কর ফাঁকির জন্য বৈষম্য বাড়ে

গত বছর পানামা পেপারস ফাঁস হওয়ার পর এবার প্যারাডাইস পেপারস ফাঁস হলো। আবারও জানা গেল, বিশ্বের ক্ষমতাবান ও বিত্তবান লোকেরা কর ফাঁকি দিচ্ছেন; যে তালিকায় বাংলাদেশের বেশ কটি প্রতিষ্ঠানেরও নাম আছে। কৌতূহলোদ্দীপকভাবে প্যারাডাইস পেপারস ফাঁসের এক সপ্তাহের মধ্যে ক্রেডিট সুসির গ্লোবাল ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৭ প্রকাশিত হলে জানা গেল, বিশ্বের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনী লোক পৃথিবীর মোট সম্পদের ৫০ দশমিক ১ শতাংশ ভোগ করছেন। অথচ ২০০০ সালে এটা ছিল ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ১৭ বছরের ব্যবধানে এই শ্রেণির হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার হার যথেষ্টই বেড়েছে। এই হারে তা বাড়তে থাকলে নিকট ভবিষ্যতে তা ৭০-৮০ শতাংশ হয়ে যাবে। আরেকটি কথা বলা দরকার, গত ১২ মাসে বৈশ্বিক সম্পদ বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ, আর্থিক খাতের সংকটের পর এটাই সম্পদ বৃদ্ধির সর্বোচ্চ হার। ফলে এই শ্রেণির হাতে পুঞ্জীভূত সম্পদের প্রকৃত পরিমাণও যথেষ্ট বেড়েছে।

গতবার পানামা পেপারসে নাম আসার পরিপ্রেক্ষিতে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে আদালত নিজ পদের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করেন। কিন্তু এতে এই ব্যবস্থায় ন্যূনতম চিড় ধরেনি।

তবে একটি ব্যাপার না বললেই নয়, পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসের মতো ফাঁস কাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমরা অন্তত পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে পারলাম। এর আগে আমরা উইকিলিকসের ফাঁস কাণ্ডের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক গুন্ডামি সম্পর্কে সবিস্তারে জানতে পেরেছিলাম, যদিও সেটা আমাদের একেবারে অজানা ছিল না। তবে দাপ্তরিক নথির আলাদা গুরুত্ব আছে। পৃথিবীতে যখন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না, তখন এ ধরনের ফাঁস কাণ্ড, অর্থাৎ সত্য তথ্য ফাঁস করে দেওয়াকে সামাজিক প্রতিবাদের কার্যকর ধরন বলা যায়। আমরা যা জেনেছি তা একেবারে নতুন না হলেও সত্য মানুষকে মুক্তির দিশা দেয়, এখানেই তার গুরুত্ব।

যাহোক, এবার কর ফাঁকির সঙ্গে সম্পদের বৈষম্য বৃদ্ধির প্রসঙ্গে আসি। ব্যাপারটা হলো ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অভিঘাত সামলাতে যুক্তরাষ্ট্র এক সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেয়। এরপর প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান সেটা আরও এগিয়ে নেন। অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে বলা হয় নিওলিবারেলিজম বা নব্য উদারনীতিবাদ, আজকের তীব্র বৈষম্যের বীজ এর মধ্যেই নিহিত। এর মাধ্যমে রিগ্যান প্রথমেই সর্বোচ্চ করের হার ৭০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করেন, যাতে ধনীদের হাতে আরও বেশি টাকা জড়ো হয়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে কর হ্রাসের যে প্রস্তাব নিয়ে হইচই হচ্ছে, সেখানেও ধনীদের ছাড় দেওয়া হয়েছে। অথচ একসময় যুক্তরাষ্ট্রেই ধনীদের বিপুল পরিমাণ কর দিতে হতো। এই সংস্কারের পাশাপাশি রিগ্যান আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেন। রাষ্ট্র তখন থেকে ক্রমেই ‘বাজার রাষ্ট্রে’ পরিণত হতে শুরু করে, যেখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা সংকুচিত হতে থাকে, যার কাজ হয়ে দাঁড়ায় নিরাপত্তা রক্ষা, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, রাজস্ব ও মুদ্রাব্যবস্থা ঠিক রাখা। আর বাকি সব চলে যায় করপোরেটের হাতে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো খাতগুলোও। ফলে করপোরেশনগুলোর ব্যবসার পরিধি বহুগুণ বেড়ে যায়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯০-এর দশকে করপোরেশনের ব্যবস্থাপক ও সিইওদের বেতন আকাশচুম্বী হতে শুরু করে। এ সময় সিইওদের বেতন বাড়ে ৪০০ শতাংশ, অন্যদিকে শ্রমিকদের বেতন বাড়ে ৫ শতাংশেরও কম। প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র ও তারপর ইউরোপ, সেখানে থেকে এই ধারা ক্রমে অন্যান্য জায়গায়ও ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি দেশই নিজেদের মতো করে কমবেশি এই নব্য উদারনীতিবাদী অর্থনীতি গ্রহণ করে। অন্যদিকে রাজস্ব আইনেও কর ফাঁকির সুযোগ আছে। অর্থাৎ একদিকে করপোরেশনের হাতে বিপুল টাকা জড়ো হওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে তার মালিক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কর ফাঁকি দেওয়ারও সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সবার শীর্ষে। এতে বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করছে। এর সঙ্গে চুরি, ডাকাতি, ঘুষ, দুর্নীতি, চোরাচালান, বেআইনি কারবার, জালিয়াতি প্রভৃতি মাধ্যমে উপার্জিত অর্থও পাচার হয়ে অফশোর কোম্পানিতে বিনিয়োগ হয় {সূত্র: দ্য ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক কমিশন ফর আফ্রিকা, (২০১৩,৩)}। স্বাভাবিকভাবেই এসব টাকার ওপর সরকার রাজস্ব পায় না।

অর্থ পাচারের প্রভাব উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেশি অনুভূত হয়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে কিছু কিছু উন্নয়নশীল দেশে উন্নয়ন বাবদ বিদেশ থেকে যে পরিমাণ টাকা আসে, তার চেয়ে বেশি পরিমাণ টাকা এভাবে পাচার হয়ে যায় (কার অ্যান্ড লেব্লাঙ্ক, ২০১৩)। সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, সাব-সাহারা আফ্রিকা সারা পৃথিবীর ‘নেট ক্রেডিটর’ হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ, বিভিন্ন দেশে আফ্রিকানদের যে পরিমাণ সম্পদ আছে, সেটা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কাছে আফ্রিকার মোট দায়ের চেয়ে বেশি। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও এটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কারণ এসডিজিতে বলা হয়েছে, এটি বাস্তবায়নের জন্য দেশীয় উৎস থেকে অর্থায়নের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই এতে উন্নয়নশীল দেশগুলো বিনিয়োগযোগ্য টাকার অভাবে পড়ে যাবে।

দেখা যাচ্ছে, ধনী ও ক্ষমতাবান লোকেরাই কর ফাঁকি দিচ্ছেন। যাঁদের এত টাকা নেই, তাঁদের কর ফাঁকি দেওয়ার প্রশ্নও আসে না। রাজস্বকাঠামোতেও দেখা যায়, ধনীদের নানাভাবে ছাড় দেওয়া হয়। বাংলাদেশে ভ্যাট নামক পরোক্ষ করের মাধ্যমে ঠিকই তাঁদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে। আবার আমাদের মতো মধ্যবিত্তের বেতন থেকেই কর কেটে নেওয়া হয় (হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের কর কোম্পানি বহন করে, তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান কর্মীর বেতন থেকেই তা কেটে নেয়)। এখানে ফাঁকির সুযোগ নেই। অনেক মধ্যবিত্ত সেই ফাঁকি দিতেও চান না। আবার সরকারের সংগৃহীত মোট রাজস্বের ৭০ শতাংশই আসে পরোক্ষ কর থেকে, অর্থাৎ ভ্যাট থেকে। আর বাকি মাত্র ৩০ শতাংশ আসে প্রত৵ক্ষ কর বা আয়কর থেকে। অথচ এই অনুপাতটা সমান সমান হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে মনে করে খোদ রাজস্ব বিভাগ। বৈষম্য বাড়ার এটাও একটা কারণ। এই করের টাকা দিয়েই তো জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকার ব্যয় করে থাকে। পৃথিবীর প্রায় ৭৭ কোটি মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে (http://www.worldbank.org/ en/publication/poverty-and-shared-prosperity), এই করের টাকা দিয়ে বহু মানুষকেই সেই চক্র থেকে বের করে আনা সম্ভব। অর্থাৎ বিত্তবানেরা যত কর ফাঁকি দেবে, ততই আমজনতার ক্ষতি।  

কথা হচ্ছে সরকার তো সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে পারছে না, করের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে তা করার সুযোগ আছে। সে জন্য বিত্তবানদের ওপর অনুক্রমিক হারে করারোপ করতে হবে। অর্থাৎ যার আয় যত বেশি, তার ওপর তত বেশি করারোপ করতে হবে। অন্যদিকে টাকা পাচার বন্ধ করতে বৈশ্বিক পরিসরে সহযোগিতার মাত্রা বাড়াতে হবে। বিশ্বায়নের যুগে সেটা খুব কঠিন কাজ নয়। বৈষম্য হ্রাস ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পৃথিবীকে এই ঐকমত্যে আসতেই হবে। এর জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দক্ষতা।

প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক ও অনুবাদক।