অসন্তোষের বিশ্বায়ন

জোসেফ ই স্টিগলিৎস
জোসেফ ই স্টিগলিৎস

১৫ বছর আগে আমি গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্টস নামে যে বইটি লিখি, সেখানে আমি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলাম উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশ্বায়ন নিয়ে এত অসন্তোষ কেন। খুব সাধারণভাবে বললে অনেকেই বিশ্বাস করতেন, এই ব্যবস্থায় তাঁদের ঠকানো হচ্ছে, ‘জালিয়াতি’ করা হচ্ছে। আর বৈশ্বিক বাণিজ্য চুক্তিগুলো এমনভাবে করা হয়, যাতে সেগুলো বিশেষভাবে অন্যায্য হয়।

এখন বিশ্বায়ন নিয়ে অসন্তোষের কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য উন্নত দেশে জনতুষ্টিবাদের ঢেউ উঠেছে। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাজনীতিকেরাই, যাঁরা বলছেন, এই ব্যবস্থা তাঁদের দেশের প্রতি বৈষম্যমূলক। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জোর দিয়ে বলেছেন, মেক্সিকো ও চীনের কেউ কেউ তাঁদের বাণিজ্য চুক্তিতে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। তাহলে যে ব্যাপারটা উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে আমাদের সবার জন্য একইভাবে লাভজনক হতে পারত, সেটাকে কেন সব জায়গায় এ রকম শাপশাপান্ত করা হচ্ছে? বাণিজ্য চুক্তি কী করে আমাদের সবার জন্য অন্যায্য হতে পারে?

ট্রাম্পের দাবি উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে হাস্যকর, ট্রাম্প নিজেও তা–ই। মূলত যুক্তরাষ্ট্র নিজেই নিয়মকানুন প্রণয়ন করে বিশ্বায়িত ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানগুলো নির্মাণ করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো প্রতিষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা আছে, যদিও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা হ্রাস পাচ্ছে (ট্রাম্প এই ভূমিকা একেবারেই শেষ করে দিতে চান)। আমার মতো মানুষ যে ২৫ বছর ধরে বাণিজ্য চুক্তি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আসছে, তার কাছে এটা পরিষ্কার যে মার্কিন ব্যবসায়ীরা যা চান, তার প্রায় সবই তাঁরা পেয়ে যান। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তাঁরা কী চান তা নিয়ে। করপোরেশনগুলো রুদ্ধদ্বারের ভেতরে বসে এসব অ্যাজেন্ডা নির্ধারণ করে, যার বলি হন পৃথিবীর সব শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ।

বস্তুত, প্রায়ই এমনটা দেখা যায় যে শ্রমিকদের মজুরি কমে যাওয়া এবং চাকরি চলে যাওয়া সত্ত্বেও তাঁদের আনুষঙ্গিক ক্ষতির শিকার মনে করা হয়। অর্থাৎ, তাঁরা নিরীহ হলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে অবধারিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। কিন্তু যা ঘটেছে, তার ভিন্ন একটি ব্যাখ্যাও আছে। ব্যাপারটা হলো, বিশ্বায়নের একটি উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিকের দর-কষাকষির ক্ষমতা দুর্বল করা। করপোরেশনের প্রয়োজন ছিল সস্তা শ্রমিক, অবশ্য তারা সেটা এমনিতেই পেতে পারত।

এই ব্যাখ্যায় বাণিজ্য চুক্তির কিছু ধাঁধার উত্তর পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উন্নত দেশগুলো কেন তাদের সবচেয়ে বড় সুবিধা, অর্থাৎ আইনের শাসন পরিত্যাগ করতে চায়? সর্ব সাম্প্রতিক বাণিজ্য চুক্তিগুলোতে এমন ধারা আছে, যেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের চেয়ে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের বেশি অধিকার দেওয়া হয়েছে।

বিশ্বায়ন নিয়ে পৃথিবীজুড়ে অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, এটার নাম দিন লাস ভেগাস কৌশল, মানে ২৫ বছর ধরে বিশ্বায়নের যেভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে, তার ওপর বাজি দ্বিগুণ করে দিন। এই বাজিটা অন্য সব প্রমাণিত ব্যর্থ নীতির (চুইয়ে পড়া অর্থনীতি) ওপর ধরা বাজির ওপর প্রতিষ্ঠিত, আপনাকে এই আশায় বাজি ধরতে হবে যে কোনো একদিন এটি সফল হবে।

দ্বিতীয়ত, আপনি ট্রাম্পবাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেন। অর্থাৎ নিজেকে বিশ্বায়িত ব্যবস্থা থেকে বিযুক্ত করতে পারেন এই আশায় যে এটা করলে কোনোভাবে সেই আগের পৃথিবী ফিরে আসবে। কিন্তু সুরক্ষাবাদ দিয়ে কাজ হবে না। বৈশ্বিকভাবে উৎপাদনশীল খাতের কাজ কমছে। এর কারণটাও কিন্তু খুব স্বাভাবিক, উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি চাহিদার বৃদ্ধি ছাড়িয়ে গেছে। তবে উৎপাদনশীল খাত ফিরে এলেও চাকরি আর ফিরবে না। উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি যেমন রোবটের কারণে যে গুটি কয়েক চাকরি সৃষ্টি হবে, তার জন্য উচ্চ দক্ষতার প্রয়োজন হবে। সেগুলো আবার এক জায়গায় থাকবে না, নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে। সেই দ্বিগুণ বাজি ধরার মতো এই মনোভঙ্গিও ব্যর্থ হতে বাধ্য। ফলে যারা পেছনে পড়ে গেছে, তাদের অসন্তোষ আরও বাড়বে।

ট্রাম্প বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর যে লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন, তাতেও ব্যর্থ হবেন, যেটা নির্ধারিত হয় অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ও বিনিয়োগের পার্থক্য দ্বারা। এখন তো রিপাবলিকানরা সব হাতে পেয়ে গেছে এবং শত শত কোটি টাকার মালিকদের কর হ্রাসের আইন করেছে, তাতে জাতীয় সঞ্চয় কমবে এবং বাণিজ্য ঘাটতি বাড়বে। ডলারের মূল্য বাড়ার কারণে এমনটা হবে। ট্রাম্প হয়তো এটা পছন্দ করবেন না। কিন্তু তিনি ধীরে ধীরে বুঝতে পারছেন, কিছু কিছু ব্যাপার দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী পদধারী মানুষেরাও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না।

এবার তৃতীয় মনোভঙ্গির প্রসঙ্গে আসি। সেটা হলো সুরক্ষাবাদ ছাড়াও সামাজিক সুরক্ষা, ছোট ছোট নরডিক দেশগুলো যে মনোভঙ্গি গ্রহণ করেছে। তারা জানে, ছোট দেশ হওয়ায় তাদের উন্মুক্ত থাকতে হবে। কিন্তু তারা এটাও জানত যে উন্মুক্ত থাকলে শ্রমিকেরা ঝুঁকির মুখে পড়বেন। ফলে তাদের এমন এক সামাজিক চুক্তি লাগবে, যেখানে শ্রমিকদের পুরোনো কাজ থেকে বের করে এনে নতুন চাকরিতে নেওয়া যায়, আর মধ্যবর্তী পর্যায়ে তাঁদের কিছু সাহায্যও করা যায়। নরডিক দেশগুলো গভীরভাবে গণতান্ত্রিক। তাই তারা জানত, যদি অধিকাংশ শ্রমিক বিশ্বায়নকে উপকারী মনে না করেন, তাহলে সেটা টেকসই হবে না। আর এসব দেশের ধনীরা বুঝতে পেরেছেন, বিশ্বায়নের যেভাবে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল, সেটা হলে ব্যাপক সুবিধা পাওয়া সম্ভব ছিল।

সম্প্রতি মার্কিন পুঁজিবাদের লোভ সব সীমা ছাড়িয়েছে। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটে এটা ভালোভাবে নিশ্চিত হয়ে গেছে। কিন্তু কিছু দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বোঝা গেল, বাজার অর্থনীতির এমন রূপও আছে, যেখানে পুঁজিবাদ ও বিশ্বায়নের রাশ টানা সম্ভব। সেখানেও টেকসই উন্নয়ন ও অধিকাংশ জনগণের উচ্চ জীবনমান নিশ্চিত করা সম্ভব। এ ধরনের সফলতা থেকে আমরা শিখতে পারি, আমাদের কী করতে হবে। ঠিক যেভাবে আমরা পুরোনো ভুল থেকে শিখতে পারি, কী করা উচিত নয়। বিশ্বায়নকে যদি সবার ভালোর জন্য কাজে লাগানো না যায়, তাহলে এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া কিন্তু তীব্র হতে পারে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর পুরোনো অসন্তোষ আর উন্নত দেশগুলোর নতুন অসন্তোষ মিলে এটা হতে পারে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

জোসেফ ই স্টিগলিৎস: নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ।