অক্টোবর বিপ্লব অনির্বাণ আলোকবর্তিকা

ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন

এক শ বছর আগে জার-শাসিত রাশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেটি ৭৩ বছর টিকে ছিল। আজ সেই রাষ্ট্র আর নেই। ৩০ বছর ধরে আমরা ‘সোভিয়েতবিহীন বিশ্বে’ বাস করছি। এই সময়ের অভিজ্ঞতা সোভিয়েত ইউনিয়নের উপস্থিতির মূল্য অনুধাবনে সহায়ক হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় সম্ভব হওয়ার পেছনে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অমূল্য অবদান।

যুগ যুগ ধরে মানুষ শোষণহীন, সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন দেখেছে। সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন কার্ল মার্ক্স-ফ্রেডেরিখ অ্যাঙ্গেলস। তঁাদের মতাদর্শ ধারণ করে কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিনের পরিচালনায় ও বলশেভিক পার্টির (কমিউনিস্ট পার্টি) নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে, পুরোনো জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে ২৫ অক্টোবর আর নতুন গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে ৭ নভেম্বর রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ নামে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র।

সভ্যতার বিবর্তনের ধারায় দেশে দেশে অনেক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এসব বিপ্লব থেকে ‘সোভিয়েত বিপ্লবের’ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যটি ছিল এই যে আগের সব বিপ্লব কেবল শাসকশ্রেণির ও শোষণের রূপ ও পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছিল, কিন্তু শোষণের অবসান ঘটাতে পারেনি। অন্যদিকে ‘সোভিয়েত বিপ্লবের’ মধ্য দিয়ে সূচনা হয়েছিল মানুষের ওপর মানুষের শোষণের চির অবসানের যুগ। বলা যায় যে এটি ছিল এক ‘মহাবিপ্লব’।

‘সোভিয়েত বিপ্লবের’ আগে রাশিয়া ছিল পিছিয়ে থাকা একটি দেশ। রাশিয়াকে বলা হতো ‘ইউরোপের পশ্চাদ্ভূমি’। জারের আমলে অনাহার, দারিদ্র্য ও অসহনীয় শোষণ ছিল জনগণের নিত্যসঙ্গী। উন্নত শিল্প দূরের কথা, সাধারণ মাপের শিল্প উৎপাদনের ব্যবস্থাও সেখানে তেমনভাবে ছিল না। ‘দ্য গ্রেট রাশিয়ানদের’ দ্বারা অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলো শোষিত হতো। জারের শাসনামলে রাশিয়ায় সামান্যতম গণতান্ত্রিক অধিকারও ছিল না।

বিপ্লবের পর লেনিনের নেতৃত্বে গঠিত নতুন সোভিয়েত সরকারের প্রথম পদক্ষেপগুলো ছিল প্রথমত, ‘শান্তির ডিক্রি’র মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য অবিলম্বে শান্তি আলোচনা শুরুর ঘোষণা করা। দ্বিতীয়ত, ‘জমির ডিক্রি’র মাধ্যমে খোদ কৃষককে জমির ওপর অধিকার প্রদানের ব্যবস্থা করা। তৃতীয়ত, সর্বপর্যায়ের সোভিয়েতগুলোর হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা সংহত করা। অন্যান্য ডিক্রি ছিল নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, অবৈতনিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যরক্ষা এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সাধারণ তন্ত্রের নতুন ইউনিয়ন গঠন-সম্পর্কিত।

বিপ্লবের বিজয়ের পর সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের কাজ শুরু করার আগেই সোভিয়েত বিপ্লব প্রতিবিপ্লবী শক্তির আক্রমণের মুখে পড়ে। অন্তত ১৪টি সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশের সামরিক বাহিনী আগ্রাসন শুরু করে। এদের সঙ্গে যুক্ত হয় দেশের অভ্যন্তরে ক্ষমতাচ্যুত শাসকশ্রেণির অনুগত শ্বেত সেনাবাহিনী। চার বছরের গৃহযুদ্ধের পর ‘লাল ফৌজ’ দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সেই প্রত্যক্ষ আক্রমণকে পরাভূত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে।

আরও বড় আঘাত আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ফ্যাসিবাদ বিশ্বকে গ্রাস করতে যুদ্ধ শুরু করে। হিটলারের নাৎসি বাহিনী দেশের পর দেশ দখল করে নিতে থাকে। কিন্তু ‘লাল ফৌজের’ অসীম সাহসী লড়াই ও বীরত্বের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল হিটলারের বাহিনী সোভিয়েত সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তিন কোটি মানুষের প্রাণের বিনিময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন রক্ষা করে বিশ্বকে, মানবসভ্যতাকে। মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের কারণেই বিংশ শতাব্দীর মহাবিপদ ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করা সম্ভব হয়।

এসব বাধা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মাত্র দুই দশকের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। শোষিত-বঞ্চিত সব শ্রেণি শোষণ থেকে মুক্তি পায়। প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করা হয় কাজ, খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সাধারণ মৌলিক চাহিদাগুলো। এক দশকের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করা হয়। কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য আসে। নতুন নতুন শিল্প গড়ে উঠতে শুরু করে। দ্রুত শিল্পায়নের লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক সরকার ১৯২৭ সালে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। দু-তিনটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়। ১৯২৯-৩৩ সালের মহামন্দায় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন উন্নত পুঁজিবাদী দেশ আক্রান্ত হলেও সোভিয়েত ইউনিয়নকে স্পর্শ করতে পারেনি।

সমাজতন্ত্র প্রতিটি নাগরিকের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যা অর্জনের ব্যবস্থা করে দেয়, মানুষকে দীর্ঘ আয়ু দান করে, নারীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার, শ্রমিকসহ মেহনতি মানুষকে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদান এবং বঞ্চিত ও নিপীড়িত জাতিসমূহকে মুক্ত করে। সব ধরনের পুরোনো সংস্কৃতি, যেমন গোষ্ঠীবাদ, জাতীয়তাবাদ, সংকীর্ণতাবাদ ইত্যাদি অপসারণ করা হয়। প্রতিক্রিয়াশীলতা, ভোগবাদ, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটানো হয়। প্রলেতারিয়েতের মধ্যে নতুন চেতনা, মূল্যবোধ ও আত্মমর্যাদার উন্মেষ ঘটে। নিপীড়িত মানুষের শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রেও ঘটে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মহাবিশ্বকে স্পর্শ করে স্পুতনিক। ১৯৫৯ সালে মহাশূন্যে প্রথম পাড়ি দেন সোভিয়েত নভোচারী ইউরি গ্যাগারিন। সব মিলিয়ে সোভিয়েত ব্যবস্থা উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম হয়। একটি পিছিয়ে পড়া দেশ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে ওঠে একটি ‘পরাশক্তি’।

সোভিয়েত বিপ্লবের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের আন্দোলন জোরদার ও বিস্তৃত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপসহ বিশ্বের প্রায় এক ডজন দেশ সমাজতন্ত্রের পথ গ্রহণ করে। চীনে বিপ্লব সফল হয়। গড়ে ওঠে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা। একই সঙ্গে ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামও তীব্রতা লাভ করে। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই বেগবান হয়। এশিয়া, আফ্রিকার শতাধিক দেশ অর্জন করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা। সদ্য স্বাধীন এসব দেশের জাতীয় অর্থনীতি পুনর্গঠনেও সোভিয়েত ইউনিয়ন আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে। ঔপনিবেশিক ও নয়া ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর পক্ষে দঁাড়ায় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা এর অন্যতম দৃষ্টান্ত। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে চট্টগ্রাম বন্দর মাইনমুক্ত করার অপারেশনে সোভিয়েত নৌসেনাকে জীবনও দিতে হয়েছে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ নেই। একদিকে সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে নানা ভুল-ত্রুটির কারণে এটি ঘটেছে। সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে হলে সেই সব ভুল-ত্রুটি সম্পর্কে খোলামেলা আত্মপর্যালোচনা প্রয়োজন। সেগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা প্রয়োজন। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হওয়ার অর্থ যে সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম ও প্রাসঙ্গিকতা বিলুপ্ত হওয়া বোঝায় না, তার নিদর্শন আজ আমরা দেশে দেশে দেখতে পাচ্ছি।

সমাজতন্ত্রের শক্তি কিছুটা দুর্বল হলেও নিঃশেষ হয়নি। বরং দেশে দেশে তা আবার জেগে উঠতে শুরু করেছে। পক্ষান্তরে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ এখন ক্ষয়িষ্ণু। বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গভীর সংকটে। একমাত্র সমাজতন্ত্রেই যে এই অবক্ষয় ও সংকটাবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে, সেই উপলব্ধি সর্বত্র প্রসারিত হচ্ছে। সোভিয়েত বিপ্লব সে ক্ষেত্রে ইতিহাসের আলোকবর্তিকা হয়ে পথ দেখাবে চিরকাল।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)।