ডাকসু নির্বাচনের দাবি যৌক্তিক

ডাকসু নির্বাচনের দাবির প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন রয়েছে
ডাকসু নির্বাচনের দাবির প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন রয়েছে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের দাবিতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গত কয়েক দিন একটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি হতে আমরা দেখেছি। এই দাবি নিয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও কিছুটা আগ্রহ দেখা যায়। ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে ছাত্র ইউনিয়নসহ কয়েকটি ছাত্রসংগঠনও। তবে সরকার-সমর্থক ও সরকারবিরোধী দুটি বৃহৎ ছাত্রসংগঠনের এ বিষয়ে কোনো জোরালো দাবি আছে, এমনটা লক্ষ করা যায় না। কিন্তু সুশীল সমাজের একটি অংশের বিবেচনায় এসব ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না।


বর্তমানে দেশকে যাঁরা ক্ষমতায় কিংবা বিরোধী দলে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের বেশ কয়েকজনের শীর্ষ পর্যায়ে উত্তরণ ঘটেছে ছাত্ররাজনীতি থেকে। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়কালটা এ দেশে ছাত্ররাজনীতির স্বর্ণযুগ বলা চলে। তখন প্রায় সব ছাত্রছাত্রীই কোনো না কোনো দলের নেতা, কর্মী কিংবা সমর্থক ছিলেন। আর তাঁদের সিংহভাগই ছিলেন প্রগতিশীল ঘরানার। শুধু ডাকসু নয়, তখনকার সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। এই সংসদগুলো তাদের পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক সংগঠনের কিছু কর্মসূচিতে অংশ নিত বটে। তবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের সুযোগ-সুবিধার বিষয় কর্তৃপক্ষের নজরে আনতেও সচেষ্ট ছিল। সক্রিয় ছিল ক্রীড়া, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রম সংগঠন ও ব্যবস্থাপনায়। তত্ত্বাবধান শিক্ষকেরাই করতেন। কিন্তু ব্যবস্থাপনার বড় ভূমিকায় থাকত ছাত্র সংসদ। এতে তাদের মধ্যে ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্বের গুণাবলির বিকাশ ঘটত।

বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও শত্রুতা তেমনটা ছিল না। বরং পরমতসহিষ্ণুতার নজির দেখা গেছে অনেক ক্ষেত্রে। নেতা-কর্মীরা নিজদের ভালো আচরণ ও সহমর্মিতা দিয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের দলে টানতে সচেষ্ট ছিলেন। ভোট পাওয়ার জন্য পেশিশক্তির ব্যবহারও খুব একটা দেখা যেত না। সংগঠনগুলোর বিভিন্ন স্তরে নিয়মিত নির্বাচন হয়ে পূর্ণ কার্যনির্বাহী কমিটি সম্মেলনেই গঠিত হতো। ওপরের স্তর বা কেন্দ্র থেকে জেলা, মহকুমা কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের কমিটি গঠনের রেওয়াজই ছিল না। জেলা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিনিধিরাই কেন্দ্রীয় সম্মেলনে ডেলিগেট হয়ে আসতেন। সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের কিছুটা প্রভাব থাকলেও কাউন্সিল অধিবেশনেই নেতৃত্ব নির্বাচন সম্পন্ন হতো। আর তা হতো নিয়মিত।
ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁদের দাবি যৌক্তিক এবং এর আইনগত দিকও আছে। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃত্ব বিভ্রান্ত হতে শুরু করে। তাঁদের অনেকের কাছেই ধরা দেয় নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা। আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারও তখন থেকেই ছাত্ররাজনীতির সংস্কৃতির অংশ হয়ে যায়। ভালোমন্দ মিশিয়েই তবু চলছিল ছাত্রসংগঠন ও ছাত্রসংসদের কার্যক্রম। সামরিক শাসকেরাও তাঁদের সৃষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুগত ছাত্রসংগঠন গড়ে তুলতে সক্ষম হন। সেই সময়কালেরও বেশ কিছু ছাত্রনেতা আজকের জাতীয় রাজনীতিতে পরিচিত মুখ।
আর স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের সময়ই সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়। তার পতনেও বড় ভূমিকা রাখে ডাকসু। নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক রাজনীতি। পাশাপাশি একে একে বন্ধ হয়ে যায় বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নির্বাচন। এখন কোথাও আছে এমনটা জানা যায় না। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বের বিধান সংশ্লিষ্ট আইনেই রয়েছে। তাঁদের বাদ দিয়ে সিনেট পূর্ণাঙ্গ হয় না। আর ছাত্রদের একটি প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি সংযোগ সেতু নির্মিত হবে। দেশ বিভাগের পূর্ব থেকেই ছাত্ররাজনীতি শুরু হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সমসাময়িক নেতারা প্রায় সবাই ছাত্ররাজনীতির ফসল। অবশ্য এর আগের প্রজন্মের নেতারা ছাত্ররাজনীতি করেননি। সেই ধারাও তখন ছিল না।
একটি প্রশ্ন থাকে, দেশের বৃহৎ দুটি ছাত্রসংগঠন এ বিষয়ে জোরদার কোনো দাবি কেন জানায় না? পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, যারা ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের সমর্থক ছাত্রসংগঠন সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি কাছাকাছি অঞ্চলে এমনিতেই বিকল্প একটি ক্ষমতাবলয় সৃষ্টি করে। ছাত্রসংসদের আওতায় যা আসত না এমন ধরনের অনেক ক্ষমতাও ভোগ করে তারা। প্রতিষ্ঠানভেদে পার্থক্য আছে ভূমিকায়। তবে মিলই বেশি। ভর্তি থেকে শুরু করে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ ও কেনাকাটায় তারা শুধু নামে মাত্র থাকে না, থাকে শরিকি ভূমিকায়। নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় যাঁরা, তাঁদের অনেকের ছাত্রত্ব থাকলেও তা নামে মাত্র। বেশ কয়েকজন পিতা-মাতা হয়েছেন। চলাফেরা করেন মোটর কারে। আর এই অবস্থা কিন্তু জেলা ও উপজেলায়ও। সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে অসংখ্য পদ। উপজেলা পর্যায়ে কমিটিতেও ‘আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক’ ধরনের বেশ কিছু পদ আছে। আসলে অনেককে জায়গা করে দিতে এ ধরনের পদ-পদবি সৃষ্টি করা হয়েছে।
আর দুর্ভাগ্য যে স্থানীয় পর্যায়ে কোথাও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয় না। এমনকি কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত থাকলেও। কমিটি ঘোষণা দেওয়া হয় ওপরের স্তর থেকে। কেন্দ্রীয় কমিটির কাউন্সিল অধিবেশন হয় অনিয়মিত। আর সেখানে কমিটি কীভাবে হয়, সেটা সবারই জানা। বিষয়টা চলছে দীর্ঘকাল ধরে। প্রাণঘাতী উপদলীয় কোন্দল বেড়েই চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতোই ছাত্রসংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। আর তাদের নেতৃত্বের লক্ষ্য কিন্তু নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি।
আরেকটি মাত্রা সংযোগ হয়েছে গত আড়াই দশকে। তা হলো যে দল ক্ষমতায় আছে তাদের সমর্থক ছাত্রসংগঠনের কর্মী-সমর্থক ছাড়া ভিন্নমতাবলম্বীদের স্থান হয় না হল বা হোস্টেলে। কেউবা থাকেন পরিচয় গোপন করে বা ক্ষমতাসীন কারও আনুকূল্যে। তাঁরা তেমন কর্মসূচিও করতে পারেন না ক্যাম্পাসে। তাই হয়তো মাঝেমধ্যে হিসাব-নিকাশ করেন, আবার তাঁদের সমর্থক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে কড়ায়-গন্ডায় পুষিয়ে নেবেন। আগেও তাই হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু চেহারা বদল। বদল হয় না সংস্কৃতি। যেটুকু হয় তা-ও নিম্নমুখী। কিছুদিন আগে একটি ছাত্রসংগঠন স্কুল পর্যায়ে কমিটি গঠনের অনুমোদন দিয়ে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। আশা করব ওই পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতি থেকে সুবুদ্ধিসম্পন্ন নেতারা অন্যদের বিরত করবেন।
তাহলে কেউ ভাবতে পারেন, ডাকসু নির্বাচন কি হওয়া উচিত নয়? জবাব হবে, অবশ্যই হতে হবে। এর একটি যুগবাহিত উত্তরাধিকার ছাড়াও আইনগত দিক রয়েছে। তেমনি নির্বাচন হওয়া দরকার সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদের। পাশাপাশি ছাত্ররাজনীতির বর্তমান যে হাল, তা বিপরীতমুখী করার জোর প্রচেষ্টাও নেওয়া দরকার। তাদের গণতন্ত্রের চর্চা শুরুতেই শিখতে হবে। নিজস্ব কমিটিগুলো নিজেদেরই গণতান্ত্রিকভাবে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচন করতে হবে। কেন্দ্রীয় কমিটিও নির্বাচিত হবে কাউন্সিলরদের ভোটে এবং সেই সম্মেলনে। ঘোষণা হবে না অন্য কোনো স্থান থেকে। হল বা হোস্টেলের দখলদারির অবসান ঘটানো সময়ের দাবি। বিরোধী ছাত্রসংগঠনের সভা-সমিতি করার অধিকার বিষয়েও জোর ব্যবস্থা নিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। অন্যথায় সেই নির্বাচন হবে একতরফা ও নিষ্ফল।
তবে এত সব করার জন্য ডাকসু বা অন্যান্য ছাত্রসংসদের নির্বাচন নিয়ে বসে থাকলেও চলবে না। এতে কোনো দিনই ছাত্র সংসদ ফিরে পাবে না প্রতিষ্ঠানগুলো। বেআইনি ঘোষিত নয় এমন সব ছাত্রসংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার অধিকার থাকতে হবে ক্যাম্পাসে। এই প্রক্রিয়া দুঃসাধ্য হলেও অসম্ভব নয়। আর এই কাজে হাত দেওয়ার এখনই সময়। কর্তৃপক্ষ কঠোর আচরণবিধি প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নে ন্যায়নিষ্ঠ অকুতোভয় ভূমিকা নিলে ব্যাপারটি সহজ হয়ে যাবে। তবে সমস্যা হচ্ছে শিক্ষকেরাও এখন ছাত্রদের মতোই দল করছেন। দলের মধ্যে হচ্ছে উপদল। আর তাদের সভা-সমাবেশ শান্তিপূর্ণ হয় না, এমনটাও দেখা দেয়। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো কোনো উপাচার্য সরাসরি সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সমর্থনে অন্যায্য কথা বলেন এবং কাজ করেন দেখে আমরা বিস্মিত ও ব্যথিত হই।
এত কিছুর পরেও কাজটি করতে হবে শিক্ষকদেরই। সহায়তা দিতে হবে ছাত্রদের। কোনো দলের সমর্থক হলেও বিবেকহীন নন এমন শিক্ষক আছেন অনেক। এ দেশের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতাসংগ্রাম-সব ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আজও তাঁদেরই যাত্রা শুরু করতে হবে। তাঁরা সফল হলে অন্যরা সেদিকে হাত বাড়াতে থাকবেন। ক্রমান্বয়ে ছাত্ররাজনীতির চলমান বন্ধ্যাত্ব কেটে যাওয়ার একটি প্রক্রিয়াও এর মাধ্যমে সূচনা হতে পারে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
[email protected]