সবার কাছে উন্মুক্ত হও হে প্রশ্নপত্র!

আজকাল কী যে দিন পড়েছে, প্রশ্নপত্র ঢাকা থাকতেই চায় না। কি শীত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা—যেকোনো ঋতুতে অনুষ্ঠিত পরীক্ষাতেই এ এক সাধারণ প্রবণতা। চিকুনগুনিয়ার মতো মারাত্মক রোগের প্রাদুর্ভাব যদিও প্রতিরোধ করা সম্ভব, কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো মনুষ্যনিয়ন্ত্রিত রোগের প্রতিরোধ কিংবা প্রতিকার যেন অসম্ভব। প্রশ্নপত্রের মুক্ত হওয়ার বাসনা এতটাই প্রবল যে তা বিবেচনায় আনছে না পরীক্ষার্থীর বয়স কিংবা অবস্থান। এসএসসি, এইচএসসি কিংবা বিসিএস—এ ধরনের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিজ্ঞতা আমাদের নানা সময়ে হয়েছে। কিন্তু এখন যেন কোনো বাছবিচার নেই, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা থেকে শুরু করে জেএসসি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসহ চাকরিতে নিয়োগের পরীক্ষা—কোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্রই এখন ফাঁস হওয়া থেকে মুক্ত নয়। হালে এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রাথমিক স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা। কয়েক দিন আগে এক বন্ধু তার মেয়ের প্রথম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর জানাল। মনে হলো ভালোই তো, এটি আর বাদ থাকবে কেন!

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মহোদয় দায়িত্বের সঙ্গে জানিয়েছেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করতে হলে সবার মধ্যে সংবেদনশীলতা জাগা দরকার। যাঁর যাঁর অবস্থান থেকেই নাকি এর প্রতিরোধ করতে হবে। অর্থাৎ প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে আমাদের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে বিবেকবোধ আর সংবেদনশীলতার দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। আর সরকার, মন্ত্রণালয় ও পরীক্ষা গ্রহণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নিশ্চিন্তে শীতনিদ্রা দেবেন। তবু আশার কথা, সরকার ইদানীং প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা স্বীকার করছে, যা এত দিন তারা করেনি।

প্রথম আলোর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে সরকারের লেজেগোবরে অবস্থার চিত্রটি। যদিও এই প্রতিবেদনে সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপের ইঙ্গিত আছে, তবে এর সুফল আদৌ পাওয়া যাবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সরকার থেকে নেই কোনো কঠোর অবস্থান। বরং সচিব মহোদয়ের উদ্ধৃতি সরকারের অসহায়ত্বকেই প্রতিফলিত করে। দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক প্রশ্নপত্র ফাঁসের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে শিক্ষা বোর্ড, বিজি প্রেস, ট্রেজারি ও পরীক্ষা কেন্দ্র। কথা হচ্ছে এর কোনোটিই সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। বলা হয়েছে নতুন আবিষ্কৃত এক ইলেকট্রনিক ডিভাইসের কথা। এই ডিভাইসের মাধ্যমে নাকি পরীক্ষার্থীরা অনায়াসে পরীক্ষার হলে বসে প্রশ্ন-উত্তর আদান-প্রদান করতে পারে। প্রশ্নপত্র ফাঁসে তথ্যপ্রযুক্তির এই ব্যবহারকে সরকার এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে এক ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দাবি করলে অবশ্য ভিন্ন কথা!

এই যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, এর ‘সুফল’ কিন্তু সবাই পায় না। কেউ কেউ ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পায়, সবার ভাগ্যে তা মেলে না। প্রশ্নপত্র ফাঁস যদি বাস্তবতাই হয়, সরকার যদি তা ঠেকাতেই না পারে, তাহলে সব ধরনের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রকে পুরোপুরি মুক্ত করে দিলেই তো হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস যেভাবে সরকারের কাছে আশকারা পাচ্ছে, তাতে প্রশ্নপত্রের চরিত্র আর লুকিয়ে রাখার সুযোগ কই। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ, বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি যে পরীক্ষাগুলো হবে, তার প্রশ্নপত্রগুলোও পৌঁছে দিন। তাহলেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের সব ল্যাঠা চুকে যাবে। পাবলিক হোক আর বার্ষিক হোক, পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র অনুযায়ী পড়াশোনা করে ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দেবে। কোনো ঝুটঝামেলা হবে না।

আর এতে যা লাভ হতে পারে তা হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের একটি পরিবেশ তৈরি হতে পারে। পরীক্ষার চিন্তা বাদ দিয়ে বছরজুড়ে শিক্ষার্থীরা পড়বে শুধুই মনের আনন্দে। এভাবে তারা যা পড়বে, সেটাই দেবে প্রকৃত জ্ঞান, আর অভিভাবকেরাও থাকতে পারবেন নির্ভার। কোচিং সেন্টারের দরজায় তালা ঝুলবে, বন্ধ হবে গাইড বইয়ের ব্যবসা। সরকার চেষ্টা করেও যখন প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করতে পারছে না, তখন এ ছাড়া আর উপায় কী! এতে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাভীতি দূর হবে, ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র জোগাড় করে যে শিক্ষার্থী বা অভিভাবকেরা বিবেকের দংশন অথবা মানসিক ও আর্থিক চাপে পড়েন, তা-ও দূর হবে। একই সঙ্গে সরকারকেও আর প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে না। তাই প্রশ্নপত্র নিয়ে কোনো লুকোছাপা নয়। আর যেভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের হিড়িক লেগেছে তাতে মনে হচ্ছে প্রশ্নপত্র নিজেই আর আড়ালে অবগুণ্ঠন থাকতে চাইছে না। মনে হচ্ছে প্রশ্নপত্র নিজেও বেশ সাহসী হয়ে উঠেছে। তাই প্রশ্নপত্রের কাছেও অনুরোধ, সব কুণ্ঠা ঝেড়ে ফেলে এবার নির্ভয়ে তুমি তোমার ঘোমটা খোলো। বেরিয়ে এসো সামনে। সবার
কাছে উন্মুক্ত হও। মুক্ত করো শিক্ষার্থীদের আর প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ থেকে মুক্তি দাও সরকারকে।

নিশাত সুলতানা: কর্মসূচি সমন্বয়ক, জেন্ডার জাস্টিস ডাইভার্সিটি প্রোগ্রাম, ব্র্যাক।