সংবাদপত্রের ওপর কালাকানুন

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ওপর বিভিন্ন ধরনের কালাকানুন, বিশেষ করে ৫৭ ধারা জারি করা এবং তার প্রয়োগ নিয়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে তেমন গা করছে না। খুব অবাক হয়ে লক্ষ করা যাবে, কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থে লেখক শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পত্রিকার ওপর কালাকানুন জারি করা নিয়ে খুবই মর্মাহত ছিলেন এবং কঠোরভাবে তার সমালোচনা করেছেন।

শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে লিখেছেন, ‘ইত্তেফাক কাগজ আসে নাই। এর পরিবর্তে আমাকে “দৈনিক পাকিস্তান’’ দিয়েছে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলল, কাগজ বন্ধ, সরকার নাকি বন্ধ করে দিয়েছে।’ ‘পাকিস্তান দেশরক্ষা আইন বলে “নিউ নেশন প্রেস” বাজেয়াপ্ত করিয়াছে সরকার। এই প্রেস হইতে “ইত্তেফাক”, ইংরেজি “সাপ্তাহিক ঢাকা টাইমস” ও বাংলা চলচ্চিত্র সাপ্তাহিক “পূর্বাণী” প্রকাশিত হইত। পুলিশ প্রেসে তালা লাগাইয়া দিয়াছে। ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ হইয়া গিয়াছে। পূর্বের দিন ইত্তেফাক ও নিউ নেশন প্রেসের মালিককে দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করিয়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ১০ সেলে বন্দী করিয়া রাখা হইয়াছে।’

মানিক মিয়ার ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করা নিয়ে কারাগারের রোজনামচায় শেখ মুজিবুর রহমান লিখছেন, ‘এই জংলি আইন দিয়ে যদি এরা দেশ শাসন করতে থাকে, তবে ফলাফল কি হবে তা বলা কষ্টকর। একজনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি কোনো কারণ না দর্শাইয়া বাজেয়াপ্ত করা, একজন শ্রেষ্ঠ সম্পাদক ও কাগজের মালিককে বিনা অপরাধে, বিনা বিচারে কারা প্রাচীরের অন্তরালে নিক্ষেপ করা, কি জঘন্য প্রকৃতির কাজ হতে পারে তাহা চিন্তা করতেও ভয় পায় না বলে মনে হয়।’ ‘মানিক মিয়া রাজনীতি করেন না, তবে তাঁর নিজস্ব মতবাদ আছে। তাঁকে দেশরক্ষা আইনে বন্দী করা যে কত বড় অন্যায় ও নীতিবিরুদ্ধ তা কেমন করে ভাষায় প্রকাশ করব।’

দুর্ভাগ্যক্রমে স্বাধীন বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ওপর নানা ধরনের বিধিবিধান, কালাকানুন জারি রয়েছে আর বিভিন্ন সরকারের দ্বারা দিনে দিনে তা কঠোর হচ্ছে। ভারত বা বাংলা ভূখণ্ডে প্রথম গণমাধ্যমের ওপর কালাকানুন জারি হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসকদের দ্বারা। বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের ৩০ বছর যেতে না যেতেই কণ্ঠরোধ করার ঘটনা ঘটে। ইংরেজ শাসকেরা খোদ উদারনৈতিক ইংরেজদের কণ্ঠরোধ করার জন্য নতুন আইন প্রয়োগ করে। কারণ, উদারনৈতিক ইংরেজরা কোম্পানির শাসনের জুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলত তাদের সম্পাদিত ইংরেজি পত্রিকাগুলোতে। বাংলাদেশে তখন ইংরেজদের সম্পাদিত কম করে হলেও ১৫টি পত্রিকা ছিল। পত্রিকার অনেক সম্পাদকই ছিলেন মনেপ্রাণে হুইগপন্থী। যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিচারব্যবস্থা ও নতুন আইন মানুষের ‘সত্যি কথা বলার’ অধিকার কেড়ে নেয়, তখন ১৭৮২ সালে বেঙ্গল গেজেট-এর সম্পাদক জেমস অগাস্টাস হিকি চিন্তার স্বাধীনতার পক্ষে তাঁর মত ঘোষণা করেন। পত্রিকায় স্বাধীন মতামত প্রকাশের জন্য সেটাকে অপরাধ ধরে নিয়ে হিকির বিরুদ্ধে কোম্পানি সরকার মামলা করে। বিচারে হিকির কারাদণ্ড হয়।

১৭৯৩ সালে আরেকজন ইংরেজ সম্পাদককে একই কারণে স্যার জন শোর ভারত থেকে বিতাড়ন করেন। দেশীয়দের তখন পর্যন্ত কোনো সংবাদপত্র ছিল না। গভর্নর জেনারেল হিসেবে ১৭৯৮ সালে লর্ড ওয়েলেসলির আগমন ঘটে। ওই বছরই এশিয়াটিক মিরর পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়, এ দেশে ইউরোপীয়দের সংখ্যা এত সামান্য যে শুধু ঢিল ছুড়েই ভারতীয়রা তাদের হত্যা করতে পারে। পত্রিকার এই মন্তব্যকে গভর্নর জেনারেল ওয়েলেসলি ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে সশস্ত্র উত্থানের জন্য ভারতীয়দের প্রতি প্ররোচনা বলে গণ্য করলেন। ১৭৯৯ সালে তিনি প্রেস রেগুলেশন অ্যাক্ট ঘোষণা করেন। লর্ড ওয়েলেসলির আনীত প্রেস রেগুলেশন অ্যাক্টের উদ্দেশ্য কী ছিল? স্পষ্টতই এর লক্ষ্য ছিল উদারপন্থী ইংরেজ পত্রিকাগুলোর সম্পাদকদের কণ্ঠরোধ করা।

পরবর্তীকালে আবার ১৮১৮ সালে কণ্ঠরোধ করার জন্য আরেকটি বিধি প্রবর্তিত হয়েছিল। এই বিধিবলে সরকারি নীতির সমালোচনা বা বিরুদ্ধতা করার অপরাধে যেকোনো ব্যক্তিকে, তিনি ইউরোপীয় হোন বা ভারতীয় হোন—কারণ দর্শানোর বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে তাঁকে কারাগারে আটক করা যেত। সেভাবে ১৮২৩ সালে আরেকটি প্রেস অর্ডিন্যান্স অ্যাক্ট করা হয়েছিল। এই অ্যাক্টে বা আইনে নির্দেশ জারি করা হয়েছিল যে বিনা সরকারি অনুমোদনে সরকারি নীতিসংক্রান্ত কোনো সংবাদ বা আলোচনা সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশ করা যাবে না। খুব সুস্পষ্টভাবেই দেখা যায়, আইনটি প্রবর্তনের লক্ষ্য ছিল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা। ব্যক্তিগতভাবে বা সংবাদপত্রে যেসব গণতান্ত্রিক সমালোচনা ইউরোপ বা ইংল্যান্ডে করা ন্যায়সংগত বলে বিবেচনা করা হতো, ভারতবর্ষের ভূগোলে তা ছিল অন্যায় ও আইনবিরোধী। রামমোহনের নেতৃত্বে এই অ্যাক্টের বিরুদ্ধে বা মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে একটি স্মারকপত্র সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হয়েছিল। রামমোহন ছাড়া আর যে পাঁচজন এই স্মারকপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন, তাঁরা
হলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, চন্দ্রকুমার ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, হরচন্দ্র ঘোষ ও গৌরীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। স্মারকপত্রে যা বলা হয়েছিল তার মূল কথা রাষ্ট্রশাসনের ব্যাপারে জনসাধারণের মতামত দেওয়ার এবং সমালোচনা করার স্বাধীনতা আছে। ১৮২৩ সালের অর্ডিন্যান্সে যখন বাক্স্বাধীনতা হরণ করা হয়, প্রতিবাদে রামমোহন তাঁর মীরাত-উল-আখবার-এর প্রকাশনা বন্ধ করে দেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত রক্ষা আইন গৃহীত হলো ১৯৩৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। ভারত রক্ষা আইন গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সংবাদমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ চালু হলো। ইন্ডিয়ান জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এই নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে। জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অভিযোগ করে যে শুধু খবরই নয়, খবরের দৃষ্টিভঙ্গির ওপরও হস্তক্ষেপ করে সরকারের প্রেস কর্মকর্তারা খবরের কাগজগুলো সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছেন। মুম্বাইয়ে এই সময় পাঁচটি সংবাদপত্র নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ইন্ডিয়ান জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন সরকারের প্রেস সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ভারত রক্ষা অর্ডিন্যান্সের বিরোধিতা করে।

গান্ধী ১৯৪০ সালের ১৯ এপ্রিল সত্যাগ্রহ ঘোষণা করলেন। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের নির্দেশ অনুযায়ী কংগ্রেসের যে পুস্তিকায় সত্যাগ্রহের খবর প্রচার করা হয়েছিল, সেটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। কংগ্রেসের রামগড় সম্মেলনের যাবতীয় বুলেটিন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। গান্ধী যখন ১৯৪০ সালের ১৭ অক্টোবর সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন, তখন  সরকারের আঞ্চলিক প্রেস অ্যাডভাইজর ন্যাশনাল হেরাল্ড-এর সম্পাদককে চিঠি দিয়ে জানান, গান্ধীর অনুমোদিত প্রতিনিধি বিনোবা ভাবের সত্যাগ্রহ পালনসংক্রান্ত কোনো খবর দিল্লির মুখ্য প্রেস অ্যাডভাইজরের অনুমোদন ছাড়া ছাপা যাবে না। সরকার বিশেষভাবে ন্যাশনাল হেরাল্ডকে যে নির্দেশ পাঠিয়েছিল, তার প্রতিবাদস্বরূপ ন্যাশনাল হেরাল্ড কতগুলো সিদ্ধান্ত নেয়, যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল—সম্পাদকীয় কলামে প্রতিদিন সরকারি আদেশ ছাপানো হবে এবং সেন্সর বোর্ড কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া কোনো যুদ্ধসম্পর্কিত সরকারি প্রচার ছাপা হবে না। ন্যাশনাল হেরাল্ড এভাবেই সরকারের কণ্ঠরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।

বিনোবা ভাবের বক্তব্য ছাপার জন্য সরকার সৈনিক-এর সম্পাদককে গ্রেপ্তার করে এবং প্রেস বন্ধ করে দেওয়া হয়। মূলত বিনোবা ভাবের বক্তব্য নিয়ে যে খবরটি ছাপা হয়েছিল, তার আপত্তিকর শিরোনামের জন্য সম্পাদকের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ১৯৪১ সালের ১৪ এপ্রিল যুক্ত প্রদেশের রাজ্যপাল দেরাদুনে একটি সাধারণ সভা ডাকেন। যদিও সভার মূল বিষয় ছিল সৈনিক পত্রিকা নিয়ে আলোচনা, সঙ্গে আরও কয়েকটি আলোচ্য বিষয়ও ছিল। সেখানে রাজ্যপাল বলেন, ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড এবং হিন্দুস্তান টাইমস যথেষ্ট খারাপ’ যুদ্ধের খবর ছাড়াও অন্যান্য খবরের মধ্যেও হিন্দুস্তান টাইমস সরকারের প্রচুর সমালোচনা করেছে। যুক্ত প্রদেশের প্রেস পরামর্শদাতা বলেন, রাজ্যের বেশির ভাগ হিন্দি সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল কংগ্রেসকে সমর্থন করা এবং স্বভাবতই ব্রিটিশবিরোধী কার্যকলাপে মদদ জোগানো। বারবার পত্রিকাগুলোকে সতর্ক করে দেওয়া হয়, যেন সরকারের বিরুদ্ধে মতামত না ছাপে।

ভারত সরকার ১৯৪১ সাল থেকে প্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে আরও কঠোরতম ব্যবস্থা চালু করল। ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সময় পত্রিকা প্রকাশের ওপর কড়াকড়ি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলো। ১৯৪২ সালে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো খবরের কাগজের সম্পাদকদের সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে আন্দোলন-সংক্রান্ত সামান্যতম খবর ছাপা থেকে বিরত থাকতে। যুদ্ধ সম্পর্কেও যেন কোনো খবর না ছাপে। যুদ্ধ বা আন্দোলন সম্পর্কে খবর ছাপা হলে সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভারত ছাড় আন্দোলনের
প্রাক্কালে ব্রিটিশ সরকার খবরের কাগজের কণ্ঠ শতভাগ রোধ করেছিল। সংবাদপত্রগুলোকে যেকোনো কারণে যখন-তখন অভিযুক্ত করা হচ্ছিল। ন্যাশনাল হেরাল্ড কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। অনেক সংবাদপত্রকে তাদের সম্পাদকীয় রচনাকে সরকারের সেন্সরের সামনে উপস্থিত করতে বলা হলো। তার প্রতিবাদে অনেক সংবাদপত্র তাদের সম্পাদকীয় কলাম ফাঁকা রেখে দেয়।

এমনকি সেন্সর বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া কোনো বিরূপ মন্তব্য করা যেত না। এসব ঘটনা থেকে পত্রিকার স্বাধীন মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা কতটুকু ছিল, তা ধারণা করা যায়। নেহরু এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন যে সরকারের সেন্সর প্রথার এই দীর্ঘ ছায়া সংবাদপত্রের পাতাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছে। একই সঙ্গে হাতকড়া এবং পায়ে শিকল পরিয়ে দিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলো স্বাধীন ভারতেও কালাকানুন জারি আছে। পাকিস্তান আর বাংলাদেশের সব শাসক সে পথ ভালোভাবেই অনুসরণ করে চলছেন।

রাহমান চৌধুরী: গবেষক ও লেখক।