মার্কিন নীতি বলে কিছু নেই

রবার্ট ফিস্ক
রবার্ট ফিস্ক

এমন একটা সময় ছিল, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্টও নন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বিবৃতিতে মধ্যপ্রাচ্যের ফোন বেজে উঠত। রিগ্যান, বুশ, ক্লিনটন প্রমুখ মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই অঞ্চলে প্রভাব ছিল, যদিও তা কখনো কখনো অসৎ উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত ছিল। ইসরায়েল (এমনকি ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ধ্বংস করার ক্ষমতাও তার ছিল) সম্পর্কে তাঁরা যথাযথভাবে অবহিত ছিলেন না, দেশটির সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভ্রম ছিল। কিন্তু আজ এই পুরোনো অটোমান সাম্রাজ্যে কারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে?

পাঠক, একবার পুতিন, আসাদ, এরদোয়ান, সিসি, মাখোঁ ও রুহানির দিকে তাকান। এই মানুষেরাই কিন্তু সম্প্রতি সংবাদের শিরোনাম হচ্ছেন। তাঁরা কেউ ঘোষণা দিচ্ছেন আইএস পরাজিত হয়েছে বা দলটির মৃত্যু হয়েছে। আবার কেউ বলছেন সিরিয়াকে ‘রক্ষা’ করা গেছে, কেউ বলছেন কুর্দিরা ‘সন্ত্রাসবাদী’; অন্যদিকে কেউ বলছেন, সাদ হারিরিকে সৌদি আরবের বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। যদিও আমাদের এখন বিশ্বাস করতে হবে, তাঁকে সৌদি আরবে আটক করা হয়নি এবং তিনি পদত্যাগ করতে চাননি বা পদত্যাগ করেছেন।

অন্যদিকে অদ্ভুতভাবে সৌদি আরবের ভাবী বাদশাহ যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রভাবও যেন দিনকে দিন কমছে। তিনি যে ইয়েমেন, আসাদের সিরিয়া, কাতার, আল-জাজিরা, এমনকি বেচারা দেশ লেবাননকে ধ্বংস করার চেষ্টা করলেন, সেটা অনেকটা শিশুর হাত-পা ছোড়াছুড়ির মতো ব্যাপার মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে প্রতিবেশীদের ভয় দেখাতে খেলনা ছুড়ে মারছেন তিনি। এর মধ্যে ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানও আছে, যার সঙ্গে তিনি যুদ্ধ করবেন না। ফলে যে মধ্যপ্রাচ্যে আমি এখন আছি, সেটা আজ থেকে ৪০ বছর আগে আমি যখন সাংবাদিকতা করার জন্য এসেছিলাম, তার মতো নয়।

তখন ‘মার্কিন নীতি’ বাস্তবোচিত ব্যাপার ছিল, যদিও কখনো তা অলীক মনে হতো। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন শুরু হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু একটা ভারসাম্য ছিল। যুক্তরাষ্ট্র তখন সব সময় আরবের একনায়কদের আশ্বস্ত করত যে তারা তাঁদের সমর্থন দেবে। এর মধ্যে ছিলেন সাদ্দাম হোসেন, হাফেজ আল-আসাদ, আনোয়ার সাদাত, জর্ডানের বাদশাহ হুসেন, কর্নেল গাদ্দাফি ও ইরানের শাহ্। এটা কিন্তু সেই সময়, যখন পিএলও ও আরাফাত ‘সন্ত্রাসী’ ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এই পিএলওর ব্যাপারে বিভ্রান্ত ছিল, তারা কয়েক বছর পরপর পিএলওকে ‘সন্ত্রাসী তালিকায়’ স্থান দিত, আবার কয়েক বছর পরপর বাদ দিত। বস্তুত, ইসরায়েল তখন লেবাননে পিএলওর অবস্থানে ভারসাম্য আনতে বন্ধুস্থানীয় হামাস আন্দোলনকে উৎসাহিত করত, যদিও হামাস এখন আবার সন্ত্রাসী তালিকায় চলে এসেছে। ইসরায়েল তার সেই বিপজ্জনক ক্ষুদ্র নীতি ‘ভুলে গেছে’।

সেই পুরোনো দিনগুলোতে কে কল্পনা করেছিল যে এমন প্রথার উদ্ভব হবে, যেখানে অতীতের ‘সন্ত্রাসীরা’ ‘মধ্যপন্থী’ হয়ে যাবে? যেখানে আল-কায়েদা ও আইএসের মতো বিভীষিকার নতুন শাখা গড়ে উঠবে? কে ভেবেছিল পরিস্থিতি এমন দাঁড়াবে যে পেন্টাগনের সবচেয়ে নির্বোধ মানুষটাও এদের ‘রোজ কেয়ামত’ আখ্যা দেবে? ইরানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিচ্ছেন, আইএস পরাজিত হয়েছে—ব্যাপারটা কৌতূহলের। একসময় জর্জ ডব্লিউ বুশ ঘোষণা দিতেন, ‘লক্ষ্য অর্জিত’ হয়েছে।

আর হ্যাঁ, এখন তো পুতিন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে সোচিতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। পুতিন এখন ইরান ও তুরস্কের প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে আলোচনা করছেন। অন্যদিকে তিনি মিসরের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আল-সিসির ভালো বন্ধু। তাই পাঠক খেয়াল রাখতে হবে, এমানুয়েল মাখোঁ এই মাসে সিসিকে প্যারিসে আমন্ত্রণ জানালেন একবারও মানবাধিকারের প্রসঙ্গ না তুলে। অথচ মিসরে এখন রাজনৈতিক বন্দীর সংখ্যা ৬০ হাজার, সেখানে গুম হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। রহস্যজনকভাবে খুনও হয়েছে অনেকে। তবে মাখোঁ হারিরিকে রিয়াদের চোখধাঁধানো কারাগার থেকে বের করে এনেছেন। তিনি বরং সেটা ভালোভাবেই করেছেন, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কারে তিনি পুতিনের চেয়ে বড় আলোকবর্তিকা হবেন বলে মনে হয় না। আর আসাদ কিন্তু পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পরই বলেছেন, তিনি ‘যে কারও’ সঙ্গে আলোচনা করতে প্রস্তুত। আর সিরিয়াকে বাঁচানোর জন্য তিনি পুতিনকে ধন্যবাদও দিয়েছেন (কেউ যোগ করতে পারেন, তাঁকে বাঁচানোর জন্যও এই ধন্যবাদ)।

এটা ঠিক, যুক্তরাষ্ট্র লুইস ক্যারলের অ্যালিস ইন দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ডের সেই দুষ্টু বিড়ালের মতো হয়ে গেছে। কখনো কখনো তারা আমাদের দৃশ্যপটের বাইরে চলে যায়, কুর্দি বা অদ্ভুত নামের বাহিনীকে সহায়তায় তাদের বিশেষ বাহিনীর হঠাৎ হঠাৎ গোলাগুলি বা বোমা মারা ছাড়া। এরা একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, থাকবে শুধু দুষ্টু বিড়ালের শয়তানি হাসি। আমার সন্দেহ, মধ্যপ্রাচ্যে হিজবুল্লাহই একমাত্র গোষ্ঠী, যাদের নাম একটি। আর তারা সন্ত্রাসী ‘তালিকায়’ আছে, তবে মস্কোর তালিকায় নয়। কারণ, পুতিন তো হিজবুল্লাহর মিত্র বাশারকে সমর্থন করেন।

এত বছরে যা বদলায়নি, তা হলো মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের প্রতি অন্যায্যতা, তাদের দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, ভীতি ও অমর্যাদা। আর এই যে নতুন নেতারা মার্কিনদের কাছ থেকে এখানকার দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছেন, তাঁরা কেউই আরব দুনিয়ার বড় অসুখ দুর্নীতির মূলোৎপাটনে কিছু করছেন না। তার সঙ্গে আছে অসমতা, অটোমান সাম্রাজ্য ধসে পড়ার সময় যেটা মধ্যপ্রাচ্যকে উত্তরাধিকার হিসেবে দিয়ে গেছে। মানবতার অগ্রগতি তো হয়ইনি, বরং তার পশ্চাদপসরণ ঘটেছে। এই অঞ্চলের পরিপ্রেক্ষিতে এখন আর কেউ নাগরিক বা মানবাধিকারের কথা বলে না। মহান আরব বিপ্লব ঘটে গেছে। এতে বরং মানুষ আরও শিশুতোষ হয়ে উঠেছে, রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্র, নির্মম পুলিশ ও ব্যাজধারী জেনারেলদের প্রতি তাদের ভালোবাসা যেন বেড়ে গেছে। সম্ভবত সৌদি আরবে বিপ্লব এখনো আসেনি। আমি সব সময় ভেবেছি, যুবরাজদের যেদিন গারদে পোরা শুরু হলো, সেদিন এই রাজতন্ত্রের পতনের সূত্রপাত হলো।

তবে মধ্যপ্রাচ্যের ধ্বংসস্তূপে আশাবাদ খোঁজার মতো মূল্যবান ছোট ছোট কিছু যুক্তি আছে। আমাদের মনে রাখা উচিত, এই বিষাদময় স্থানেই আল-কায়েদার জন্ম। এরপর আবার কোন দানবের জন্ম হবে কে জানে? সে তুলনায় ১৯৭০-এর দশকের গৌরবময় দিনগুলো খুবই নিষ্প্রাণ মনে হয়। মানুষ সব সময়ই দুর্নীতিবাজ পুরোনো পিএলওর প্রত্যাবর্তন কামনা করতে পারে। এমনকি ঐকান্তিক মার্কিন নীতির পুনরাবৃত্তি স্বস্তিদায়ক হতে পারে, যেটা ইদানীং আর সেই দুষ্টু বিড়ালের শয়তানি হাসির মতোও মনে হয় না। 

দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।  

রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।