বিদায়, দেশি ইলেকট্রনিক শিল্পের পথিকৃৎ

এস এম নজরুল ইসলাম
এস এম নজরুল ইসলাম

কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা খ্যাতি বা স্বীকৃতির পেছনে ছোটেন না। প্রত্যাশা করেন না প্রতিদান কিংবা স্তুতির। এড়িয়ে চলেন প্রচার। নীরবে-নিভৃতে করে যান নিজের কাজ। যা একসময় শুধু কাজ থাকে না, হয়ে ওঠে মহৎ সেবা। যাঁর আলোয় আলোকিত হয় মানুষ, দেশ ও জাতি। তেমনি একজন মানুষ ছিলেন আলহাজ এস এম নজরুল ইসলাম। ওয়ালটন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। ১৭ ডিসেম্বর রোববার রাতে না-ফেরার দেশে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনশিল্পের এই পথিকৃৎ।

জন্ম ১৯২৪ সালে। টাঙ্গাইলের গোসাই জোয়াইর গ্রামে। তাঁর বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। তিনিও বাবার সঙ্গে যোগ দেন ব্যবসায়। তখন আসামের সঙ্গে নৌপথে ব্যাপক বাণিজ্য হতো বাংলাদেশের। তাঁরা আসামের সঙ্গে ব্যবসা করতেন। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শুরু করেন পৃথক ব্যবসা। ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন রেজভী অ্যান্ড ব্রাদার্স, সংক্ষেপে আরবি গ্রুপ। রেজভী তাঁর বড় ছেলে। পাঁচ ছেলে আর দুই মেয়ের পিতা তিনি। যে ব্যবসাতেই হাত দিয়েছেন, সফলতা পেয়েছেন সেখানেই। সৎ, নিষ্ঠাবান ব্যবসায়ী হিসেবে সব মহলে পেয়েছেন পরিচিতি।

ব্যবসা তত দিনে এই পরিবারের ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত হয়েছে। বড় ছেলে এস এম নূরুল আলম রেজভী, মেজো এস এম শামসুল আলম, সেজো এস এম আশরাফুল আলম, চতুর্থ এস এম মাহবুবুল আলম এবং ছোট ছেলে এস এম রেজাউল আলম সবাই যোগ দেন বাবার সঙ্গে। নজরুল ইসলামের কিঞ্চিৎ ইচ্ছে ছিল, সন্তানেরা বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করে ভালো চাকরিবাকরি করবেন। কিন্তু ছেলেরা কেউ বিদেশে পড়তে যাবেন না, যা করার দেশেই করবেন।

অবশ্য ছেলেদের এই বেঁকে বসার আরেকটা বড় কারণ ছিল। বাংলাদেশ সম্পর্কে বাইরের দেশগুলোতে নেগেটিভ ধারণা ছিল। এই নেগেটিভ ধারণাকে পজিটিভে রূপান্তরের একটা জেদ ছিল তাঁদের মনে। ছেলেরা বলতেন, এমন একটা কিছু করব, যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায়। তাই সবাই যখন প্রচলিত ধ্যানধারণা নিয়ে এগোচ্ছিল, তাঁরা হাঁটলেন অন্য পথে। দেখলেন, প্রযুক্তিপণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। দূরদর্শী, সাহসী ও সুদূরপ্রসারী একটা উদ্যোগ নিলেন তাঁরা।

ছেলেদের নিয়ে বসে নজরুল ইসলাম ঠিক করলেন ব্র্যান্ডের নাম। পারিবারিক বৈঠকে বেশ কিছু নাম উত্থাপিত হলো। বেশি ভোট পেল ওয়ালটন। দ্বিতীয় হলো মার্সেল। যে কারণে প্রথম দিকে ওয়ালটন ব্র্যান্ডের নামেই শুরু হয় তাঁদের ইলেকট্রনিক ব্যবসা। যাতে বিশাল ভূমিকা ছিল তাঁর মেধাবী সন্তানদের।

ইলেকট্রনিক পণ্যের বেচাকেনায় দেখলেন সফলতার মুখ। ব্যবসার উন্নতি তাঁদের অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু দেশের এই খাত তখন শতভাগ আমদানিনির্ভর। জাহাজ বোঝাই করে মিলিয়ন ডলারের পণ্য আসে জাপান, সিঙ্গাপুর, চীন ও তাইওয়ান থেকে। স্বপ্ন দেখলেন, এ রকম জাহাজ বোঝাই করে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখা ইলেকট্রনিক পণ্য যাবে বিদেশে। যদিও সে সময় এমন স্বপ্ন দুঃসাধ্যই ছিল। অতিরিক্ত স্বপ্নবানেরাই এমন দিনের প্রত্যাশা করতেন। তত দিনে ছেলেরা হয়ে উঠেছে আরও পরিপক্ব। ব্যবসার হাল ছেলেদের হাতেই। আবার বসলেন ছেলেদের নিয়ে।

আরেকটি পারিবারিক বৈঠকে ঠিক হলো আরবি গ্রুপ দেশেই ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক্যাল পণ্য তৈরি করবে। যদিও তারও অনেক আগেই গ্রাহকপ্রিয়তা পায় তাঁদের ব্র্যান্ড ওয়ালটন। এখানে একটি বিষয় বলে রাখি, অনেকেই মনে করেন, ওয়ালটন বিদেশি ব্র্যান্ড। এটি আসলে কোনো বিদেশি ব্র্যান্ড নয়, পারিবারিক বৈঠক থেকেই ঠিক হয়েছিল ওয়ালটন নামটি।

২০০৬ সাল। গাজীপুরের চন্দ্রায় জায়গা কিনলেন। ব্যাংক লোন নিয়ে শুরু করলেন কারখানার ভবন নির্মাণের কাজ। কিন্তু ওই ব্যাংককে কিছু লোক বোঝাতে সক্ষম হলো এ ধরনের কারখানা বাংলাদেশে সফলতা পাবে না। ওয়ালটন ডুববে, ব্যাংকের টাকা মার যাবে। ব্যাংক চাপ দিল টাকা ফেরত দিতে। জমিজমা, গয়নাসহ বিভিন্ন সম্পদ বিক্রি করে পরিশোধ করা হলো ব্যাংকের টাকা। কষ্টেসৃষ্টে নিজেদের টাকাতেই এগিয়ে চলল কারখানার কাজ।

২০০৮ সালে উৎপাদনে গেল ফ্রিজ তৈরির কারখানা। প্রথম লটে তৈরি হলো ১ হাজার ৭০০ ফ্রিজ। কিন্তু বিধিবাম, কারিগরি ত্রুটি দেখা দিল তাতে। মার্কেট থেকে সব ফ্রিজ তুলে নেওয়া হলো। ভয় না পেয়ে ত্রুটি সারিয়ে উদ্যোক্তারা শুরু করলেন নতুন উদ্যমে। সাশ্রয়ী মূল্যে উচ্চমানের পণ্য এবং সেবা দিয়ে জয় করে নিলেন গ্রাহকের আস্থা। পর্যায়ক্রমে শুরু করলেন টেলিভিশন, মোটরসাইকেল এবং এয়ারকন্ডিশনার উৎপাদন প্ল্যান্ট। সবকিছুতেই ওয়ালটন পাইওনিয়ার।

এরই মধ্যে দেশীয় পণ্যের একটি ক্রেজ তৈরি হয়ে গেল। আগে যেখানে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ কথাটাকে অবহেলার চোখে দেখা হতো, একসময় সেটিই হয়ে ওঠে সম্মানের এক স্লোগান। ওয়ালটন পণ্যের উচ্চমান গ্রাহকদের আশাবাদী করে তুলল। শুরু হলো একই গ্রুপের আরেক ব্র্যান্ড মার্সেলের পথচলা। আরবি গ্রুপ নাম বদলে হয়ে গেল ওয়ালটন গ্রুপ।
এরপর এল স্বপ্নপূরণের ক্ষণ। মধ্যপ্রাচ্য দিয়ে শুরু হলো ওয়ালটন পণ্যের রপ্তানি। বর্তমানে কমবেশি ২০টি দেশে যাচ্ছে ওয়ালটন পণ্য। মেড ইন বাংলাদেশ লেখাটি এখন বিশ্বের মানুষের কাছে সম্মান আদায় করে নিতে সক্ষম হচ্ছে। এরই মধ্যে উৎপাদন শুরু হয়েছে বিভিন্ন হোম, কিচেন ও ইলেকট্রিক্যাল অ্যাপ্লায়েন্স। ‘সময় এখন বাংলাদেশের’ স্লোগান নিয়ে অতি সম্প্রতি শুরু হয়েছে দেশের প্রথম মোবাইল ফোনের কারখানা। শিগগিরই ল্যাপটপ উৎপাদনে যাচ্ছে ওয়ালটন। রয়েছে আরও কিছু পরিকল্পনা।
এরই মধ্যে ওয়ালটন কারখানা কমপ্লেক্স হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ প্রযুক্তি পণ্যের উৎপাদন ও গবেষণাগার। বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা কারখানা রূপ নিয়েছে বাংলাদেশি প্রযুক্তির সুনিপুণ আধারে। সরাসরি প্রায় ৩০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তৈরি হচ্ছে দক্ষ জনশক্তি।
বর্তমানে বাংলাদেশে শিল্পায়নের মডেল হয়ে উঠেছে ওয়ালটন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা ওয়ালটন কারখানা পরিদর্শন করে মুগ্ধ হয়েছেন। অনেক বিশেষজ্ঞ ওয়ালটনের উদ্যোগকে অভিহিত করেছেন আসল শিল্প হিসেবে। আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে ওয়ালটনের সাকসেস স্টোরি পড়ানো হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্টের উদাহরণ হিসেবে। আগে বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে শিক্ষার্থীরা বিদেশে চলে যাওয়ার কথা ভাবতেন। এখন তাঁরা স্বপ্ন দেখেন ওয়ালটনে কাজ করার।
প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনে ওয়ালটনের এই অগ্রযাত্রায় এস এম নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রধান সেনাপতির ভূমিকায়। মেধাবী এবং ভবিষ্যৎদ্রষ্টা সন্তানেরাই হয়তো করেছেন মূল যুদ্ধ। কিন্তু তিনি ছিলেন তাঁদের মাথার ওপরে ছাতার মতো।
নজরুল ইসলাম চলে গেলেন, কিন্তু তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান রয়ে গেল দেশ-বিদেশের মানুষের কল্যাণে।
উদয় হাকিম: সিনিয়র অপারেটিভ ডিরেক্টর, ওয়ালটন গ্রুপ।