কোথায় হাত তুলছি, কোথায় তুলছি না

গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের ভাড়া অর্ধেক আছে কি নেই?
গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের ভাড়া অর্ধেক আছে কি নেই?

শিক্ষাজীবনে রোলকলের মুখোমুখি হননি—এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। ক্লাসে যখন রোলকল হয়, তখন নিজেদের উপস্থিতি জানাতে হাত তুলে শিক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন শিক্ষার্থীরা। হাত তোলা মানে হলো ‘আমি উপস্থিত’। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সব প্রতিষ্ঠানেই এই রীতিটা চলে আসছে দীর্ঘদিন। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও আরেকটা জায়গায় হাত তুলে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন শিক্ষার্থীরা। সেই জায়গাটা হলো গণপরিবহন; বিশেষ করে ‘সিটিং সার্ভিস’ বাসগুলো। বিভিন্ন পয়েন্টে চেকার বা সুপারভাইজার ওঠেন এই বাসগুলোয়। দরজায় তাঁর অস্তিত্ব টের পেলেই বাসের বিভিন্ন সিটে বসা শিক্ষার্থীরা হাত উঁচিয়ে হাঁক দেন, ‘মামা স্টুডেন্ট’। চেকার ‘মামা’ হাত গুনে দেখেন বাসে কতজন সাধারণ যাত্রী আর কতজন ‘স্টুডেন্ট’। তারপর ‘ওয়ে বিলে’ সই করে বুঝিয়ে দেন কন্ডাক্টরকে। বাসে এভাবে হাত তুললে কী হয়, তা কারোরই অজানা নয়। দূরত্ব যতই হোক, শিক্ষার্থীরা হাত তুললেই বাসের ভাড়া হয়ে যায় অর্ধেক।

তবে অনেক সময় শুধু হাত তোলায় কাজ হয় না। কনডাক্টর মানতে চান না। শিক্ষার্থীরা তখন হাত তোলেন বাসের কন্ডাক্টরের গায়েও। কারণ, সব সময় এই অলিখিত নিয়ম মানতে চান না তাঁরা। ‘সব বাসে হাফ নেয়, তুমি কেন নিবা না?’—এই চেতনায় অটল থাকেন শিক্ষার্থীরাও। এভাবে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করতে করতেই একসময় তা রূপ নেয় হাতাহাতিতে। একা থাকলে শিক্ষার্থীরাও মার খান।

আসলেই কি সব বাসে ছাড় পান শিক্ষার্থীরা? কিংবা সব শিক্ষার্থীই কি হাত তুলে বলার অধিকার রাখেন? নাকি এখানেও আছে নির্দিষ্ট কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর পক্ষপাতিত্ব? কারা পান এই সুযোগ? ঢাকার মিরপুর রোডের কথাই ধরা যাক। বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে এই রুটে। কিন্তু ‘হাফ ভাড়া’র এই সুযোগ কিন্তু সবাই গ্রহণ করছেন না, কিংবা পারছেন না। নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিয়মিতভাবে এই ছাড়টা নিচ্ছেন। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর নামের একটা আলাদা ‘ওজন’ কিংবা ‘ক্ষমতা’ আছে। চেকার এলে শুধু ‘স্টুডেন্ট’ বলে যদি কাজ না হয়, তাহলে দিতে হয় ‘অমুকের স্টুডেন্ট’ পরিচয়টা। চেকারও জানেন ‘অমুক’ প্রতিষ্ঠান আর দশটা প্রতিষ্ঠানের মতো নয়, এদের কথা না শুনলে বাসের খুব অল্প কাচই আস্ত থাকবে। ফলে উচ্চবাচ্য না করে ওয়ে বিলে সই করে নেমে যান বাস থেকে। অর্থাৎ বাসের হাফ ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানের নামটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আজকাল। যেটা হওয়ার কথা নয়; যদি শিক্ষার্থীদের জন্য বাসে কোনো ছাড় থাকে, সব শিক্ষার্থীরই অধিকার আছে সেটা পাওয়ার। আর বাসভাড়া হাফ হলে কেবল বিআরটিসির বাস নয়, সব নগর পরিবহনেই তা হওয়া উচিত। এ বিষয়ে কেন একটা সরকারি নীতিমালা থাকবে না? আর অতীত থেকে চলে আসা নিয়ম কেন শিক্ষার্থী ও কনডাক্টর পাল্লাপাল্লি করে, মারামারি করে ঠিক করবেন? কর্তৃপক্ষ বলে কিছু একটা তো আছে, তাই না?

কিন্তু এটাও ভেবে দেখার বিষয় যে শুধু বাসের ভাড়ার বেলাতেই কেন এই ‘হাফ’? বড়দের কাছে শুনেছি, অতীতে অনেক কিছুতেই নাকি ছাড় ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য। এমনকি সিনেমার টিকিটের দামও ছিল অর্ধেক। কালে কালে অনেক কিছু থেকে সেই ছাড় উঠে শুধু বাসে কেন সীমাবদ্ধ হয়ে রইল, তা এক বিস্ময়। প্রতিদিন বাসের ভেতরে ঝগড়া, হাতাহাতি হচ্ছে এ নিয়ে। কিন্তু বিষয়টার সুরাহা করার উদ্যোগ কেউ নিচ্ছে বলে মনে হয় না। বলে দিলেই হয়, আজ থেকে সব বাসে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ, অথবা কোনো হাফ নেই। তাহলেই এই বাসে হাফ আছে কি নেই, সেটা নিয়ে কারও গায়ে হাত ওঠে না।

কিন্তু তার চেয়েও যে বিষয়টি বেশি ভাবার, তা হলো শিক্ষার্থীদের হাত কোথায় উঠছে আর কোথায় উঠছে না, সেটা। শিক্ষার্থীদের হাত সব সময়ই শক্তিশালী। সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব সময়ই মিছিল-সংগ্রামে মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে এই হাত। কিন্তু এখন কেন যেন অন্য রকম হয়ে গেছে চিত্রটা। প্রায়ই খবর আসে, কোনো একটা দাবিতে ভাঙচুর করেছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। সেটা কখনো বাস, কখনো দোকানপাট, আবার কখনো হাসপাতাল। এমনকি নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও রেহাই পায় না বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের হাত থেকে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হলে তাঁদের আটকে রাখা কঠিন। কিন্তু বর্তমানে দেশে এমন অনেক ঘটনা ঘটছে, যেগুলোয় শিক্ষার্থীদের বিক্ষুব্ধ হওয়া উচিত। ঠিক যেভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে তাঁরা আক্রমণ করেন বাস, দোকানপাট বা হাসপাতাল, একইভাবে এই অন্যায়কারীদের প্রতিও তাঁদের ক্ষোভটা মেটানোই উচিত। কিন্তু একের পর এক ধর্ষণ, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের হাত উঠছে কই? প্রতিটি ক্যাম্পাস কি বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিংবা রাষ্ট্রের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে? অথচ অতীতে যেকোনো অন্যায়ে সবার আগে হাত বাড়িয়ে দিতেন শিক্ষার্থীরাই। তবে কি স্বার্থহীন এই শ্রেণিও এখন বদলে গেছে? কেবল নিজেদের প্রতিষ্ঠানের ওপর আঘাত এলেই কি গর্জে উঠবেন শিক্ষার্থীরা? নাকি প্রতিষ্ঠানের দেয়াল ভুলে ‘শিক্ষার্থী’ পরিচয়টাই বড় হয়ে উঠবে?