মের চেয়ে ভালো থাকবে।
কিন্তু এই বিশ্বায়নবিরোধী প্রতিক্রিয়ায় পুরো ব্যাপারটা বোঝা যাবে না, এটা স্রেফ কাহিনির অর্ধেক মাত্র। সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের বিরুদ্ধেও প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে, বিশ্বজনীনতা, বহু সংস্কৃতিবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা—এসবের বিপক্ষে মানুষ প্রথাগত জাতিগত, ধর্মীয় ও জাতীয় পরিচিতি নিয়ে বাঁচতে চাচ্ছে।
এই পরিচিতিভিত্তিক প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়। তাঁর স্লোগান ‘যুক্তরাষ্ট্রকে আবার মহান বানাও’ মূলত ‘যুক্তরাষ্ট্রকে আবার শ্বেতাঙ্গ বানাও’-এর গূঢ়লেখ। এই স্লোগান দিয়ে তিনি বেকার, তিক্ত ও ক্রমবর্ধমান হারে বিদেশিবিরোধী হয়ে ওঠা মানুষদের ভোট আকৃষ্ট করেছেন। কিন্তু ট্রাম্প যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেটা আর ফিরে আসছে না। ২০৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমশক্তির সংখ্যাগরিষ্ঠই হবে অশ্বেতাঙ্গ।
ট্রাম্পকে অনন্য মার্কিন মনে করা হলেও তিনি মূলত উদার বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী ও প্রথাগত মানুষদের লড়াইয়ের অংশ। আর তারা সেটা করছে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক শিকড়সম্পন্ন পরিচিতির দোহাই দিয়ে। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান, তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি—তাঁরা সবাই এই ঢেউয়ে সওয়ার হয়ে লাভবান হচ্ছেন। এমনকি যেখানে অতি ডান, বিদেশিবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকেরা ভোটে জিততে পারেননি, সেখানে তাঁরা অনেকটাই এগিয়েছেন, যেমন জার্মানির অল্টারনেটিভ ফার ডয়েচেল্যান্ড।
বামদের ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের কথা ভাবুন, যেখানে তরুণেরা নিজেদের ৯৯ শতাংশ জনগণের অংশ দাবি করে বলেছিলেন, ১ শতাংশ তঁাদের দূরে সরিয়ে রেখেছে। এই আন্দোলন বিকশিত হচ্ছিল। এরপর ডেমোক্রেটিক পার্টিতে জ্যেষ্ঠ সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সের নেতৃত্বে হিলারি ক্লিনটনের বিরোধিতা করা হয়েছে একই কারণে, হিলারি গোল্ডম্যান স্যাকসে বিপুল অর্থের বিনিময়ে বক্তৃতা দেওয়ায় লোকে তাঁকে বিশ্বায়নপন্থী অভিজাতদের প্রতিনিধি মনে করত। যুক্তরাজ্যেও একই ব্যাপার ঘটল। বিশ্বজনীনতা ও অসমতার বিরুদ্ধে শ্রমজীবীদের অসন্তোষ থাকলেও সেখানে আরেকটি ব্যাপার ব্রেক্সিটকে প্রভাবিত করে। এখানে জাতীয়তা ও পরিচিতির ব্যাপারও নির্ধারক হয়ে ওঠে; কারণ, ইংরেজরা নিজেদের দেশে বিপুলসংখ্যক অ-ইংরেজিভাষী অভিবাসীদের অপছন্দ করত।
বিশ্বায়নবিরোধী প্রতিক্রিয়ায় অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চ সব ক্ষেত্রে যুগপৎ হয় না। এরদোয়ান ও মোদি জাতীয় পুনর্জাগরণের কথা বললেও তাঁরা এখনো অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের পক্ষপাতী। কিন্তু অর্থনৈতিক অসমতার কারণে তাঁদের স্বাদেশিকতা ও জাত্যভিমান পালে হাওয়া পেয়েছে, ঠিক যেমন পশ্চিমেও একই বিষয়ের বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে।
এসব কিছু একত্র হয়ে পশ্চিমে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তারা একসময় উন্মুক্ত পৃথিবীর পক্ষপাতী হলেও এখন সেখানে পণ্য, শ্রম ও পুঁজির অবাধ প্রবাহের পথে বড় বড় বাধা সৃষ্টি হয়েছে। সংখ্যা দিয়েই ব্যাপারটা বোঝা যায়। ২০০৭ সালে বৈশ্বিক পুঁজিপ্রবাহের পরিমাণ রেকর্ড ১২ লাখ ৪০ হাজার কোটিতে পৌঁছায়, যেটা ছিল বৈশ্বিক পুঁজির ২১ শতাংশ। ২০১৬ সালে সেটা ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটিতে নেমে আসে, বৈশ্বিক অর্থনীতির ৬ শতাংশ। অর্থাৎ ১৯৮০ সালের চেয়ে কম। বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি (২ দশমিক ৫ শতাংশ) যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছাড়িয়ে গেছে, সেখানে বিশ্বায়ন কয়েক দশক পিছিয়ে গেছে।
বিশ্বায়ন নিখুঁত না হলেও তার বদৌলতে চীন ও ভারতের লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের চক্র থেকে বেরিয়ে এসেছে। দরিদ্র দেশে পণ্যের বাজার সৃষ্টি হয়েছে। আর ধনী দেশের মানুষের জন্য পণ্যের দাম কমেছে। এই অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়ার রাশ টেনে ধরতে হবে। বৈশ্বিক অখণ্ডতার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
শশী থারুর: ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।