এরশাদের উত্থান, পতন ও পুনরুত্থান

৬ ডিসেম্বর ১৯৯০: এরশাদের পতনে আনন্দিত লোকজন সংবাদপত্র পড়ছে
৬ ডিসেম্বর ১৯৯০: এরশাদের পতনে আনন্দিত লোকজন সংবাদপত্র পড়ছে

কিছু কিছু দিন আছে যা আমরা নানাভাবে স্মরণ করি—কখনো ঘৃণায়, তখন আমরা বলি কালো দিবস; কখনো ভালোবাসায়, তখন বলি শোক দিবস অথবা বিজয় দিবস। কিছু কিছু দিন আছে, যা আমাদের পাওয়া ও না-পাওয়ার হিসাবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। অনেক বছর পর আমরা যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন পোস্টমর্টেম করে দেখি, আসলে আমরা কী করেছিলাম, কী চেয়েছিলাম এবং কী পেয়েছিলাম। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এমনই একটি দিন। ওই দিন এ দেশে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছিল। কিন্তু আসলে জিতেছিল কে বা কারা, আমরা সেই জিজ্ঞাসার জবাব এখনো খুঁজছি।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সরকারকে হটিয়ে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিজেকে গদিনশিন করেন। ওই দিন বেতার ও টেলিভিশনে প্রচারিত ভাষণে তিনি বলেন, ‘জনগণের ডাকে সাড়া দিতে হইয়াছে, ইহা ছাড়া জাতির সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না।’ তিনি বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক শাসন জারি করে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন। সামরিক শাসন জারির পরপরই আওয়ামী লীগপন্থী দৈনিক বাংলার বাণী এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণকে সমর্থন দিয়েছিল। শেখ ফজলুল করিম সেলিম সম্পাদিত এই দৈনিকে মোনাজাতরত এক মহিলার ছবি ছাপা হয়: সামরিক আইন জারি হওয়ায় তিনি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছেন। আওয়ামী লীগ মনে করেছিল যে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি তো গেল, এটাই লাভ।

আওয়ামী লীগ আর বিএনপি হলো দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল। দেশের ওপর তাদের একচেটিয়া প্রাধান্য। তাদের দ্বৈরথে দেশ জেরবার হলেও জেনারেল এরশাদ মোটামুটি শান্তিতেই দেশ শাসন এবং উন্নয়ন দুটোই চালিয়েছেন একটানা অনেকগুলো বছর। আমরা নসিহত শুনেছি: এ দেশের মানুষ অশিক্ষিত, এরা গণতন্ত্র বোঝে না, এদের দরকার উন্নয়ন। ‘উন্নয়নের রাজনীতির’ প্রথম ঢেউ এ দেশে বইয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের সিপাহসালার আইয়ুব খান। দ্বিতীয় ঢেউটি আমরা দেখলাম এরশাদের জমানায়। সেতু তৈরি হচ্ছে, রাস্তা চওড়া হচ্ছে, দালান উঁচু হচ্ছে, খাল ভরাট করে কালভার্টের বাক্স তৈরি হচ্ছে। নতুন এক স্লোগান চালু করলেন তিনি—নতুন বাংলা। তিনি তো কবি। গান লিখে ফেললেন। তিনি যখন তাঁর স্ত্রী ও শিশুপুত্র নিয়ে পথ দিয়ে হাঁটেন, তাঁদের ওপর ভক্তরা ফুলের পাপড়ি ছিটায়। ব্যাকগ্রাউন্ডে সাবিনা ইয়াসমীন আর এন্ড্রু কিশোরের গলায় কবি এরশাদের লেখা গান বাজে, ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ব মোরা, নতুন করে আজ শপথ নিলাম। নব জীবনের ফুল ফোটাবার, প্রাণে প্রাণে আজ দীক্ষা নিলাম।’

রাজনীতিবিদদের ‘গুড হিউমারে’ রেখে তিনি ভালোই চলছিলেন। কিন্তু তরুণেরা সব সময়ই উর্দি শাসনের বিরুদ্ধে। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে। এবারও তা-ই হলো। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের স্মরণে ১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস পালন করার জন্য ১৪টি ছাত্রসংগঠন একত্র হলো। পরে আরও ৫টি ছাত্রসংগঠন এতে যোগ দেয়। তারা ১০ দফা দাবিনামাও তৈরি করে। তাদের মূল দাবি ছিল মজিদ খানের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বাতিল করা।

১৯৮২ সালের ২১ নভেম্বর তৈরি হওয়া ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে যোগ দেয় ছাত্রলীগ (মুনীর-হাসিব), ছাত্রলীগ (ফজলু-চুন্নু), ছাত্রলীগ (জালাল-জাহাঙ্গীর), ছাত্রলীগ (রশীদ-রতন), ছাত্রলীগ (ওয়ারেশ-জহীর), ছাত্রলীগ (আখতার), ছাত্রলীগ (আজিজ), বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন, জাতীয় ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন (ইসরারুল-স্বপন), বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন (মানু), বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন (গিরানি), বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ছাত্র ঐক্য ফোরাম, বাংলাদেশ ছাত্র সমিতি, জাতীয় ছাত্র সংসদ, সমাজবাদী ছাত্র জোট ও ছাত্র একতা কেন্দ্র।

১৯৮৩ সালের ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। কমপক্ষে পাঁচজন ছাত্র নিহত ও শতাধিক আহত হন। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রথম বলি হলেন জয়নাল, কাঞ্চন, মোজাম্মেল, জাফর ও দীপালি সাহা। এরশাদের সেনাশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে সেই প্রথম রক্ত ঝরল ঢাকার রাজপথে। এরপরও অনেক তরুণের রক্ত ঝরেছে। নূর হোসেন আর ডা. মিলন তো মুখে মুখে উচ্চারিত নাম। রক্তের সিঁড়ি বেয়ে গণতন্ত্রের ঝান্ডা হাতে যাঁরা ১৯৯১ সাল থেকে এ দেশ শাসন করে যাচ্ছেন, তাঁরা এই তরুণদের কজনের নামে কয়টি রাস্তা, সেতু বা ভবনের নামকরণ করেছেন? প্রতিবছর ৬ ডিসেম্বর এলে মহাসমারোহে ‘স্বৈরাচার পতন দিবস’ পালন করা হয়। এই তরুণদের ছবি নিয়ে শোভাযাত্রা হয় না। অকৃতজ্ঞ এই দেশ, অকৃতজ্ঞ এই সমাজ!

এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে মসনদ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০। রাজনীতিবিদদের একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে কিংবা লেলিয়ে দিয়ে তিনি মহাসুখেই রাজত্ব করছিলেন। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো অংশ না নেওয়ায় তাঁর পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা আর সম্ভব ছিল না। রাজনীতিবিদেরা অনেকেই এরশাদের কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছিলেন, অনেকেই মন্ত্রিত্ব করেছেন, কেউ কেউ নিয়মিত মাসোহারা পেতেন বলেও কানাঘুষা আছে। একদিন না একদিন এসব তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ পাবেই। আর আমরা তখন রাবীন্দ্রিক ভাষায় তাঁদের বলতে পারব, ‘সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!’

ওই সময় ‘তিন জোটের রূপরেখা’ নিয়ে আমরা অনেক কথাবার্তা শুনেছি। তিন জোটের মধ্যে ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫-দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বে সাতদলীয় জোট এবং বামপন্থীদের পাঁচদলীয় জোট। পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীও ‘যুগপৎ’ আন্দোলনে শামিল ছিল। ১৯৮৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর আবিষ্কৃত ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ তত্ত্ব অন্য দলগুলো গ্রহণ করায় একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জোরদার হয়। রাজপথে তখন সবচেয়ে জনপ্রিয় স্লোগান ছিল—এক দফা এক দাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি।

এরশাদ ১৯৮৬ সালে একটা পাতানো সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে এবং আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের সেই নির্বাচনে ভিড়িয়ে ভেবেছিলেন, তিনি বুঝি টিকে গেছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর মধুচন্দ্রিমা পর্বটি এক বছর টিকেছিল। শেষের দিকে আবার সামরিক আইন জারি করে এরশাদ ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। ডা. মিলন নিহত হওয়ার পর পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে। সেনাবাহিনী এরশাদকে জানিয়ে দেয়, সমস্যার সমাধান করতে না পারলে এরশাদকেই তার দায় নিতে হবে, সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ থাকবে।

তিন জোটের নেতাদের মধ্যে একটা সমঝোতা হয়েছিল যে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে রাষ্ট্রপতি করতে চেয়েছিল। খালেদা জিয়া জানিয়ে দেন যে প্রধান বিচারপতিই হবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। সারা দিন অপেক্ষা করার পর প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে মেনে নিতে আওয়ামী লীগ রাজি হয় (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়; হায়দার আকবর খান রনো, শতাব্দী পেরিয়ে)।

ক্ষমতার চূড়া থেকে এরশাদের পতনের দৃশ্যটি খুব কাছ থেকে দেখেছেন সে সময় রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের দায়িত্ব পালনকারী মেজর জেনারেল মনজুর রশীদ খান। পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পর তিনি শেষবারের মতো তাঁর অফিসে যান। সেখানে তিনি আধা ঘণ্টা ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত কাগজপত্র সরিয়ে নেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত সচিব ৪ কোটি ৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা অফিস থেকে সরিয়ে নিতে সক্ষম হন (মনজুর রশীদ খান, আমার সৈনিক জীবন: পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ)।

পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও এরশাদ তাঁর অনুগত নবম ডিভিশনের জিও মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলামের ওপর নির্ভর করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। পরিস্থিতি আঁচ করে সেনাপ্রধান লে. জেনারেল নূরউদ্দীন রফিকের পুরো বাহিনী সাভারে পাঠিয়ে দেন। জেনারেল নূরউদ্দীন এবং সিজিএস মেজর জেনারেল আবদুস সালাম সারা দিন এরশাদের ফোন ধরেননি। সেনা কর্মকর্তাদের একটা বড় অংশ এরশাদের ‘অপকর্মের’ দায় আর বয়ে বেড়াতে চায়নি।

৬ ডিসেম্বর বেলা দুইটায় বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। এরশাদ নবনিযুক্ত উপরাষ্ট্রপতির
কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। এভাবেই শেষ হয় নয় বছরের এরশাদ-জমানা।

এরশাদ-জমানা কি আসলেই শেষ হয়েছে? বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের সরকার এরশাদকে জেলে ঢোকায়, তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা দায়ের করে। খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার তাঁর বিরুদ্ধে অনেক মামলা দায়ের করে এবং একটি মামলায় তিনি দণ্ডিত হন। পরে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার এরশাদকে সব মামলায় জামিন দিয়ে জাতীয় সংসদে বসার সুযোগ করে দেয়। তারপর এরশাদ ২০০৫ সালে তাঁর জাতীয় পার্টি নিয়ে মহাসমারোহে খালেদা জিয়ার জোটে যোগ দেন। খালেদা জিয়া তাঁকে কাছে টেনে নিলেন পরম মমতায়। ২০০৭ সালের এক-এগারোর কিছু আগে সমীকরণ আবার পাল্টে যায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এরশাদ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটে মহা অংশীদার হন। ২০০৯ সাল থেকেই তিনি এবং তাঁর দল ক্ষমতার ভাগীদার।

আমার কাছে ‘স্বৈরাচার পতন দিবস’ বিরাট এক পরিহাস। এরশাদ পড়ে গিয়েছিলেন বটে। তবে আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর পুনরুত্থান ঘটেছে। গণমাধ্যমে তিনি প্রায়ই হুংকার দেন, তাঁকে বাদ দিয়ে এ দেশে কেউ সরকার গঠন করতে পারবে না। এরশাদকে ক্ষমতা থেকে নামাতে যাঁরা প্রাণ দিলেন, তাঁরা অলক্ষে হয়তো ভাবছেন, আমরা কেন মরলাম? কার জন্য? তাঁদের স্বজনদের হাহাকার কি মিলিয়ে গেছে? তাঁরা কি অভিশাপ দিচ্ছেন না?

আওয়ামী লীগের চোখে বিএনপি অবৈধ। বিএনপির চোখে আওয়ামী লীগ সরকার অবৈধ। মাঝখানে বসে এরশাদ হয়তোবা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ভাবছেন—এরা আমাকে বলে স্বৈরাচার? এরা তাহলে কী?

৬ ডিসেম্বর এলে আমাদের অনেকের মনের ভাবনা এলোমেলো হয়ে যায়। জোয়ার-ভাটার এই দেশে সবই সম্ভব!

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।