শিক্ষকেরা যখন 'ফাউস্ট' হতে চান

এক বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবার চোখ, কান ও মগজকে ব্যস্ত রেখেছে। শিক্ষক দলাদলি, হাতাহাতি কিংবা একে অপরের প্রতি মারমুখী মনোভাব আগে দলীয় পরিসরে ফিসফিসানি কিংবা আড়ালের আলাপচারিতায় স্থান পেলেও এবারের যাত্রায় সেটির আড়মোড়া ভেঙেছে। শিক্ষক সম্পর্কে জনমনে মিথের মতো গেড়ে থাকা রোমান্টিক ধারণাকে কিছুটা হলেও তিরবিদ্ধ করতে পেরেছেন শিক্ষকেরাই। আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, এই লেখায় সেই সব শিক্ষক অধিভুক্ত নন, যাঁরা এখনো ‘কিছু না পাওয়ার’ বেদনায় আহাজারি সংস্কৃতির বাইরে অবস্থান করছেন। আমি বিশ্বাস করি, এ রকম শিক্ষক অনেকে আছেন। এক বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যেসব বিষয় মিডিয়ায় এসেছে, সেটিই বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র কিংবা সর্বজনীন চিত্র নয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ ছবি।

ক্ষমতার একচ্ছত্রকরণ, রিট, মামলা, স্নায়ুগত উত্তেজনা, পাল্টাপাল্টি বিবৃতি—সবই গত এক বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত ব্যস্ততার চিত্র। এর কারিগরেরাও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত নীল দলের শিক্ষক নেতা। ক্ষমতাসীন নীল দলের ভেতরকার ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারা ও শক্তি প্রদর্শন শিক্ষকতার পেশাকে নিঃসন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তারই সর্বশেষ প্রদর্শনী হলো কয়েক দিন আগে। মারামারি হয়েছে শিক্ষকদের মধ্যে, সবাই ইতিমধ্যে তা জেনেছে, আরও জেনেছে এই মারামারি পর্বের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেঙে ‘খানখান’ হয়ে যাওয়া ‘মর্যাদা’ রক্ষায় দুই পক্ষের মানববন্ধনের খবরও।

এখানে খানিকটা আশাবিহীন আলো আছে। আর সেটি হলো শিক্ষকদের এই ক্ষমতাকেন্দ্রিক নড়াচড়া দিনকে দিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সোশ্যাল  মিডিয়ার সম্পর্ক ঘন করছে। সাংবাদিকেরাও আর এখন কোন শিক্ষক কোন গবেষণা করছেন, কারও কোনো ভালো গবেষণাকাজ প্রকাশিত হলো কি না, সেটির খোঁজ রাখছেন না। এইতো মাত্র ১০ বছর আগে তত্ত্বাবধায়ক শাসনের সময় এই নীল দলের আহ্বায়ক কমিটি ছিল ৩৯ জনের। নীল দলের সভায় আসতেন ১৭-২০ জন। এখন দল ক্ষমতায়, স্বাভাবিকভাবেই দলের সভায় কক্ষ ঠেলে মাথা স্থান পায় দরজার বাইরে, ১৭ থেকে মাথা গণনা দাঁড়ায় ৭০০তে। এই ১৭ থেকে ৭০০ হওয়ার পদ্ধতিটিও খুব আগ্রহব্যঞ্জক।

কীভাবে এই ১০ বছরে ১৭ থেকে ৭০০ হয়? কী প্রক্রিয়া শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির প্রতি আগ্রহী করে তোলে? ১৭ থেকে ৭০০ হওয়ার হিসাবটি অঙ্ক কষে করার দরকার হয় না। এর কারণ ও ফলাফল খালি চোখেই বোঝা যায়, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র বিভাগীয় চেয়ারপারসনের পদ ছাড়া বেশির ভাগ পদই হয় দলীয় আনুগত্যের নিরিখে। সেখানে জহুরিরা বসে থাকেন বেশি ব্যক্তি আনুগত্যের মুক্তাধারী দলীয় শিক্ষককে কাছে টানতে। তবে এটিও সত্যি যে কাকে দিয়ে কী গবেষণা করানো যাবে, কাকে কোন একাডেমিক দায়িত্ব দিলে একটি বড় ধরনের সাফল্য আসবে, কার কোন প্রবন্ধটি পড়ে আলোচনা করবেন, সেটি দেখার মতো ‘বোকা’ শিক্ষকও আছেন।

এই চর্চিত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে সংগঠনটি আন্দোলনে নামতে পারত, সবচেয়ে বড় ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত, সেটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। কিন্তু এটি এখন নিষ্ক্রিয়। মাঝেমধ্যে জাতীয় দিবস পালনের লিফলেটের কাঁধে চড়ে লাউঞ্জে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবে এর অস্তিত্বের নামসর্বস্ব আওয়াজ পাওয়া যায়। লিফলেট দেখে মনে পড়ে, তাই তো, গত বছরের ডিসেম্বরে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন হয়েছিল! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছরে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভা হয়েছে মাত্র একটি। প্রথম সাধারণ সভা ডাকা হয় গত ২৬ অক্টোবর, যখন আরেকটি শিক্ষক সমিতির নির্বাচন দোরগোড়ায়। শিক্ষক সমিতি এখন অনেকটাই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের বর্ধিত সংস্করণ। জাতীয় দিবস পালন ছাড়া শিক্ষক সমিতির কোনো কাজ নেই। অথচ এই শিক্ষক সমিতিই হওয়ার কথা ছিল শিক্ষকদের অধিকার, দাবি আদায়ের একমাত্র পাটাতন। সাধারণ শিক্ষকদের দাবি-দাওয়ার পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দেনদরবার করবে, আন্দোলন করবে। কিন্তু এখন শিক্ষক সমিতির নেতাদের ‘এপাশ-ওপাশ’ করাও নির্ভর করে প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিদের পছন্দ-অপছন্দের ওপর।

এরও কারণ আছে। একেকজন শিক্ষক আছেন একাধিক পদে। তাঁরা সেই পদের মায়াবাহী, সেটি হারানোর ভয়ে সদা তটস্থ। তাই শিক্ষক সমিতির নেতারা বছরে একবার ভোটের বাইরে আর সাধারণ শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠকের প্রয়োজন বোধ করেন না। একই শিক্ষকেরা বিভিন্ন পদে থাকছেন, তাঁদের রাখা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ বডি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের কোনো সদস্য যদি শিক্ষক সমিতির নেতা থাকেন, তাহলে দেনদরবার কে কার সঙ্গে করবেন? একই শিক্ষক যদি একাধিক পদে থাকেন, তাহলে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা পাবে? স্বাভাবিকভাবেই কোনো না কোনো বডি অকার্যকর হয়ে উঠবে, যার সর্বশেষ দৃশ্য হবে ‘মারামারি’। এটি কাঙ্ক্ষিত নয়, তবে এর অনিবার্যতা ঠেকানো কঠিন। অনেকেই এখানে ‘জনপ্রিয়তা’র বাহাস তুলতে পারেন, কিন্তু যেখানে ৭০০ মাথা সহজেই গোনা যায়, সেখানে ‘জনপ্রিয়তা’র হাওয়াই মিঠাই কোনো অর্থ বহন করে না।

শিক্ষক সমিতি এখন শুধু লিফলেট-সর্বস্ব। শিক্ষক সমিতি একই ক্ষমতালোভী শিক্ষকদের আরেকটি পাটাতন। আমাদের কি ভূমিকা নেই? নিশ্চয়ই আছে। আমরা দিনের পর দিন এসবকে আশকারা দিয়েছি, এর প্রতিবাদে তেমন কোনো জুতসই আন্দোলন গড়ে তুলিনি...দায়ভার আমাদেরও। আমরা স্পষ্টভাবে জানান দিইনি, দাবি তুলিনি, আমরা মেরুদণ্ড বিকিয়ে দেওয়া শিক্ষক সমিতি চাই না। আমরা বিনীতভাবে জানাতে চাই, যেসব শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যান্য প্রশাসনিক দায়িত্বে আছেন, তাঁরা শিক্ষক সমিতির নির্বাচন করতে পারবেন না। আমরা দাবি তুলছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে দলভিত্তিক রাজনৈতিক ঝোঁক কমিয়ে আনুন। দলগত নয়, অনেক একাডেমিক ও প্রশাসনিক পদে রাজনৈতিক নিয়োগ থেকে বের হয়ে আসুন। আমরা শিক্ষক রাজনৈতিক নেতা নই, বরং রাজনৈতিক শিক্ষক দেখতে চাই; যঁারা এই শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সংস্কৃতি নিয়ে প্রতিনিয়তই প্রশ্ন তুলবেন, আলোচনা করবেন।

শেষ করব, ফাউস্ট–এর চরিত্র নিয়ে। ফাউস্ট গ্যটের এমন এক চরিত্র, যে শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করে দিয়েছিল।

ড. জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।