ক্যাম্পে এক লাখের বেশি শরণার্থী নয়

রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবিক সহায়তা সংস্থা অক্সফামের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী এনামূল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গওহার নঈম ওয়ারা জামিল খান

প্রথম আলো : রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনের বর্তমান পরিস্থিতি আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

এনামূল হক : ১৯৯২-৯৩ সালে আমি টেকনাফে শরণার্থী শিবিরে প্রথম কাজ করতে এসে যে শরণার্থী সংকট দেখেছিলাম, তার তুলনায় এখনকার সংকট কল্পনাতীত। ওই সময়ে টেকনাফ ও দমদমিয়ার ৫০-৬০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন-সুবিধা দেওয়ার কাজ করেছিলাম। আমরা কাজ শুরু করার আগে মাত্র ১ সপ্তাহে সাড়ে ১২ হাজার রোহিঙ্গা কলেরায় মারা যায়। আর এখন আমরা ৮ লাখ নতুন শরণার্থীকে মানবিক সহায়তা দিচ্ছি। নিঃসন্দেহে এটা বড় চ্যালেঞ্জ। টেকনাফের যে এলাকায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে, সেখানে ভূপৃষ্ঠের পানির তেমন কোনো উৎস নেই। আর উখিয়ার কুতুপালং শিবিরে সব এনজিও মিলে অগভীর ও গভীর নলকূপ বসিয়ে পানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

প্রথম আলো : বিগত বছরের তুলনায় এবারের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জের। শিবিরগুলোতে পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা এখন কেমন?

এনামূল হক : টেকনাফে যেখানে রোহিঙ্গা শিবির রয়েছে, তার এক পাশে নাফ নদী এবং সেখানে লবণ উৎপাদন করা হয়, অন্য পাশে বঙ্গোপসাগর। আমরা যারা ওই অঞ্চলে কাজ করছি, এই মুহূর্তে আমাদের অনেকের সেখানকার ভৌগোলিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা নেই। অনেক এনজিও আছে, যাদের কাছে এই অঞ্চল একদম নতুন। তাই কী ধরনের ঝুঁকি থাকতে পারে এখনই বলা যাচ্ছে না। আমরা শুনেছি, কোনো কোনো এনজিও ১০ হাজার শৌচাগার বানিয়েছে। শিবিরগুলোতে ময়লা-আবর্জনার বর্জ্যের চাপ রয়েছে। যদি জনপ্রতি ৪ লিটার করে ধরা হয়, তাহলে গড়ে সেখানে প্রতিদিন ৩ হাজার টন পয়োবর্জ্য (ফিক্যাল স্লাজ) তৈরি হবে আর শুধু বর্জ্য আসবে প্রায় ২ হাজার টন।

প্রথম আলো : আপনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শরণার্থী শিবিরে কাজ করেছেন। ওই সব শিবিরেও কি একটা জায়গায় এত মানুষকে একসঙ্গে রাখা হয়েছে? পাহাড়ি এলাকায় কাজ করতে গিয়ে আপনারা কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন?

এনামূল হক : শরণার্থী শিবিরে ১০ হাজারের ঊর্ধ্বে মানুষ রাখা হলে আমরা তাকে বলি আউটব্রেক পপুলেশন। আমার অভিজ্ঞতা বলছে, বিশ্বে বড় বড় উদ্বাস্তু শিবিরে সর্বোচ্চ এক লাখ শরণার্থী রয়েছে। জর্ডানের জাতারি কিংবা বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির হিসেবে পরিচিত কেনিয়ার দাদাবের তিনটি শিবির নিয়ে হয়তো ১ লাখ মানুষ হতে পারে। ওই শিবিরগুলো সবই সমতল ভূমির। কিন্তু টেকনাফ ও উখিয়ায় আমরা পাহাড়ি এলাকায় কাজ করছি এবং সেখানকার ৬০ ভাগ ভূমি সত্যিকার অর্থে ব্যবহারের উপযোগী নয়। কাজ করতে গিয়ে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। যেটুকু জমি আছে, তা-ও ড্রেনেজ তৈরির কারণে মাটি ক্ষয় হবে, তখন পয়োনিষ্কাশন পদ্ধতির পরিবর্তন হতে পারে। তাই যতটা সম্ভব শিবিরগুলোতে শরণার্থীর সংখ্যা কমিয়ে আনা উচিত। এক লাখের ওপরে কোনোমতেই হওয়া উচিত নয়।

প্রথম আলো : বিশাল এই জনগোষ্ঠীর জন্য কি নিরাপদ পানি সরবরাহ করা যাবে?

এনামূল হক : ১০ লাখ শরণার্থীর পানির চাহিদা মেটাতে কম করে হলেও ৫-৬ হাজার টিউবওয়েলের প্রয়োজন। একটা নির্দিষ্ট এলাকায় এতসংখ্যক টিউবওয়েল বসানোর বিষয়টাও একটা নাজুক পরিস্থিতি বলে মনে হচ্ছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর), ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফাম ও অন্যান্য এনজিও মিলে শিগগিরই টেকনাফ থেকে উখিয়া পর্যন্ত হাইড্রো জিওলজিক্যাল সমীক্ষা করা হবে এবং পুরো প্রতিবেদন তৈরি হতে অনেক সময় লাগবে। তবে আমরা ভূপৃষ্ঠের পানি নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তায় রয়েছি, কারণ দুপাশেই লবণাক্ত পানি। শরণার্থীদের জন্য আমাদের আগাম প্রস্তুতি ছিল না। অন্যদিকে পাহাড়ি ছড়ার পানি ইটের ভাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে। টেকনাফ থেকে শুরু করে যেসব পাহাড়ি ছড়ার পানি আসছে, সেগুলো যদি সংরক্ষণের জন্য বাঁধ দেওয়া যেত, তাহলে এ রকম একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতো না। আর মৌসুমি বৃষ্টিপাতকে যদি পরিকল্পনা করে সংরক্ষণ করা যায়, তাহলেও মোটামুটি সবাইকে পানি দেওয়া যাবে।

প্রথম আলো : শরণার্থী শিবিরে যদি ৫-৬ হাজার টিউবওয়েল বসানো হয়, তাহলে আশপাশের স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য কি কোনো ঝুঁকি থাকছে?

এনামূল হক : হ্যাঁ, তা তো থাকছেই। একটা নির্দিষ্ট এলাকায় এত পরিমাণে টিউবওয়েল বসালে আশপাশের স্থায়ী বাসিন্দারা খাওয়ার পানির সংকটে পড়তে পারে। এরই মধ্যে শরণার্থী শিবিরে ১০-২০ ভাগ টিউবওয়েল কাজ করছে না আর আর্সেনিকের ঝুঁকি তো রয়েই গেছে। তা ছাড়া বৃষ্টি কমে গেছে এবং এই মৌসুমে যদি আর বৃষ্টি না হয়, তাহলে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে গিয়ে হয়তো আমরা অনেক টিউবওয়েলের পানি পাব না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে স্থায়ী বাসিন্দাদের ওপর। এই পরিস্থিতিতে ভূ-উপরিভাগের বৃষ্টির পানি যা রয়েছে, সেটাই সংরক্ষণ করার দিকে নজর দিলে সম্ভাব্য ক্ষতি কিছুটা হলেও কাটিয়ে ওঠা যাবে।

প্রথম আলো : আপনি তো ’৯২ সালে এই অঞ্চলে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে পানি সরবরাহ নিয়ে কাজ করেছিলেন। ওই সময় ভূপৃষ্ঠে বিশুদ্ধ পানির পরিমাণ কেমন ছিল আর এখন কেমন?

এনামূল হক : তখন উখিয়া ও টেকনাফের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ওয়াটার ট্র্যাকিংয়ের জন্য পানির নমুনা নিয়েছিলাম, তখন অগভীর কুয়া দেখেছি, সেখানে নিরাপদ পানি ও সহনীয় মাত্রার লবণাক্ততা ছিল। কিন্তু ২৪ বছর পর এসে আমরা সেটা পাচ্ছি না। অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি উখিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকা যেমন উইচিঙ্গপাড়া, হোয়াইক্যং ও পালংখালীর কাছাকাছি চলে এসেছে। তাই একটি পূর্ণ হাইড্রো জিওলজিক্যাল সমীক্ষা ছাড়া এই মুহূর্তে এটুকুই বলতে পারি, আমরা আতঙ্কে আছি।

প্রথম আলো : ’৯২-৯৩ সালে শরণার্থী শিবিরে ১২ হাজার রোহিঙ্গা কলেরায় মারা গিয়েছিল। এবারও কি এমন ঝুঁকি আছে?

এনামূল হক : ওই সময় আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যে লোকবল ছিল, সে তুলনায় এখন তা অনেক বেশি। এখন উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত স্বাস্থ্য খাতে লোকবল বেড়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ স্থানীয় ৪০ হাজার পরিবারের সেবা দেওয়ার জন্য কাজ করছে। কিন্তু শরণার্থীর সংখ্যা তো অনেক বেশি। আর ওই সময় কলেরার টিকা ছিল না। এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান মিলে রোহিঙ্গাসহ কক্সবাজারের স্থানীয় ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে কলেরার টিকা সরবরাহ করছে। কিন্তু তারপরও ঝুঁকিটা থেকে যাচ্ছে। যদি কোনো রোগ একবার মহামারি আকারে ছড়ায়, তাহলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।

এনামূল হক : আপনাদেরও ধন্যবাদ।