পরমানন্দ মন্ত্রণালয়

অরুন্ধতী রায়
অরুন্ধতী রায়

অরুন্ধতী রায়ের প্রথম উপন্যাস দ্য গড অব স্মল থিংস আমার পড়া সেরা উপন্যাসগুলোর একটা। ওই উপন্যাসের বর্ণনা, চক্রাকার গঠনশৈলী, ভাষার কারুকাজ এখনো আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার, তবুও। বৃষ্টির পানি ছাদের কিনারে ফোঁটা ফোঁটা জমে আছে, অ্যাবাকাসের মতো, এই উপমায় কে না মুগ্ধ হবে। কিংবা আর্কিটেক্ট অরুন্ধতী যখন আই লেভেলটা কোথায় আছে, সেটা মাথায় রেখে দৃশ্যের বর্ণনা দেন, যেমন একজন মারা গেছে, সে শুয়ে আছে চিত হয়ে, সে দেখছে ঘরের ছাদ, মেঝের স্তর থেকে, তখনো তাঁর বর্ণনা আমাদের মুগ্ধ করে। প্রথম উপন্যাসে তিনি বুকার পুরস্কার জিতেছেন, তাঁর বই ৬০ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে, এ পুরোনো কথা। তাঁর ওই বই পড়ার সময় আমি কেঁদেছিলাম, আমার কাছে সেই স্মৃতি পুরোনো হওয়ার নয়।

কুড়ি বছর পরে পড়লাম তাঁর দুই নম্বর উপন্যাস, দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস। এর চেয়ে ভালো উপন্যাস হয়তো পড়েছি, হয়তো পড়িনি, কিন্তু এর চেয়ে ডিস্টার্বিং বই আমি আর একটাও পড়িনি। এই বই পড়তে পড়তে আমি হেসে উঠেছি, কেঁদেছি, দেখো দেখো কী লিখেছে বলে ছুটে গেছি পাশে যিনি আছেন তাঁর কাছে, এই বই পড়তে পড়তে এবং এই বই পড়ে আমি ভয়ে শিউরে উঠেছি, ব্যথায় দীর্ণ হয়েছি, অক্ষমতার যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়েছি।

অরুন্ধতী রায় এই উপন্যাসে সমকালীন ভারতের এবং দুনিয়ার বহু ইস্যু, জ্বলন্ত ইস্যু, যার সঙ্গে অনেক মানুষের রোজকার জীবন–মৃত্যু যুক্ত, তা ধরতে চেয়েছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গে সিঙ্গুর, গুজরাটে মোদির সাম্প্রদায়িক হানাহানি, মাওবাদী আন্দোলনকারীদের ওপর চালানো নিষ্ঠুরতা, আদিবাসী নিগ্রহ, ইরাক যুদ্ধ, কেজরিওয়াল, মনমোহন সিং, দলিত, চামার, হিজড়া, গরু এবং কাশ্মীর—কোনো ইস্যুকেই ছাড়তে চাননি। আমরা কবিতায় পড়েছি, চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়। এই বই পড়লে নিজেকে অপরাধী বলে গণ্য হয়, একজন লেখক হিসেবে আমার কী করার কথা ছিল, আমি কী করছি; একজন সাংবাদিক হিসেবে আমার কী লেখার কথা ছিল, আমি কী লিখছি; একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার কী বলার কথা ছিল, আমি কী বলছি; একজন বিশ্বনাগরিক হিসেবে আমি কতটা অসহায়—এই সব মনে হতে থাকে। এই বই এমনকি পড়তেও ভয় লাগে, মনে হয়, এই বই পড়ছি বলেও কেউ ঘরের মধ্যে এসে ঢুকে পড়ে বলবে না তো, ওঠো, চলো।

যখন আশির দশকে লেখালেখি শুরু করি, তখন আমরা সুবিমল মিশ্রর অ্যান্টি-উপন্যাসের ভক্ত ছিলাম। এই বই অ্যান্টি-উপন্যাসেরও অ্যান্টি। আমার লেখক–জীবনের শুরুতে আমি সংবাদপত্রের কাটিং, গান, শ্লোক, অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা, ব্রেশটিয় এলিয়েনশন—নানা কেরদানি উপন্যাসে ঢোকানোর চেষ্টা করতাম। নিধুয়া পাথার নামের আমার উপন্যাসটা সেই রকমের একটা কাজ। কিন্তু অরুন্ধতী এই উপন্যাসে যা করেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না—একেবারে লা-জবাব।

আমি তাঁর লেখা থেকে কিছু অংশ অনুবাদ করে দেব। ঘটনাস্থল কাশ্মীর।

সাহসী

বড়গাঁয়ের একজন দরজির নাম মেহমুদ। তার খুব ইচ্ছা সে বন্দুক কাঁধে নিয়ে ছবি তুলবে। অবশেষে একদিন তার এক বন্ধু, যে জঙ্গি দলে যোগ দিয়েছিল, মেহমুদকে গোপন আস্তানায় নিয়ে যায়, তার স্বপ্ন পূরণ করে দেয়। মেহমুদ শ্রীনগরে ফিরে আসে নেগেটিভ ফিল্ম নিয়ে। তাজ ফটো স্টুডিওতে যায় প্রিন্ট নেওয়ার জন্য। প্রতিটি ছবির জন্য সে ২৫ পয়সা কমিশনের দর-কষাকষিও করে। যেদিন সে ফটো আনতে যায়, সেদিন সীমান্তরক্ষী বাহিনী স্টুডিও ঘিরে ফেলে। হাতেনাতে ধরে ফেলে তাকে। তাকে তারা ক্যাম্পে নিয়ে যায়, অনেক দিন ধরে অত্যাচার করে, কিন্তু মেহমুদ কোনো কিছু বলে না। তার ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়।

কয়েক মাস পরে জঙ্গি কমান্ডার, যে ফটো তুলতে সাহায্য করেছিল, ধরা পড়ে। দুটি একে-৪৭ এবং কয়েকটি গুলি উদ্ধার করা হয়। দুই মাস পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

প্রশ্ন ১: এটা কি ঠিক হলো?

নোবেল বিজয়ী

মনোহর মাত্তু একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত। তিনি পাহাড়ের শানুদেশে থাকতেন একা, অন্য হিন্দুরা চলে গিয়েছিল। তাঁর মুসলিম পড়শিরা বলত, সব হিন্দুই আসলে ভারতীয় দখলদার বাহিনীর দালাল। এ কথা তাঁকে খুবই ক্লান্ত আর আহত করত। মনোহর মাত্তু সব ভারতবিরোধী মিছিলে অংশগ্রহণ করতেন। সবার চেয়ে জোরে চিৎকার করতেন ‘আজাদি’ বলে। কিন্তু লাভ হতো না। এমনকি তিনি একবার এ-ও ভেবেছিলেন, অস্ত্র হাতে নেবেন, হিজব দলে যোগ দেবেন। পরে এই চিন্তা তিনি ত্যাগ করেন। একদিন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা, তাঁর স্কুলবন্ধু আজিজ মোহাম্মদ তাঁর বাড়িতে আসেন, তাঁকে সাবধান করে দেন যে মাত্তুর নামে ফাইল খোলা হয়েছে। কারণ মাত্তুর মধ্যে রাষ্ট্রবিরোধী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

গৌরবে মাত্তুর বুক ফুলে যায়। তুমি আমাকে নোবেল পুরস্কার দিয়েছ, মাত্তু তাঁর বন্ধুকে বলেন। বন্ধুকে তিনি কাফে আরাবিকাতে নিয়ে যান, ৫০০ টাকার কফি আর পেস্ট্রি কিনে খাওয়ান।

এক বছর পরে মাত্তুকে কাফির হওয়ার অপরাধে অজানা বন্দুকধারীরা গুলি করে মেরে ফেলে।

প্রশ্ন ১: কেন মাত্তুকে গুলি করা হলো?

ক) কারণ সে ছিল হিন্দু

খ) কারণ সে আজাদি চেয়েছিল

গ) কারণ সে নোবেল পুরস্কার জিতেছিল

ঘ) একটাও না

ঙ) সবগুলো।

প্রশ্ন ২: এই অজানা বন্দুকধারী কারা হতে পারে?

ক) একজন ইসলামি জঙ্গি, যে ভাবে, সব কাফিরকেই মারা উচিত

খ) দখলদারের দালাল, যে মানুষকে বোঝাতে চায় ইসলামি জঙ্গিরা ভাবে যে সব কাফিরকে মারা উচিত

গ) একটাও না

ঘ) কেউ একজন, যে চায় সবাই এই অঙ্ক কষতে গিয়ে পাগল হয়ে যাক।

খাদিজা বলে

যখন কাশ্মীরে কেউ বলে ‘গুড মর্নিং’ (সুপ্রভাত), সে আসলে বোঝাতে চায় ‘গুড মৌরনিং’ (শুভ শোক)।

অরুন্ধতী তাঁর ৪১৮ পৃষ্ঠার উপন্যাস শেষ করেছেন এইভাবে:

সব বাতি নিভে গেছে। সবাই ঘুমে কাতর। সবাই ঘুম। শুধু একজন জেগে আছে। তার ডিউটি করছে। গোবরের মধ্যে একটা পোকা। সে চিত হয়ে শুয়ে পা আকাশে তুলে ধরে আছে। আকাশটা যদি ভেঙে পড়ে, সে তাহলে পা দিয়ে দুনিয়াটাকে বাঁচাবে। কারণ সে জানে, শেষ পর্যন্ত সবকিছু ঠিক হয়ে আসবে। ঠিক হবেই, কারণ তাদের ঠিক হতেই হবে।

বিকজ, মিস জেবিন, মিস উদয়া জেবিন, ওয়াজ কাম।

‘ওয়াজ কাম’ কেন, জানি না। শুধু জানি, অরুন্ধতীই কেবল পারেন সবকিছু ভেঙেচুরে আবার গড়তে।

পড়তে পড়তে মনে হয়, গোবরের ওই পোকাটাও তবু চেষ্টা করছে।

আর আমরা? কী করলাম?

এত গ্লানিময় এই জীবন!

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছেন দিল্লি থেকে। প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধি। দারুণ লেখক, দুঁদে সাংবাদিক। তাঁকে বলি, সৌম্যদা, কী করব? কী করা উচিত?

সৌম্যদা বলেন, হাঁস হয়ে যান। কাদা-জলে সাঁতার কেটে উঠবেন, গায়ে কাদা লাগতে দেবেন না।

তা–ই তো আছি, আছি পরমানন্দ মন্ত্রণালয়ের দপ্তরি হয়ে। হা! জীবন!

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।